শান্তনু চক্রবর্তী
রোজ ট্রেনে চেপে চার্লস দ্য গল এয়ারপোর্টের কাছাকাছি একটা হোটেলে চাকরি করতে আসে অড্রে। তার কাজ হাউসকিপিং-এর। মস্ত একটা ট্রলি ঠেলে ঠেলে, লিস্টি মিলিয়ে সে হোটেলের এই মুড়ো থেকে ওই মুড়ো এক-একটা ঘরের যাবতীয় ছড়ানো-ছেটানো এলোমেলো এতোল-বেতোলগুলো গুছিয়ে দেয়। বিছানার চাদর, বাথরুমের তোয়ালে পালটে দেয়। খুচরো আবর্জনা সাফ করে। রোজ রোজ, ঘণ্টার পর ঘণ্টা সে যন্ত্রের হাতে এই কাজগুলোই করে যায়। মাঝেমধ্যেই হাউসকিপিং ম্যানেজারের হুকুমে ছুটির পরেও আরও কয়েক ঘণ্টা তাকে হোটেলে থেকে যেতে হয়। কুড়ি-বাইশ বছরের মেয়েটার দম আটকে আসে। অথচ ওই হিলটন হোটেলের প্রত্যেকটা ঘরের জানলা দিয়ে সামনের বিমানবন্দরের রানওয়েটা দেখা যায়। দেশবিদেশের কত বিমান উড়ছে, নামছে। তাদের ডানায় অনেকটা রোদ্দুর। মাথার ওপর কতটা আকাশ! ম্যানেজারের মুখঝামটা খেয়ে অড্রে চটপট হাত চালায়। এখনও কতগুলো ঘর বাকি! অড্রের ঠিক পাশটায়, জানলার বাইরেই পড়ে থাকে রূপকথার রানওয়ে। সেখানে ডানায় সাগরপাড়ির দম নিয়ে ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমিদের মতো অপেক্ষায় থাকে বিমানগুলো।
প্যারিস থেকে শহরতলিতে আসার পথে ট্রেনের জানলায় দোল খায় কয়েকটা চড়ুই। কামরাসুদ্ধ বেজায় ব্যস্ত লোকেরা কেউ দেখতেই পায় না শুধু অড্রেরই চোখে পড়ে ফুর্তিবাজ চড়ুইগুলো। তার মনের ভেতর ছটফটানো, খাঁচাবন্দি চড়ুইপাখির আভাসটা হয়তো শুরুর দিকেই দিয়ে রাখলেন পরিচালিকা। পরে সেটা থেকেই তো একটা পরাবাস্তব ম্যাজিক ঘটে যাবে। কিন্তু ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমিদের পিঠে চড়ে দ্য গল বিমানবন্দরে নানান দেশের যে রাজপুত্তুররা নামে, অড্রেদের হোটেলেই দু-একটা রাত্তির কাটায়, তার পর আবার ফুড়ুত্ করে উড়ে যায় ভিন দেশের অন্য কোনও শহরে, তারাই কি দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী, স্বাধীন, নির্ভার, মুক্ত মানুষ? তা-ই যদি হবে, তা হলে সেই সিলিকন ভ্যালি থেকে প্যারিসে বিজনেস মিটিং করতে উড়ে আসা, মার্কিনি তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানির বড়কর্তা গ্যারি নিউম্যানের জীবনটা এক রাত্তিরে অমন ওলটপালট হয়ে যাবে কেন? আচমকাই বউ, চাকরি, দুবাইয়ে পরের বিজনেস ট্রিপ, সব ছেড়ে প্যারিসেই কেন থেকে যেতে চাইবে লোকটা?
বউ এলিজাবেথের সঙ্গে তার সারা রাত ধরে স্কাইপ-এ যে ঝগড়া-কান্না-অভিমানের পালা চলে, তা থেকে পরিষ্কার হয়ে যায়, অড্রের মতোই গ্যারিরও কোথাও একটা ভীষণ দম-আটকা লাগছিল। এই ঝাঁ-চকচকে কর্পোরেট কেরিয়ার, অভ্যেসের দাম্পত্য, কোত্থাও তার নিজের জন্য একটুও স্পেস ছাড়া নেই। সব কিছু যেমন ছকে বেঁধে, রুটিন মেনে চলছে, তার থেকে একটু এ দিক-ও দিক কিছু করার স্বাধীনতা অড্রের মতোই গ্যারিরও নেই। ‘বার্ড পিপ্ল’-এ ইচ্ছেডানা মেলতে চাওয়া এই দুটো আলাদা মানুষের গল্প বলা হয়েছে, আলাদা আলাদা করেই। পরিচালিকা তাঁর নায়ক আর নায়িকাকে দেখেছেন খানিকটা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে। লম্বা লম্বা টানা শটে, অজস্র ডিটেলে তাদের রোজকার রুটিন কাজের অসহ্য ক্লান্ত একঘেয়েমিটাকে স্পষ্ট করেছেন। একটু পরের পরাবাস্তব সিকোয়েন্সে যে ক্লান্তিটাকে তিনি আবার এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দেবেন। ছবিটা চাইলেই একটা আধুনিক সিন্ডারেলার গল্প হয়ে যেতে পারত। হোটেলের ময়লাকুড়ুনি অড্রের জীবনের রানওয়েতে কর্পোরেট রাজপুত্তুরের মতোই ‘ল্যান্ড’ করতে পারত গ্যারি। কিন্তু এখানে তো এক অন্য রূপকথার গল্প বলতে চেয়েছেন পরিচালিকা। তাই ছবিতে অড্রে আর গ্যারির দেখা হয় একদম শেষে। হেটেলের লাউঞ্জে। সিন্ডারেলার মতোই অড্রের পায়ে তখন জুতো নেই। কারণ একটু আগেই তো তার স্বপ্নের ডানায় প্যারিসের আকাশে সেই আশ্চর্য সাররিয়াল উড়ানটা সেরে এসেছে অড্রে। হোটেল হিলটনের আঁটোসাঁটো সব নিয়মের মাথার ওপর দিয়ে চক্কর লাগিয়েছে এক বার, দু’বার, বার বার। পুরনো জীবনের সব হিসেব চুকিয়ে সে-ও তো তখন এক পাখি-মানুষ! জীবন আর রূপকথার এমন একটা মেশামেশি জায়গাতেই ছবিটা শেষ হয়ে যায়।
sanajkol@gmail.com
এত বছর ধরে চলতে থাকা নাসার ‘আর্থ-২’ নাটকের ওপর যবনিকা পড়ল। ১৫ বছর আগে, আজকের দিনেই এই নাটকের সূত্রপাত। সে দিন, অত্যন্ত বিষণ্ণ ভাবে নাসা জানিয়েছিল, সূর্যের আয়ু আর মাত্র তিরিশ বছর। তার পর পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব থাকবে না। এ কথা শুনে মুহ্যমান পৃথিবীকে আশার আলোও দেখিয়েছিল তারাই। জানিয়েছিল, দূরের অন্য সৌরজগতে ইতিমধ্যেই একটা গ্রহ মিলেছে, যার সঙ্গে পৃথিবীর বেশ মিল। এই গ্রহকে ‘আর্থ-২’ নাম দিয়ে বিজ্ঞানীরা রাতারাতি অতি-ক্ষমতাশালী মহাকাশযান নির্মাণে হাত দিলেন। তার পরের ঘটনা সবার জানা। পাঁচ বছর পর সুপারফাস্ট স্পেসক্রাফ্ট আবিষ্কৃত হল। একটি ‘ওয়ার্মহোল’-এর মধ্যে দিয়ে এই মহাকাশযান কয়েক ঘণ্টায় এক সৌরজগত্ থেকে অন্য সৌরজগতে চলে যায়। কিন্তু মুশকিল হল, এই যানে একশোর বেশি লোক ধরে না।
নাসার কর্ণধার হিসাবে আমেরিকা এগিয়ে এসে বলেছিল, আগে বাকি সব দেশের বাসিন্দারা পাড়ি দেবে, তার পর তারা যাবে। এটা উন্নত দেশের নাগরিক হিসাবে তাদের নৈতিক দায়িত্ব। ফলে, ওই রকম গোটা কতক মহাকাশযানে চেপে মানুষ গ্রহান্তরী হতে লাগল আর আমেরিকার জয়গান করতে লাগল। বছর দশেকের মধ্যে যখন পৃথিবীর জনসংখ্যা অর্ধেক হয়ে গেল, তখনই গুঞ্জন শুরু। যারা চলে গেছে, তাদের কোনও খবরই মিলছে না। গতকাল সকালে হঠাত্ আমেরিকা স্বরূপ ধারণ করল। তারা বলল, মহাকাশযান পাঠানো বন্ধ হয়ে গেল। বিকেলের মধ্যেই পৃথিবীর সমস্ত দেশগুলোকে কব্জা করে নিয়ে তাদের ঘোষণা: পৃথিবী ধ্বংসের রটনা, আর্থ-২, মহাকাশযান: সবই ছিল তাদের ছক। ভিনগ্রহে নিয়ে যাওয়ার নাম করে অর্ধেক পৃথিবীর মানুষকে তারা মহাশূন্যে ফেলে দিয়েছে। অবশিষ্ট বিশ্ববাসী এখন তাদের ক্রীতদাস। গভীর রাত্রে মার্কিন রাষ্ট্রপতি জানিয়েছেন, এখন থেকে গোটা পৃথিবীই ‘দ্য গ্রেট আমেরিকা’ বলে পরিচিত হবে।
চিন্ময় হরি, নিউ ব্যারাকপুর
লিখে পাঠাতে চান ভবিষ্যতের রিপোর্ট? ঠিকানা: টাইম মেশিন,
রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১।
অথবা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in