সালটা ১৯৬৫। আমি তখন পূর্ব পাকিস্তানের একটা নামকরা হাইস্কুলের শিক্ষক। এক সাংবাদিক বন্ধুর কল্যাণে ‘পাকিস্তান অবজার্ভার’ গ্রুপের ‘দৈনিক পূর্বদেশ’ পত্রিকায় লোকাল করেসপন্ডেন্টের একটা কাজ পেয়ে গেলাম। একই সঙ্গে শিক্ষকতা আর সাংবাদিকতার কাজ করে চলেছি। তখন আমার আর এক বন্ধু ভারতে আসবেন। আমি কাউকে কিছু না বলে কাঁধে একটা ঝোলাব্যাগ নিয়ে তার সঙ্গে চললাম। আমার পাসপোর্ট ছিল না। বন্ধুটি আমাকে নিরাপদে বর্ডার পেরিয়ে নিয়ে আসার আশ্বাস দিলেন।
তখন বরিশাল এক্সপ্রেস শিয়ালদা-খুলনা আপ-ডাউন করত। সেই গাড়ি থেকে বিনা-পাসপোর্টের যাত্রীদের বেনাপোল সীমান্তে নামিয়ে নেওয়া হত। পুলিশের সঙ্গে তাদের একটা রফা হত। পরে ট্রেন ছাড়ার ঠিক পাঁচ মিনিট আগে তাদের ট্রেনে তুলে দেওয়া হত। এটাই ছিল দস্তুর। সে দিন যথানিয়মে প্রায় শ’দেড়েক বিনা-পাসপোর্টের যাত্রীকে একটা ঘরে নিয়ে বসিয়ে রাখা হল। আমার বন্ধুটি পুলিশের সঙ্গে রফা করে আমাকে নিয়ে ট্রেনের কামরায় উঠে বসলেন। ট্রেন ছাড়ার ঠিক দশ মিনিট আগে এক উচ্চপদস্থ মিলিটারি অফিসার এলেন। সঙ্গে আর্মির কিছু লোক, ডি.এম, এস.পি, গাড়িভর্তি পুলিশ। ঘোষণা হল: যে যার পাসপোর্ট হাতে সিটে বসে থাকুন, আবার পাসপোর্ট চেকিং হবে। বন্ধু ব্যাগ খুলে তাঁর পুরনো পাসপোর্টটি আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। অফিসার শুধু ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখে নিলেন, প্রত্যেকের হাতে পাসপোর্ট আছে কি না। খুব কড়া প্রহরায় ট্রেন ছেড়ে দিল। সেই ট্রেনে একমাত্র আমিই বিনা-পাসপোর্টে ভারতে আসতে পেরেছিলাম। পর দিন থেকে বরিশাল এক্সপ্রেস বন্ধ হয়ে গেল। তারও তিন দিন পর, ’৬৫-র ৫ সেপ্টেম্বর পাক-ভারত যুদ্ধ ঘোষণা হতেই বুঝলাম, কেন ট্রেন বন্ধ হল, কেনই বা সে দিন বর্ডারে অত কড়াকড়ি ছিল। বাড়ি থেকে নিখোঁজ আমি ভারতে আটকা পড়ে গেলাম।
’৬২-র ভারতবর্ষ। ভারত-পাক যুদ্ধের আবহে
বাক্সপ্যাঁটরা বেঁধে শরণার্থীর ঢল। নতুন ঠিকানার খোঁজে।
ভবানীপুরের গিরিশ মুখার্জি রোডে মামার বাড়িতে থাকি। কসবা চিত্তরঞ্জন ইন্সটিটিউট (হায়ার সেকেন্ডারি)-এর প্রিন্সিপাল ছিলেন মামার জানাশোনা। আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে গেলেন, যদি তাঁর স্কুলে শিক্ষকতার কোনও কাজ পাওয়া যায়। তখন বেসরকারি স্কুলে হেডমাস্টার বা সেক্রেটারি তাঁদের পরিচিত লোককে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করতে পারতেন। সে দিন ম্যানেজিং কমিটির সেক্রেটারি আর এক জন মেম্বার উপস্থিত ছিলেন। প্রিন্সিপাল আমাদের নিয়ে তাঁদের ঘরে গেলেন, আমার পরিচয় দিয়ে জানালেন যে আমি এক জন শিক্ষক পদপ্রার্থী। সেক্রেটারি আমার যাবতীয় খবর সহ কোথায় কোন স্কুলে এবং কী কী বিষয় পড়াই তা জেনে নিলেন। খানিক ভেবে বললেন, তা হলে আর এখানে দু-চার দিনের জন্য পড়িয়ে লাভ নেই। আপনি দশ দিনের মধ্যেই আপনার গ্রামের স্কুলে পড়াবেন, এবং সেটা হবে ভারতেরই মধ্যে। মামা আর আমি তো শুনে তাজ্জব! তিনি তখন বললেন, এ সব এক্ষুনি জানাজানি করবেন না, আমরা সব ইন্টারনাল খবর জানি। পরে জানলাম, তিনি স্বয়ং জেনারেল জে এন চৌধুরির দাদা।
দু’দিন পরেই রেডিয়োর খবর পাকিস্তান টিথোয়ালখন্ডে বেপরোয়া বম্বিং শুরু করেছে। পরের টার্গেট নাকি দিল্লি। পূর্ব পাকিস্তান কব্জা করতে পূর্বখন্ডে যে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল তা রাতারাতি সরিয়ে নেওয়া হল পশ্চিম রণাঙ্গনে। পঞ্জাব-হরিয়ানা তথা দিল্লি রক্ষা করা অনেক জরুরি। যুদ্ধে দু’দেশের বর্ডার সিল করা, চিঠিপত্র বন্ধ। বাড়ির সঙ্গে আবারও যোগাযোগ নেই। মামা আমাকে দুটো টিউশনি ঠিক করে দিলেন।
তখন মিনার্ভা থিয়েটারে উত্পল দত্তের ‘কল্লোল’ নাটকের একশো রজনী অতিক্রান্ত। আমি এক দিন সেখানে হাজির হলাম। তখন সন্ধের শো শুরু হয়ে গেছে, রাতের শোয়েরও টিকিট নেই। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম, যাঁরা অগ্রিম টিকিট কেটেও রাতের শো দেখবেন না, তাঁদের কারও কাছ থেকে যদি একটা টিকিট মেলে। তাতেও হল না। অগত্যা ব্যালকনির গেটে যিনি টিকিট চেক করেন তাঁকে ধরলাম। তিনিও বললেন একদম হাউসফুল, কিচ্ছু করার নেই। আমি বললাম, পূর্ব পাকিস্তান থেকে এসে এই যুদ্ধে আটকা পড়ে গেছি দাদা। ঢাকার একটা পত্রিকায় সাংবাদিকতা করি। নাটকটা দেখব বলে খুব আশা নিয়ে এসেছিলাম, যদি একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। গেট-এর বাইরে চেয়ারে এক ভদ্রলোক বসে ছিলেন। আমার কথা শুনে বললেন, আমার সঙ্গে আসুন। আমাকে নিয়ে নীচে নামলেন। দরজা দিয়ে ঢুকে স্টেজের সামনে কোনার দিকে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। নাটক তত ক্ষণে শুরু হয়ে গেছে।
তখন উত্পল দত্ত জেল-এ। কংগ্রেসকে কটাক্ষ করে নাটক লিখেছেন বলে কংগ্রেস সরকার তাঁকে জেলে পুরে দিয়েছেন। ভেবেই পেলাম না, নাটকের শো সেন্সর বা বন্ধ হল না, অথচ অভিনেতা কারাবন্দি! নাটক দেখার মাঝে এক জন লোক এসে আমার হাতে একটা মিষ্টির প্যাকেট ধরিয়ে দিল। আমি তো অবাক! বিনা-টিকিটের দর্শককে এমন আপ্যায়ন! তার পরই বুঝলাম, প্রেস-এর লোকদের জন্য নির্দিষ্ট সিটে আমাকে বসানো হয়েছে।
বিপদে পড়লাম হল থেকে বেরিয়ে। যুদ্ধের সময় বলে ব্ল্যাক-আউট, তাই রাস্তায় কোনও আলো নেই। অত রাতে রাস্তায় ট্রামবাসও নেই। একটু পর শিয়ালদার একটা বাস আসতে সব লোক তাতেই হুড়মুড় করে উঠছে দেখে আমিও উঠে পড়লাম। স্টেশনে পৌঁছে একটা খবরকাগজের স্টল থেকে ওই দিনের একটা বাসি কাগজ কিনে সেটাই বিছিয়ে শুয়ে পড়লাম। পর দিন ভোরে বাড়ি ফিরতে মামা বললেন, রাতে রাস্তাঘাটে আলো থাকে না, তুমি এ শহরে নতুন, কিছু চেনো না, রাতে বাড়ি না ফিরলে বাড়ির লোকের মনের অবস্থা কী হয় তা বোঝার বয়স তোমার নিশ্চয়ই হয়েছে। ঠিক সময় বাড়িতে ফেরার কথাটাও মুখে বলে দিতে হবে?
বললাম সব। সে দিন রাতে খাওয়ার সময় মামা বললেন, এত বছর কলকাতায় আছি, মিনার্ভা থিয়েটার চিনলাম না। আর এখন উত্পল দত্তের নাটক পাঁচ দিন আগেই হাউসফুল হয়ে যায়। তাতে তুমি সেই নাটক দেখতে গিয়ে নিজেই বেশ একটা নাটক করে ফেললে দেখছি! তবে দেখো, আর রিপিট কোরো না।
ষাটের দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে? লিখুন এই ঠিকানায়:
হ্যালো 60s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১।
বা, লেখা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in