Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ৩

সু ম না মি

কবীর সুমনসামনে বসে গানবাজনা শোনার ব্যাপারটাই আলাদা, শিল্পী যদি ভাল হন। আমার হিরো তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান আমি প্রথম শুনি বেতারে নয়, সামনে বসে। তখন আমি সবে আমার জন্মস্থান কটক থেকে কলকাতা এসেছি। ১৯৫৫ সাল। আমার বয়স ঠিক ছ’বছর। এক সন্ধেবেলা এক ভদ্রলোক এলেন আমাদের বাড়িতে। সুন্দর দেখতে। ব্যবহারও ভারী মিষ্টি। এক প্রস্থ চা-বিস্কুটের পর বাবা নিজে খাটের তলা থেকে হারমোনিয়ামটা বের করে আনলেন, আর ভদ্রলোক হাঁ হাঁ করে উঠলেন, ‘ছি ছি, বড়দা, আমি থাকতে আপনি?’ পঞ্চাশের দশক থেকেই কলকাতার বেতার-গ্রামোফোন শিল্পীরা বাবাকে বড়দা, আর সুপ্রভা সরকারকে বড়দি বলতেন।

ছবি: সুমন চৌধুরী।

ছবি: সুমন চৌধুরী।

শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০১৪ ০০:১৪
Share: Save:

সামনে বসে গানবাজনা শোনার ব্যাপারটাই আলাদা, শিল্পী যদি ভাল হন। আমার হিরো তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান আমি প্রথম শুনি বেতারে নয়, সামনে বসে। তখন আমি সবে আমার জন্মস্থান কটক থেকে কলকাতা এসেছি। ১৯৫৫ সাল। আমার বয়স ঠিক ছ’বছর। এক সন্ধেবেলা এক ভদ্রলোক এলেন আমাদের বাড়িতে। সুন্দর দেখতে। ব্যবহারও ভারী মিষ্টি। এক প্রস্থ চা-বিস্কুটের পর বাবা নিজে খাটের তলা থেকে হারমোনিয়ামটা বের করে আনলেন, আর ভদ্রলোক হাঁ হাঁ করে উঠলেন, ‘ছি ছি, বড়দা, আমি থাকতে আপনি?’ পঞ্চাশের দশক থেকেই কলকাতার বেতার-গ্রামোফোন শিল্পীরা বাবাকে বড়দা, আর সুপ্রভা সরকারকে বড়দি বলতেন।

হারমোনিয়াম বাজিয়ে সুদর্শন পুরুষটি গান ধরলেন, ‘স্বপ্ন রাঙাতে কেন এলে’।— কী যে সুন্দর, খোলা আওয়াজ! উচ্চারণ কী স্পষ্ট ও সুশ্রাব্য! কী সুর, আহা, সেই গানটির! অন্তরায় শিল্পী গলা খুলে গাইছেন চড়ার পরদায়, কোথাও কিছু চাপাচুপি দেওয়ার চেষ্টা নেই, বা, শুনছে তো মোটে চার জন, তার মধ্যে আবার এক জন বেশ ছোট, আর এক জন একটু বড়, অতএব দায়সারা ভঙ্গিতে গেয়ে দিই— এমন ভাবভঙ্গি একেবারেই নেই। তাঁর ঘরোয়া গান শুনে মনে হয়েছিল, পাঁচশো শ্রোতার সামনে তিনি যে ভাবে, যে চূড়ান্ত ভঙ্গিতে গাইবেন, সেই ভাবে, সেই ভঙ্গিতেই গাইছেন মোটে চার জনের সামনে।

‘স্বপ্ন রাঙাতে কেন এলে’ গানটি প্রথম শোনাতেই বেজায় ভাল লেগে গিয়েছিল আমার। আরও কিছু গান গেয়েছিলেন এই শিল্পী। কিন্তু প্রথম গানটির রেশ থেকে গিয়েছিল অন্য সব গান ছাপিয়ে। ষাট বছর কেটে গিয়েছে। আজও বাড়িতে যদি গান পায় তো গিটার, পিয়ানো বা হারমোনিয়াম বাজিয়ে এই গানটি আমি গুনগুন করে হলেও গাইবই গাইব। কথার জন্য কোনও খাতা দেখতে হয় না আজও, যদিও নিজের গানের কথা আমি কিছু কাল হল ভুলে যাচ্ছি। একা একা গান গাইলে নিজের গান কখনও গেয়েছি বলে মনেও পড়ে না। মনে পড়ে শুধু— সেই সন্ধের সুদর্শন ও বেজায়-সুগায়ক শিল্পীকে বাবা ডাকছিলেন ‘তরুণ’ বলে। পরে জেনেছি তাঁর পুরো নাম ‘তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়’।

আকাশবাণী কলকাতার ‘অনুরোধের আসর’-এ তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান কখনও শেষ গান, এমনকী শেষের আগের গান হিসেবেও শুনিনি। তাঁর গান শুনতে পেতাম আরও আগে। কিন্তু প্রায়ই খেয়াল করেছি, তাঁর গায়কির উজ্জ্বলতায় ম্লান হয়ে গেল সামাজিক ও বাজারি গুরুত্বের দিক দিয়ে তাঁর চেয়ে নামী এমন শিল্পীদের গান।

‘স্বপ্ন রাঙাতে কেন এলে’র গ্রামোফোন রেকর্ডিংয়ে গানের আগে ছিল অ্যাকর্ডিয়ন। জানি না কে বাজিয়েছিলেন। গানের ঠিক মুখেই অদ্ভুত এক সর্পিল গতি ছিল অ্যাকর্ডিয়নের সেই সুরে। আমি কখনও শুধু গান শুনিনি। আমার কাছে বাজনার গুরুত্ব গানেরই মতো। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের প্রিয় গানগুলির বেশ কয়েকটির সঙ্গের যে বাজনা (বাজনাটাও জুতসই না হলে গানের আবেদন কিছুটা হলেও মার খেত আমার কাছে), প্রিলিউড ইন্টারলিউড বা কোনও এক সুযোগে ছোট করে বাজিয়ে দেওয়া সুর— এগুলি ছিল এক-একটা বক্তব্য, যা গানের সম্পূরক।

আমার হিরোর ‘স্বপ্ন রাঙাতে কেন এলে’র ইন্টারলিউডে ৩২ মাত্রা জুড়ে অ্যাকর্ডিয়নের যে উক্তি, তা অন্তরার ‘চাহি না এ ক্ষণিকের আলো/ তুমিহারা রাত তবু ভালো’র তারসপ্তকের শুদ্ধ গান্ধারে এক লাফে চলে যাওয়ার আস্ফালনটাকে আরও তীব্র করে তুলেছে। ‘চাহিনা এ’ তারের সা থেকে শুদ্ধ গান্ধারে। আর ‘ক্ষণিকের’-এর সুরে তিন মাত্রায় কোমল গা, শুদ্ধ গা, তারের সা। এ গানের স্থায়ীর সুরে এর আগে কোমল গান্ধার আসেনি। সঞ্চারীতেও গান্ধার শুদ্ধই। কিন্তু দুটি অন্তরাতেই দুই মাত্রায় কোমল, তার পরেই শুদ্ধ গা অপ্রত্যাশিত আনন্দ দেয়। আর তার পরেই প্রথম অন্তরার ‘আলো’র ‘আ’-তে মধ্যসপ্তকের শুদ্ধ ধৈবত থেকে তারের সা; ‘লো’তে পাঁচ মাত্রা ধরে কোমল গান্ধার। দ্বিতীয় অন্তরাতেও একই সুর।

এই মধ্যসপ্তকের শুদ্ধ ধা থেকে তারের সা ছুঁয়ে তারের কোমল গা-এ (তার আগে প্রযুক্ত তারের শুদ্ধ গা-এর রেশ তখনও রয়েছে) একটু দীর্ঘ অবস্থান আকাশবাণীর আশ্চর্য সিগনেচার টিউনের স্মৃতি নিয়ে আসবে সুরসন্ধানীদের কাছে। সেই সুর শুরুই হচ্ছে তারের কোমল গা-এ। সেখানে আমরা পাচ্ছি কোমল গা-এ মাত্রা তিনেক কাটিয়ে তারের শুদ্ধ রে ও সা ছুঁয়ে মধ্যসপ্তকের শুদ্ধ ধা-এ একটু বিরাম।

কোমল গা, শুদ্ধ রে ও শুদ্ধ ধা— এই স্বরপরম্পরা আমেরিকার সংগীত-আঙ্গিক ব্লুজ-এ এবং আমেরিকার ‘পপ’-এ যথেষ্ট শোনা গিয়েছে এক সময়ে। এখনও শোনা যায়। পঞ্চাশের দশকের এক বিখ্যাত লঘুসংগীত শিল্পী প্যাট বুন-এর ‘মুডি রিভার’-এ এর নিদর্শন পাওয়া যাবে। তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সপ্রতিভ ভঙ্গিতে গাওয়া এই গানটি শুনে বোঝা যায় আধুনিক বাংলা গানের সুরকাররা সে যুগে চল্লিশের দশকের পাশ্চাত্য লঘুসংগীতের কিসিমগুলোয় আর আটকে থাকতে চাইছিলেন না।

‘তুমি কতদূর কোথায় বসে’ আমার হিরোর গাওয়া আর একটি গান, যা ছেলেবেলা থেকে আজ পর্যন্ত আমার মনে কথা-সুর সমেত তাজা থেকে গিয়েছে। সন্দেহ নেই, কথার দিক দিয়ে গানটি ততটা আধুনিক নয়, যতটা সুর-ছন্দে। কথার কারণে গানটি আজকের দিনে গাইতে গিয়ে একটু অস্বস্তি হয়, ঠিকই। কিন্তু একই অস্বস্তি দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, কাজী নজরুল ইসলাম ও সলিল চৌধুরীরও কোনও কোনও গান গাইতে গিয়েও হওয়ার কথা, যদি আমরা নির্মোহ হয়ে ভাবি।

‘চম্পাকলি গো কত নামে ডেকেছি তোমায়’, ‘নদী ছলোছল হাওয়া ঝিরিঝিরি কথা বলে’, ‘মোর মালঞ্চে বসন্ত নাই রে নাই’, ‘তোলপাড় তোলপাড়’, ‘চলো রিনা’, ‘চুপ, দেওয়ালেরও কান আছে’ (এমন আধুনিক গান আমার যুগেও তৈরি হয়নি, এমন গায়কিও না)— প্রতিটি গানেই তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় সুরে-স্বরপ্রক্ষেপে-গায়কিতে অব্যর্থ, নিখুঁত, তাজা। তাঁর গায়কিতে যৌবনের যে আস্ফালন, তা তাঁর সমকালেও ছিল রীতিমত বিরল, পরে আরও। ক’জন পেরেছেন ষাট ও সত্তরের দশকে হিন্দি ফিল্মি গানার সামনে বাংলা গানের পিছু হটার যুগে জলসায় জলসায় শুধু একটা হারমোনিয়াম নিয়ে বাবু হয়ে মঞ্চে বসে বাংলার নবীনদের নাচিয়ে দিতে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

kabir suman
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE