Advertisement
E-Paper

স্বাধীনতা

অফিস থেকে ফিরতে না ফিরতেই রিন্টি বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল, জানো বাবা, আজ স্কুলে কী হয়েছে? রিন্টির মা ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, সারা দিন বাবার অফিসে অনেক ধকল গেছে। আগে বাবাকে ফ্রেশ হয়ে একটু বিশ্রাম নিতে দাও। তার পর স্কুলের গল্প কোরো। আর তোমার তো স্কুলের একঘেয়ে সব কথা। কে টিফিনে চাউমিন এনেছিল, অঙ্কের ক্লাসে আন্টি তোমায় ভেরি গুড দিয়েছেন— এই সব তো? নতুন কিছু থাকলে বলো। রিন্টি রাগে গজগজ করতে করতে বলল, আমি আর কিছুই বলব না।

শিবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১০ অগস্ট ২০১৪ ০০:২০
ছবি: সুমন চৌধুরী

ছবি: সুমন চৌধুরী

অফিস থেকে ফিরতে না ফিরতেই রিন্টি বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল, জানো বাবা, আজ স্কুলে কী হয়েছে? রিন্টির মা ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, সারা দিন বাবার অফিসে অনেক ধকল গেছে। আগে বাবাকে ফ্রেশ হয়ে একটু বিশ্রাম নিতে দাও। তার পর স্কুলের গল্প কোরো। আর তোমার তো স্কুলের একঘেয়ে সব কথা। কে টিফিনে চাউমিন এনেছিল, অঙ্কের ক্লাসে আন্টি তোমায় ভেরি গুড দিয়েছেন— এই সব তো? নতুন কিছু থাকলে বলো। রিন্টি রাগে গজগজ করতে করতে বলল, আমি আর কিছুই বলব না।

রিন্টির বাবা বললেন, ঠিক আছে, একটু পরেই আমি তোমার সমস্ত কথা মন দিয়ে শুনব। মুখ গোমড়া করে রিন্টি বলল, আমি তোমায় কিছু বলব না। একঘেয়ে সব কথা তোমার শুনতে ভাল লাগে না। বলতে বলতেই মেয়ের চোখে জল। মেয়ের চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বাবা বললেন, মায়ের কথায় রাগ করে না, মা। তোমার সব কথা তো আমি রোজই শুনি। আজ নিশ্চয়ই নতুন কিছু হয়েছে তোমার স্কুলে। সেটা ভাল করে শুনতে হবে। ততক্ষণ পড়া করো। ‘আমি আসছি’ বলে তিনি ভিতরের ঘরে প্রবেশ করলেন। সব কিছু দেখেশুনে রিন্টির মা মেয়েকে ভর্ৎসনা করে বললেন, কেবল রাত-দিন বাবার সঙ্গে আদিখ্যেতার একশেষ। যেমন বাবা, তেমনি মেয়ে। বাবার প্রশ্রয় পেয়ে তুমি মাথায় উঠেছ।

কিছুক্ষণ পরে রিন্টির বাবা মেয়ের পড়ার ঘরে ঢুকে বললেন, এ বার বলো আজ তোমার স্কুলে কী হয়েছে? মেয়ের তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন, স্বাধীনতা মানে কী, বাবা? মেয়ের এ হেন প্রশ্ন হতচকিত হয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কেন? তা জেনে তোমার কী দরকার? অত্যুৎসাহে রিন্টি বলল, আন্টি বলেছে, আগামী শুক্রবার স্বাধীনতা দিবস। তোমাদের স্কুল ছুটি থাকবে। সেই দিন তোমরা সকলে এমন একটা কাজ করবে, যাতে স্বাধীনতাকে সম্মান দেখানো হয়। যার কাজ অভিনব হবে, তাকে প্রাইজ দেবে বলেছে। আমি স্বাধীনতাকে সম্মান জানাতে কী করব, বাবা? বাবা মেয়েকে আদর করে বললেন, অনেক কিছুই করা যায়। তুমি কী করবে, সেটা তোমার ব্যাপার। তবে স্বাধীনতার অর্থ হল পরাধীনতা থেকে মুক্তি। আমাদের দেশ আগে ছিল ইংরেজদের একটা উপনিবেশ। আমরা ছিলাম পরাধীন। উৎকণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করল রিন্টি, কী ভাবে আমরা স্বাধীন হলাম বাবা? বাবা হেসে বললেন, সে অনেক কথা। দেশ জুড়ে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। বাংলা, মহারাষ্ট্র এবং পঞ্জাব থেকে মূলত এই বিপ্লব সংগঠিত হয়েছিল। আপসহীন সংগ্রামের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রদেশে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল সাধারণ মানুষ। লেখকদের কলম গর্জে উঠেছিল— বাঁধা হয়েছিল গান, লেখা হয়েছিল কবিতা। বিদেশি জিনিস বর্জন করে বেড়েছিল দেশি জিনিসের ব্যবহার। সারা দেশে বিভিন্ন বিপ্লবমঞ্চ গড়ে লাগাতার আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামীরা। ক্রমাগত আঘাতে আঘাতে জর্জরিত ইংরেজ তাদের দুশো বছরের রাজত্ব ভারতীয় আন্দোলনের কাছে নতিস্বীকার করে ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল।

সেই ব্যাপক আন্দোলনের ফল হিসেবে ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট ভারতবাসীর ঘরে ঘরে আনন্দোৎসব পালিত হল। তাই, স্বাধীনতা দিবসে সেই সব বীর সৈনিকদের আমরা সম্মান জানাই। রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে যাঁরা দেশের জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, তাঁদের সেলাম করি। হাঁ-করে বাবার কথা শুনছিল রিন্টি। হঠাৎ বাবাকে প্রশ্ন করল রিন্টি, স্বাধীনতা সংগ্রামী কারা বাবা? উত্তরে রিন্টির বাবা বললেন, তোমার ইতিহাস বইয়ে অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামীর কথা লেখা আছে। আমি তোমায় আলাদা করে কোনও স্বাধীনতা সংগ্রামীর নাম বলব না। বিভিন্ন সময়ে আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁদের কথা ছবিসহ তোমার বইয়ে পাবে। ভাল করে পড়ো, তা হলেই সব জানতে পারবে। আর কী ভাবে তুমি স্বাধীনতাকে সম্মান জানাবে? তা নিজেই ঠিক করতে পারবে। মাথা নেড়ে রিন্টি বলল, বুঝতে পেরেছি। তোমাকে আর বলতে হবে না, বাবা।

ওই ক’টা দিন রাত্রিবেলা বাবার কথা মতো ইতিহাসের পাতা ওলটাতে ওলটাতে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সম্বন্ধে অনেক কিছুই জেনে ফেলল রিন্টি। কী ভাবে স্বাধীনতা এসেছিল, তারও একটা সম্যক ধারণা গড়ে উঠল রিন্টির। ইংরেজ আমলের বন্দিদশায় ভারতবাসীর অবস্থা কেমন ছিল, তা ভেবে মনে মনে শিউরে উঠেছিল রিন্টি। স্বাধীনতা দিবসের আগের রাতে ইতিহাস বইটা খোলা অবস্থায় বুকের ওপর রেখেই ঘুমের দেশে চলে গেল রিন্টি। ভোরবেলা তার ঘুম ভাঙল খাঁচাবন্দি টিয়াপাখিটার ডাকে। রিন্টি চোখ মেলে দেখল তার টিয়াপাখিটা চিলচিৎকার জুড়েছে আর ডানা ঝাপটাচ্ছে। বিছানা ছেড়ে সে বারান্দায় পাখিটার কাছে যেতেই তার চিৎকার আর ডানা ঝাপটানো বন্ধ হল।

মাস দেড়েক আগে রথের মেলায় গিয়ে মা-বাবার ইচ্ছের বিরুদ্ধে টিয়াপাখিটা বায়না করে কিনেছিল রিন্টি। রোজ তাকে খাবার দেওয়া, স্নান করানো, তার সঙ্গে নিয়মিত কথা বলেও পাখিটাকে পোষ মানাতে পারেনি রিন্টি। সে কেবল খাঁচায় বসে ডানা ঝাপটায় আর কর্কশ গলায় চিৎকার করে। অনেক ভালবেসে, আদরযত্ন করেও একটাও বুলি শেখানো যায়নি তাকে। পাখিটা যেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, কোনও শেখানো বুলি সে বলবেই না! রিন্টি মনে মনে ভাবে, পাখিটা বোধ হয় আর খাঁচায় বন্দি থাকতে চায় না। ভারতবাসীর মতো সে মুক্তি পেতে চায়।

স্বাধীনতা দিবসের দিনটা খুব একটা ভাল কাটল না রিন্টির। সকালবেলা বাবার সঙ্গে ছাদে ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে লাটাই থেকে ঠিকমত সুতো ছাড়তে না পারায় বাবার ঘুড়ি ভোকাট্টা। মনখারাপ করে নীচে নেমে এল রিন্টি। মনে দুশ্চিন্তা, কাল স্কুলে আন্টি জিজ্ঞেস করলে কী বলবে সে। স্বাধীনতার সম্মানের জন্য কিছুই তো করা হল না! শুধু একটা কথা ভেবে আনন্দ হল রিন্টির, সে দিন বাড়িতে বেশ ভালমন্দ রান্না হয়েছে।

ভোরবেলা অবশ্য বাবার হাত ধরে পাড়ায় পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছিল রিন্টি। শুধু লজেন্স, বিস্কুটপ্রাপ্তি ছাড়া সে তেমন কোনও সুবিধা করতে পারেনি। দেশাত্মবোধক গান বা কবিতা, কোনও বিভাগেই সে অংশগ্রহণ করতে পারেনি। আর ‘বসে আঁকো’ প্রতিযোগিতায় জাতীয় পতাকার ছবির ওপর শেষ মুহূর্তে রঙের কৌটো উলটে এক ভয়বহ কাণ্ড!

শেষ পর্যন্ত বিষণ্ণ মনে পর দিন সকালে বাবার হাত ধরে স্কুলের দিকে পা বাড়ায় রিন্টি। তার মনের মধ্যে একটা চাপা ভয়। কাল সারা দিনে সে এমন কিছু করতে পারেনি, যাতে স্বাধীনতাকে সম্মান দেখানো যায়।

সময় মতো ক্লাসে হাজির হলেন চন্দ্রাণী আন্টি। ক্লাসের সবাইকে ‘গুড মর্নিং’ করে জিজ্ঞেস করলেন, কাল স্বাধীনতা দিবসে তোমাদের যে হোমওয়ার্ক দিয়েছিলাম, সবাই করেছ তো? ক্লাসরুমের টেবিলে রাখা সুন্দর গোলাপি বিশাল একটা টেডিবিয়ার দেখিয়ে তিনি বললেন, যার কালকের কাজ ভাল এবং অভিনব হবে, তার জন্য রয়েছে এই পুরস্কার। টেডিবিয়ারটা দেখে চোখ চকচক করে উঠল রিন্টির। মনে ভাবল, রিয়ার জন্মদিনে ওর ছোটমামা ঠিক এই রকম একটা টেডিবিয়ার দিয়েছিলেন। রিয়া সেটা এক বারও ধরতে দেয়নি রিন্টিকে। সেই কষ্ট কি ভোলা যায়?

চন্দ্রাণী আন্টি এক এক করে সকলকে জিজ্ঞেস করতে শুরু করলেন যে, তারা স্বাধীনতাকে সম্মান জানাতে কী কী করেছে। কেউ ব্যাগ থেকে বের করল জাতীয় পতাকার ছবি, কেউ বা স্বাধীনতা সংগ্রামীর। কেউ বা স্বাধীনতা বিষয়ক স্বরচিত ছড়া বা কবিতা। সেগুলোয় চোখ বুলিয়ে আন্টি বললেন, ভেরি গুড। খুব ভাল হয়েছে। এ বার শুনব বাকিদের কাজের কথা। কেউ বলল, দেশাত্মবোধক গান করেছে, কেউ বা পাড়ার মঞ্চে নাচ করেছে। কেউ কেউ আবার জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সময় বীর সৈনিকদের সেলাম করেছে। কেউ ‘বসে আঁকো’ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পুরস্কার জিতেছে। পাংশু মুখে রিন্টি বসে বসে ভাবছে, এই বুঝি আন্টি তাকে জিজ্ঞেস করল। ভাবতে ভাবতেই আন্টির প্রশ্ন, কী হল রিন্টি, মুখ শুকনো করে বসে আছ কেন? সকলের কাজ দেখলাম। সবার কথা শুনলাম। এ বার তোমার পালা। বলো, তুমি কাল স্বাধীনতাকে সম্মান জানাতে কী করেছ। কোনও কথা মুখে সরে না রিন্টির। সে মাথা নিচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। আন্টি মিষ্টি কথায় বলেন, চুপ করে থেকো না। বলো, কী করেছ। আর কোনও উপায় নেই দেখে ছলছল চোখে রিন্টি বলে ওঠে, কাল একটা খুব খারাপ কাজ করে ফেলেছি আন্টি। আমার পোষা টিয়াপাখিটা কিছুতেই খাঁচায় বন্দি থাকতে চাইছিল না, তাই ওকে আমি খাঁচার দরজা খুলে উড়িয়ে দিয়েছি। তাই আমার মনটা খুব খারাপ। রিন্টির কথা শুনে আন্টির তো চোখ ছানাবড়া। তিনি রিন্টিকে কাছে ডেকে জড়িয়ে ধরে বললেন, এর থেকে ভাল কাজ আর হয় না। বন্দিদশা থেকে তুমি পাখিটাকে মুক্তি দিয়েছ। স্বাধীনতাকে সত্যিই তুমি যথার্থ সম্মান দেখিয়েছ। আন্টি টেবিলে রাখা বিশাল টেডিবিয়ার রিন্টির হাতে তুলে দিয়ে বললেন, অভিনব কীর্তির জন্য এই পুরস্কার তোমার। ক্লাসের সকলে হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানাল রিন্টিকে।

shibnath bandyopadhyay shibnath amela
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy