ছবি: সুমন চৌধুরী
পাগলা ক্ষীর খা। কেন কী হল? বম্কে গেলাম। উৎখিঁচন, উৎখিঁচন। হ্যাজাচ্ছ কেন? কেসটা কী? উৎখিঁচন-ই বা কী? এখনও শোনোনি তো বস? আড্ডা দিতে দিতে শব্দটা এসে গেল। ঝক্কাস শব্দ। তাই আমরা চালুও করে দিলাম। বন্ধুমহলে কারও হয়তো মন খারাপের ব্যামো। আমরা বলছি উৎখিঁচন। এক মেয়ে তো কাউকে কিছু না জানিয়ে লেঙ্গি খেয়ে কোথায় চলে গেল। পুরো ফ্রাস্টু। আমাদের চার বন্ধু খুঁজতে বেরিয়ে পড়ল তাকে। চার জনের উৎখিঁচন, মেয়েটিরও। শেষে অনেক খোঁজখবর করে তাকে পাওয়া গেল নবদ্বীপে। এক বন্ধু রোজ রোজ মদ খেয়ে বাড়ি ফিরছে আর লোকজনকে টেক্সট করছে রোম্যান্টিক গানের পঙ্ক্তি। কী চাপ? জিজ্ঞেস করলেই বলছে, কী করব, গরিব মানুষ! আমরা লিখলাম, কী কাকা, এত উৎখিঁচন কীসের? জেলার ছেলে। কলকাতার থিয়েটারে অভিনয় করে। স্কলারশিপ পেয়ে বিদেশেও যাচ্ছে। কী বাওয়াল! বাংলা খেয়ে খামকা কোনও রাতে উত্তর থেকে দক্ষিণ কলকাতা, কোনও রাতে দক্ষিণ থেকে উত্তরে হাঁটাহাঁটি। কী লোড নিচ্ছে মাইরি। পুরো উৎখিঁচন পাবলিক। এ দিকে কেস জন্ডিস। আমার এক জুনিয়র এসে বলল, দিদি, উৎখিঁচন। বললাম, কী ঘাপলা? বলল, চাকরিটা ছেড়ে দেব। সিরিয়ালের প্রোমো বানাতে আর ভাল্লাগছে না। বললাম, বিন্দাস। ভাড়াবাড়িটাও ছেড়ে দে। তা হলেই খাপে-খাপ। সে বলল, ‘দশটা আইডিয়া নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি। আদ্ধেক আদ্ধেক চিত্রনাট্য। সবগুলোই মনে হচ্ছে কথা-হবে-না। কিন্তু কোনওটাই আর শেষ পর্যন্ত এগোচ্ছে না। ল্যাদ খেতে খেতে ছড়াচ্ছি। দশ দিকে মাথা গলিয়ে পুরো উৎখিঁচন। এক জন ছেলের সঙ্গে ব্যথা-ব্যথা কেস। শয়নে স্বপনে তার সঙ্গে ঘোরাফেরা, এমনকী নৌকায় সন্ধের গঙ্গায় ভাসতে ভাসতে কল্পিত ছোঁয়াছুঁয়ি। তার গন্ধে সব কিছু ঘেঁটে ঘ। এ দিকে এ সবের কিছুই জানে না সে। কী বলব, উৎখিঁচনের চূড়ান্ত।’
শব্দটা চালু হয়ে গেল। কিন্তু যারা ব্যবহার করছে, তারা অনেকেই অনুপের নাম জানে না। ওর মাথা থেকেই শব্দটা বেরিয়েছিল। সকাল থেকে সন্ধে অফিসে খেটে সংসার সামলানো উত্তর কলকাতার এক বন্ধু। এত কাছ থেকে একটা শব্দের জন্ম হতে দেখব ও শুনব, আমার কাছে চমকে চোদ্দো হওয়ার বিষয়।
এ দিকে কী করে যেন ভক্চক্ হয়ে গেল। সে আবার কেমন ব্যাপার? ভ্যাবাচ্যাকা বা কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা। যা করতে চাওয়া হয়েছে তা না হয়ে অন্য কিছু হয়ে যাওয়া। ‘ভালবাসা পেলে সব লণ্ডভণ্ড করে চলে যাব’ না বলে ‘... সব ভক্চক্ করে চলে যাব’-ও বলা যেত। অহমিয়া ভাষায় ‘ভক’ বলতে বোঝায়: চিন্তাভাবনার তারল্যবশত যে ব্যক্তিকে বিশ্বাস করা যায় না। ভক্চক্-এর মধ্যেও কি সেই তারল্য রয়ে গেল? ফেসবুকে ‘ভক্চক্ ভণ্ড’ ব্যবহার হতে দেখেছি। ভণ্ডামির তীব্রতা বুঝিয়ে ছেড়েছে। ‘ভক্চক্ করা’ মানে চমকে গিয়ে সব গুলিয়ে ফেলা, যা আমরা প্রায়ই করে থাকি।
একটি শব্দের জন্ম হয় লোকগল্পের বা গানের মতো। কার মাথা থেকে বের হচ্ছে আর কী ভাবে ছড়িয়ে পড়ছে, কেউ জানে না। তখন পাটের থলেকে হারিয়ে প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগের চল হয়েছে গ্রামেগঞ্জেও। যত দূর মনে পড়ছে, আশির দশকের একেবারে শেষ দিকে বা নব্বইয়ের শুরু। মুর্শিদাবাদের এক স্কুলে পড়ি। বর্ষাকালে প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগের মধ্যে বইপত্র ঢুকিয়ে নিই আমরা। রাস্তায় হাঁটছি। হঠাৎ বৃষ্টি এল। ওই প্লাস্টিক মাথায় ধরে দৌড়লাম আশ্রয়ের খোঁজে। হঠাৎ শুনি, ‘আমার চিলিমিলি ছুঁবি না, ছিঁড়ে যাবে!’ চিলিমিলি? আমার কাছ পর্যন্ত পৌঁছনোর আগেই শব্দটা গ্রামের বাচ্চাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে, প্লাস্টিকের ব্যাগের প্রতিশব্দ হিসেবে। শব্দটা মনে পড়লে এখনও মন চনমন করে ওঠে। চিলিমিলির মধ্যে একটা কবিতার মতো অনুভূতি আছে। ঝিলিমিলি শব্দটার সহোদর যেন। আসলে বর্ণনাত্মক শব্দ। কোমল ছোট ছোট হাতে প্লাস্টিক ছোঁয়ার ফলে যে ধ্বনির উৎপত্তি, তা-ই বর্ণনা করছে চিলিমিলি।
মোবাইলে কথোপকথন সস্তার হয়ে উঠতেই ফোন কাটার সময় কবে থেকে যে বলতে শুরু করলাম ‘চল্/চলো, রাখছি’, তা ভুলেই গেছি। এই ‘চল’ কি কোথাও যাওয়ার, না কি শুধুই ‘ছাড়ছি’, না কি চলমান যন্ত্র সঙ্গে থাকার চলমানতা?
শুনেছি, এই শহরের নামকরণের পিছনেও নাকি পরস্পরের ভাষা না-বোঝার গল্প ছিল। বিদেশিদের ঘোড়ার জন্য এ-দেশীয়রা ঘাস বিক্রি করত। জোব চার্নক জিজ্ঞেস করেছিলেন জায়গার নাম। ঘাসবিক্রেতা ভেবেছিল, উনি জিজ্ঞেস করছেন, ঘাসটা কবেকার কাটা। সে বলেছিল, ‘কাল কাটা।’ সেই থেকে নাকি ‘ক্যালকাটা’। যদিও সুকুমার সেনের মতে, দুটি আরবি শব্দ যা ফারসির মাধ্যমে বাংলায় এসেছে: ‘কলি’ (qali; অস্থির, নির্বাধ) এবং ‘কাতা’ (qatta; বদমাইশ দল, খুনেরা)-র সংযোগে হয়েছে কলিকাতা (> কলকাতা)। তাঁর মতে, গঙ্গা তীরস্থ বাদা অঞ্চল সে কালে জলদস্যু, স্থলডাকাত, দেশি-বিদেশি বদমাশদের লুকিয়ে থাকার জায়গা ছিল। অত বড় পণ্ডিত যখন বলছেন, কথাটা নির্ঘাত সত্যি, কিন্তু প্রথম গল্পটা বিশ্বাস করতে ভারী মজা লাগে।
‘উজবুক’ শব্দটা যে অর্থে বাংলায় ব্যবহৃত হয়, তাতে কেবলই মনে হয়, কোনও এক কালে এখানে এসে উজবেকিস্তানের মানুষরা বোকামিই করেছিল শুধু। ‘ভয়ংকর’ শব্দটা তো ‘সুন্দর’-এর আগে বসে তার পুরনো গ্লানি মুছে ফেলে প্রসারিত করেছে নিজেকে। ‘ব্যাপক’ শব্দটিও পুরনো অর্থের পাশাপাশি নতুন অর্থেও ব্যবহৃত হচ্ছে। কিছু দিন আগেও কল্পনা করা যেত না, একটা মেয়েকে দেখে, ‘তোমাকে ব্যাপক লাগছে’ বলা যায়! আগে মন্দির ছিল মানুষের বসবাসের জায়গা। এখন কেবল দেবতাদের। একটা শব্দ তার ভূগোল ও ইতিহাসকেও ধারণ করে কখনও। ‘তটস্থ’ শব্দটার কথাই ধরা যাক। বন্যা-কবলিত বাংলার নদীতটের সঙ্গে ভয়ের সম্পর্ক তো থাকবেই।
মিখাইল বাখতিন-এর কথায়, কোনও শব্দ মৌখিক ভাবে ব্যবহৃত না হলে তার কোনও অস্তিত্বই নেই। আর তা লেখার আকারে এলে, বক্তার চরিত্রকেও ধারণ করে থাকে। মানে, নতুন শব্দ মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়লে সে স্বাগত। প্রতিটি শব্দে একটা যুদ্ধ-যুদ্ধ ব্যাপার। কতটা গ্রহণ করবে বা কতটা ত্যাগ করবে তা নিয়ে সারা ক্ষণ যুদ্ধ চলে একটা শব্দের অন্তর ও বাহিরে। শব্দ যেন পলিটিকালি পাওয়ারফুল হতে চায়, নিজের আধিপত্য স্থাপন করতে চায়। তাই রক্তাক্ত হয় শব্দের ইতিহাস। এক শ্রেণির বাঙালি ফারসি আমলে ফারসি আর ইংরেজ আমলে ইংরেজি শিখে খিদমত করেছিল শাসকদের। ও-পার বাংলার ভাষা আন্দোলন আজও স্মরণীয় হয়ে আছে। ধর্মীয়, আর্থিক ও সামাজিক ভাবে ওপরের দিকে যাদের অবস্থান, তাদের তৈরি নিয়মকানুন, ভাষা ও শব্দ যুগে যুগে আধিপত্য করেছে। লক্ষ্মণ সেনের বামুনদের কিছু কিছু নিয়ম যেমন আজও চলে, তেমনই পাণিনি ও তাঁর সহকারীদের তৈরি— নিচু তলার মানুষ ও নারীদের স্পর্শ বর্জিত— ধ্রুপদী সংস্কৃতকে জীবন্ত করার স্পৃহা থেমে নেই।
ফেসবুকে একটা পেজে কিছু নতুন শব্দ দেখে চমকে গেলাম। দুষ্টুমির চূড়ান্ত। দুর্ধর্ষ সপ্রতিভ ব্যাপারস্যাপার। কিছু শব্দ তুলে দেওয়ার লোভ সামলানো গেল না। জানি না এই অপরাধের জন্য, নতুন শব্দগুলির আব্বাজান, পেজের মালিক, আমাকে মারবেন কি না। কিছু দারুণ শব্দ অবশ্য দেওয়া যাবে না, সেগুলো ছাপার অযোগ্য ও সুতরাং একশো গুণ মজাদার! নিরাপদ শব্দগুলো:
অ্যালকুহেলিকা— মদের ঘোর।
একাডেমিশিয়াল— বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ধযুক্ত বাটপাড়।
মানবাধিকারবার— দুর্বৃত্তের পিঠ বাঁচাতে মানবাধিকারের প্যাঁচ খাটানোর ব্যবসা।
তখ্তাবধায়ক— গদি দখলের ব্যবস্থা করে দেয় যে।
চিন্তাইকারী— ভুল ও অসৎ চিন্তাভাবনা পরিবেশনকারী।
হাড়হাভাড়ে— যুক্তির বদলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নামের ওজন নিয়ে তর্ক জয়ে সচেষ্ট ব্যক্তি।
গুজবুক— গুজবকে প্রামাণ্য ভাবার মতো উজবুক।
মুসলমানবতা— কেবল ভিন্নধর্মীদের হাতে মুসলিমরা আক্রান্ত হলে যে মানবতা জেগে ওঠে।
বাম্রাজ্যবাদ — এক সাম্রাজ্যবাদীর দুধকলা খেয়ে অন্য সাম্রাজ্যবাদীর বিরুদ্ধে বিপ্লবের অভিনয় পন্থা।
আঁতাতুর্ক— যে কোনও পরিস্থিতিতে আঁতাতের গন্ধ খুঁজে পেয়ে তুর্কি নাচন নাচা বাটপাড় ব্যক্তি।
ভুলতেয়ার— জনসমক্ষে ভুলভাল মিথ্যে কথা বলার অধিকারের পক্ষে লড়াই চালিয়ে যাওয়া ব্যক্তি।
ভঙ্গীকার— ভঙ্গ করার জন্য অঙ্গীকার।
একটা শব্দ খুব ভাল: ট্যাগটিভিস্ট— ট্যাগ করে বা হ্যাশট্যাগ (#) দিয়ে যারা অ্যাক্টিভিজমের দায় চোকায়। অবশ্য, ইংরিজিতেও এখন ‘slacktivist’ বা ‘clicktivist’ শব্দগুলো চালু। ‘clicktivist’ তো বোঝাই যাচ্ছে, শুধু মাউসের কতগুলো ক্লিক দিয়ে যাদের সমাজ-সংস্কার শেষ, ‘slacktivism’-ও তা-ই। ‘slacker’ আর ‘activism’-এর জোড়শব্দ। slacker মানে কুঁড়ে, গা-এলানো পাবলিক। এরা ইন্টারনেট পিটিশন সই করে, সমাজ-সচেতন পোস্ট এলে সেটাকে কপি-পেস্ট করে বহু লোককে পাঠায় বা যুদ্ধের প্রতিবাদে ফেসবুকে নিজের স্টেটাসটা বদলে একটা আগুনবর্ষী বাক্য লাগায়। মোদ্দা কথা, এরা শুধু সেটুকুই করে, যাতে নিজের পিঠ চাপড়ে একটা ‘সংগ্রামী’ ইমেজে তা দেওয়া যায়, কিন্তু গায়ে একটিও ফোসকা পড়ে না। রাস্তায় নেমে আন্দোলনও করতে হয় না, পরিশ্রম বা বিপদে ঝাঁপানোর তো প্রশ্নই নেই। আসলে, মানুষের যত নতুন নতুন পেজোমি আর উৎখিঁচন গজাবে, ততই জন্ম নেবে নতুন নতুন শব্দ।
mousumibilkis@gmail.com
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy