Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ৩

হ্যালো 60’s

তখন জলঙ্গী নদীর রূপ ছিল অপরূপ, জোয়ার-ভাটা না খেললেও তাতে বেশ স্রোত ছিল, বইত নবদ্বীপের ভাগীরথী পানে। নদীর এক পাড়ে ভাঙন লেগেই থাকত, নিয়ম অনুযায়ী অপর পাড় গড়ত। চিকচিকে সাদা বালির ঘাট ছিল, হাঁটুডোবা বালির চড়ায় চলত আমাদের কতশত খেলাধুলো।

১৯৬৬-র ৫ মার্চ ছাত্র বিক্ষোভ ও খাদ্য আন্দোলনের জেরে পুলিশের গুলি ও ব্যাপক ধরপাকড়ের পর শুনশান নদিয়ার রাস্তা

১৯৬৬-র ৫ মার্চ ছাত্র বিক্ষোভ ও খাদ্য আন্দোলনের জেরে পুলিশের গুলি ও ব্যাপক ধরপাকড়ের পর শুনশান নদিয়ার রাস্তা

সঞ্জীব রাহা
কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

তখন জলঙ্গী নদীর রূপ ছিল অপরূপ, জোয়ার-ভাটা না খেললেও তাতে বেশ স্রোত ছিল, বইত নবদ্বীপের ভাগীরথী পানে। নদীর এক পাড়ে ভাঙন লেগেই থাকত, নিয়ম অনুযায়ী অপর পাড় গড়ত। চিকচিকে সাদা বালির ঘাট ছিল, হাঁটুডোবা বালির চড়ায় চলত আমাদের কতশত খেলাধুলো। তখনও ফরাক্কা ব্যারেজ তৈরি হয়নি, তাই আমার মামাবাড়ি কুচবিহার যাওয়া ছিল বড় হাঙ্গামার কাজ। মা লটবহর সহ আমাদের নিয়ে যেতেন রেলগাড়িতে চড়িয়ে। ইঞ্জিনে কয়লা দিলেই কয়লার কুচি উড়ে চলে আসত। মাঝে মাঝে চোখে কয়লার কুচি ঢুকে বিপত্তি ঘটাত। সাহেবগঞ্জে নেমে অনেকটা পথ গরম বালির ওপর দিয়ে, কিছুটা শালের পাটাতনের ওপর দিয়ে দড়ি ধরে লাইন দিয়ে এগোতাম। বিহারি কুলির মাথায় থাকত টিনের তোরঙ্গ আর হাতে কাঠের ফ্রেমবন্দি জলের কুঁজো। ঘরের চিঁড়ে-মুড়ি-মোয়া ও নাড়ু ছিল তখনকার খাবার। গঙ্গার এ-পার ও-পার দেখা যেত না। শকরি গলি ঘাট ও মনিহারি ঘাটের মধ্যে চলত রেল কোম্পানির বড় স্টিমার। ভোঁ বাজিয়ে ছাড়ত। স্টিমারের মধ্যিখানে বরফি-জাল ঘেরা ব্যারিকেডে উঁকি মেরে কয়লাচালিত ইঞ্জিনের কারুকর্ম দেখতাম। ওই একই টিকিটের দৌলতে উঠতাম অপেক্ষাকৃত ছোট ট্রেনের সংরক্ষিত আসনে। জায়গা না পেলে আমরা বসতাম তোরঙ্গ বা হোল্ড-অলের ওপর।

আমি তখন স্কুলের ছাত্র। চারিদিকে খাবারের অভাব। চাল নেই, ডাল নেই, তেল নেই। পরিবারে অনেক ভাইবোন, তাই খবর পেতাম কোথায় কখন চাল দেবে, গম দেবে বা পাঁউরুটি পাওয়া যাবে। সারা দিনে তিন ভাই লাইন দিয়ে দুই-তিন সের চাল হয়তো পেতাম। রেশনের চালে থাকত অজস্র কাঁকর আর পচা চাল। মানুষের মনে ক্ষোভ জমছিল ক্রমে ক্রমে। তুলোর বিচির মতো তামাটে রঙের মাইলো আর ভুট্টা দিত রেশনে। ভাতের বদলে রুটি খেতে শিখলাম। গমের সঙ্গে মাইলো আর মাঝেমধ্যে ভুট্টা মিশিয়ে গম ভাঙাতাম। মা যত চেষ্টাই করুক, রুটির চার ধার ফেটে চৌচির হয়ে যেত। ঠান্ডা হলে রুটিটা জুতোর সুখতলার মতো চিমড়ে হয়ে যেত।

১৯৫৯ সালে কংগ্রেস আমলে খাদ্য আন্দোলন শুরু হয়। তখন খাদ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেনের কাঁধে অস্থায়ী মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব। ১৯৫৯ সালের ১৮ জুলাই এই আন্দোলন হঠাৎ সহিংস হয়ে ওঠে। বাসে-ট্রামে আগুন লাগে। ১৯৬৬ সালের ৪ মার্চ আমাদের স্কুলের ছাত্র আনন্দ হাইত পুলিশের গুলিতে মারা যায়। উত্তাল হয়ে ওঠে কৃষ্ণনগরের আকাশ-বাতাস। পর পর আগুন ধরানো হয় সিভিল সাপ্লাই অফিস, রেশন দোকানে। স্কুলের ছাত্ররা কাঁচকলা আর কানা বেগুন নিয়ে মিছিল করে। মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেন ও কংগ্রেস সভাপতি অতুল্য ঘোষের কুশপুত্তলিকা পোড়ানো হল। পর দিন আন্দোলন আরও জোরালো হল। আগুন লাগল পুলিশ ক্লাবে ও সরকারি অফিসে। ৫ মার্চ আবার পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হল হরি বিশ্বাস ও অর্জুন ঘোষের। পুলিশের লাল টুপি দেখলেই সবাই টিপ্পনী কাটত, ‘পুলিশ তুমি যতই মারো/ মাইনে তোমার একশো বারো।’ খাদ্য আন্দোলনে কৃষ্ণনগর ছিল সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের পুরোধা।

নকশালবাড়ির কৃষকদের সংগ্রামের ঢেউ অচিরে এসে লাগে কৃষ্ণনগরে। সেটা অবশ্য ষাটের দশকের শেষ আর সত্তরের দশকের শুরু মিলিয়ে কয়েকটা বছরের কথা। আরম্ভ হল গুপ্তহত্যার রাজনীতি, পুলিশ মারার রাজনীতি। দেওয়ালে দেওয়ালে পোস্টার পড়ল, অমুক গ্রামের তমুক জোতদার খতম, নীচে লেখা ন.কৃ.স.স.স. (নকশালবাড়ি কৃষক সংগ্রাম সহায়ক সমিতি)। স্কুল-কলেজের পাঁচিলে মাও জে দং-এর স্টেনসিল-কাটা টুপি-পরা মুখ, নীচে লেখা ‘চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান/ চীনের পথ আমাদের পথ।’ আরও পরে শুরু হল স্কুলের আসবাবপত্র আর অফিসে ল্যাবরেটরিতে আগুন দেওয়া, বিদ্যাসাগর-রবীন্দ্রনাথ-নেতাজি সহ মনীষীদের মূর্তি ভাঙা। চোখের সামনে ক্লাসের সবচেয়ে মেধাবী ছেলেটা পড়াশোনা বন্ধ করে সমাজকে পালটে দেওয়ার ব্রতে শামিল হল। স্কুল-কলেজ-পড়াশোনা-পরীক্ষা সব শিকেয় উঠল। পাড়ায় পাড়ায় কার্ফু জারি করে শুরু হল খানাতল্লাশির নামে চরম অত্যাচার-অবিচার। শহর ভরে উঠল সিআরপিএফ সহ কেন্দ্রীয় বাহিনীতে। বহু ছাত্রছাত্রী আত্মগোপন করে তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ জলাঞ্জলি দিল। এই সময় নকশাল আন্দোলনের দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হল ও পোস্টারের নীচে ২য় সি. সি. লেখা থাকত। আন্দোলনও আরও জঙ্গি রূপ ধারণ করল। গলিবহুল কৃষ্ণনগর শহরে ভিন রাজ্যের পুলিশের সঙ্গে তরুণ সংগ্রামী ছেলেদের চলত অদ্ভুত চোর-পুলিশ খেলা। পিকিং রেডিয়ো থেকে ঘোষিত হত, কৃষ্ণনগরের অমুক পাড়া তমুক এলাকা মুক্তাঞ্চলে পরিণত হয়েছে। এখানে ওখানে বোম, পেটো পড়ছে। পাড়ার পোস্ট অফিসে পেট্রোল বোমায় আগুন ধরে গেল। চারিদিকে অস্থির বিশৃঙ্খল অবস্থা, সংবাদপত্রের হেডলাইনে কৃষ্ণনগরের উপস্থিতি তখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।

১৯৬১ সালের রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের অঙ্গ হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের প্রথম রবীন্দ্রভবনটি স্থাপিত হয় কৃষ্ণনগরে। তখন আমাদের পাড়ায় নাট্যসংস্থা ও যাত্রা কোম্পানির রমরমা ছিল, তাঁরা নিয়মিত নাটক ও যাত্রাপালার আসর বসাতেন পাড়ার বারোয়ারিতলায়। তখন আমরা পাড়ার মাঠে বা স্কুলে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করতে, মা-দিদিদের কাপড় ও বিছানার চাদর দিয়ে নিজেরাই বাঁশ বেঁধে তৈরি করতাম প্যান্ডেল। রিহার্সাল চলত মাসখানেক আগে থেকে। প্রতি সন্ধেবেলা টিভি-কালচার না থাকায় তখন তাস, দাবা, ক্যারমের প্রতিযোগিতা হত। এ ছাড়াও প্রায়ই কোনও কোনও বাড়িতে বসত গানের আর যন্ত্রসংগীতের আসর। প্রতি দিন, বারো মাস মাঠগুলো খেলাধুলোয় ভর্তি থাকত। নিয়মিত চলত ফুটবল-হকি-ক্রিকেট, এমনকী ভলিবল-বাস্কেটবল লিগও, স্কুল বা কলেজ পর্যায়ে। তখন ফুটবলে এ, বি এমনকী সি ডিভিশনেরও খেলা হত। আর চলত দেহচর্চা, লাঠিখেলা, জিমন্যাস্টিক্স। আড্ডা মারার জন্য ছিল পাড়ার ক্লাব বা সংঘ। কারও বিপদে তরুণ দল ঝাঁপিয়ে পড়ত নির্দ্বিধায়।

drsanjibraha@gmail.com

ষাটের দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে?
লিখুন এই ঠিকানায়:

হ্যালো 60s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১।
বা, লেখা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE