অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী
আমার প্রথম ‘মিঠুন চক্রবর্তীর ছবি’ দেখার ঘটনাটা মনে আছে। সাল-তারিখের হিসেব করলে সেটা আশি নয়, সত্তরের দশক। তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি। এক্কেবারে ফিল্মের পোকা ছিলাম। মানে, বাংলা আর হিন্দি ছবির পোকা। ইংরেজি ছবির সঙ্গে কোনও সম্পর্ক ছিল না। মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলে, পশ্চিম পুটিয়ারি থেকে বরানগরে মামাবাড়ি যাতায়াত বলতে এই। বরানগরে আমার বড়মামিমাকে সঙ্গে নিয়ে চলত আমার সিনেমা-অভিযান। তখনকার দিনের মামা-মামি, জ্যাঠারা তো অন্য রকম মানুষ ছিলেন। মনে আছে, জ্যাঠামশাইয়ের জলদগম্ভীর গলায় ‘কে যায়?’ শুনে হিসি করে ফেলেছিলাম ভয়ে। তবু, ওঁরা আশ্রয় ও প্রশ্রয়, দুই-ই দিতেন। আমার সেই মামিমাকে ঢাল করে আমি গেছি বরানগরের অনন্যা সিনেমা হলে, ‘দো আনজানে’ দেখতে। সেই প্রথম পরদায় মিঠুন চক্রবর্তীকে দেখা।
দেখি, পাড়ার একটা চ্যাংড়া রকবাজ মতো ছেলে, অমিতাভ বচ্চন, রেখা, প্রেম চোপড়ার পাশে, ছোট্ট একটা রোলে। পরে সে-ই নায়ক হল ‘ডিসকো ড্যান্সার’ ছবিতে। এই ছবিটা আমি অন্তত এগারো বার দেখেছি। আর কী রকম ভাবে দেখেছি, সেটাও বলবার মতো। তখন আমি সাউথ পয়েন্টে পড়ি, শনিবারে ট্যুইশন পড়তে যাই দেশপ্রিয় পার্কের মোড়ে সোমেশ স্যরের বাড়ি। যাওয়ার পথে ম্যাটিনি শো-য় আগে হাফ ছবি দেখে নিলাম। পর দিন তো রোববার, আবার পড়া। পড়েটড়ে ফেরার পথে ইভনিং শো-য় বাকিটুকু দেখে বাড়ি ফিরলাম। মিঠুন মানেই তখন নাচ-গান, টোটাল এন্টারটেনমেন্ট প্যাকেজ। তখন সিনেমা বলতে বুঝতাম জমাটি একটা গল্প, সিনেম্যাটিক ভ্যালুটা ঠিক কী, অতশত বুঝতাম না। আর একটা দুর্দান্ত ছবি বহু বার দেখেছি। ‘সুরক্ষা’। সেখানে মিঠুন সিবিআই অফিসার, ‘গানমাস্টার জি নাইন’-এর ছদ্মবেশে এসএসও’র শয়তান সন্ত্রাসবাদীদের শায়েস্তা করেন। দুর্দান্ত স্টান্ট, ফাইট, কার চেজিং ছিল, আবার রোম্যান্সও। বাপ্পি লাহিড়ির সুরে ও গলায় হিট গান ছিল কয়েকটা। মিঠুনকে দেখে আমি তো মন্ত্রমুগ্ধ! বাড়ির সামনে একটা ছোট্ট সেলুন ছিল, সেখানে গিয়ে বললাম, মিঠুনের মতো চুল কেটে দাও। কানের ওপর এলোমেলো এসে পড়া চুল। আমার ছোটবেলা থেকেই একটা বদভ্যেস ছিল, মাথার চুলগুলো ধরে খুব টানতাম, মাথার ওপরটা তাই ফাঁকা হয়ে গেছিল। আমার মিঠুন হেয়ার-কাট দেখে এক বন্ধু কবিতাই লিখে ফেলল: ভগবানের এ কী ভুল/ টোনির ওপর ফাঁকা, কানে চুল। এই ‘কানে চুল’টার প্রেরণা মিঠুন চক্রবর্তীই। দু’তিন দিন সেই কাট ছিল, তার পর আওয়াজের চোটে ছেঁটে ফেললাম।
বব্বর সুভাষ নির্দেশিত ১৯৮২ সালের ছবি ডিসকো ড্যান্সার-এ মিঠুন।
ছবি, গান, নাচ, অ্যাকশন, মায় মিঠুনের পোশাক সব কিছুই সুপারহিট হয়েছিল।
সব ছবিগুলোর নাম মনে নেই, কিন্তু নাচগুলো সব মনে আছে। বিশেষ করে ডিসকো ড্যান্সার-এর। নাচের মুভমেন্টে মিঠুনের বডি রিদ্ম হাঁ করে গিলতাম। আমার তখন সিনেমা হলে ঢোকার বয়স না, সেই আমি মিঠুনের নাচ, রোম্যান্স দেখছি, ওঁর অ্যাকশন স্টান্টগুলো পুরে নিচ্ছি নিজের ভেতর। আমার বাড়িতে বাবার গুরুদেব আসতেন মাঝেমধ্যে, সঙ্গে ওঁর ক’জন চ্যালা, তারাও ব্রহ্মচারী। তো তাদেরকে পর্যন্ত সঙ্গে নিয়ে আমি ছবি দেখতে ঢুকে পড়েছি নবীনা, প্রিয়া, রূপালি-তে। ওরা বলত, বাবু, আপ মারপিট অউর লভ দেখ রহা হ্যায়? আমি বলতাম, তুম ভি দেখো, মজা আয়েগা। মিঠুনের ফাইট, ডান্স, রোম্যান্স ঘিরেই গড়ে উঠেছিল আমাদের সেই সময়। একটা অদ্ভুত সরলতা ছিল মিঠুনের মুখে, যেন ঘরের পাশের ছেলেটাই অনেক স্ট্রাগ্ল করে ওই হিরোর জায়গাটায় পৌঁছেছে। আমরা বলতাম, মিঠা মিঠুন।
মিঠুনের কোনও একটা ছবিতে দেখতে গিয়ে সিগারেট খাচ্ছি, আমার এক টিচার দেখে ফেলেছিলেন। মজা হয়েছিল ওঁর ‘হম পাঁচ’ ছবিটা দেখতে গিয়েও। ‘মহাভারতের পঞ্চপাণ্ডব-টান্ডবের ওপর বানানো ছবি, মডার্ন মহাভারত’, এই সব বলে পটিয়েপাটিয়ে চলে গেছি। একটা গানও ছিল ‘হম পাঁচ পাণ্ডব...’, চিত্রহারে দেখে নিয়েছি তার আগে। সেই চ্যালাদের বেশ রেলা নিয়ে বললাম, মডার্ন মহাভারত হ্যায়। আপলোগ পূজা করতে হ্যায়, চলিয়ে অব হল মে হি পূজা করেঙ্গে। তারা তো ছবি দেখে বলছে, আপ কেয়া ইয়ে লভ দিখানে কে লিয়ে আয়া?
আর এক বারের ঘটনা। ক্লাস এইট-নাইনে পড়ি। তখন আমার এক নতুন বান্ধবী হয়েছে। সন্ধেবেলা বিবেকানন্দ পার্কের ওখানটা দিয়ে আসছি দুজনে, সেই সোমেশ স্যরের বাড়ি পড়তে যাব। তখন ‘গানমাস্টার জি নাইন’ কলকাতা কাঁপাচ্ছে, বাড়িতে মিঠুনের ওই দুলুনি নাচটা হেব্বি প্র্যাকটিস করছি। রক্তটক্ত গরম। বাবার থেকে চেয়ে স্কুলে স্টুডেন্ট কনসেশনে ষাট না আশি টাকা দিয়ে একটা ঘড়ি কিনেছিলাম, ফেভ্র লুবা ব্র্যান্ড। সেটা হাতে পরা। হঠাত্ তিন-চারটে ছেলে আমায় ঘিরে ধরল। এক জন হাতের ঘড়িটা ধরে এমন টানল, হাতটা কেটে গেল। আমার হঠাত্ কী মনে হল, গানমাস্টার স্টাইলে ওই ছেলেটাকে কষে একটা কিক ঝাড়লাম। ছেলেটা ছিটকে রেলিংয়ের গায়ে গিয়ে পড়ল, বাকিরা দুদ্দাড় পালাল। এটা কিন্তু পুরোপুরি মিঠুনের ‘অ্যাংরি ইয়াং ম্যান’ প্রভাব, নইলে ওই ডেসপারেশন, অত সাহস হতো না।
মিঠুনের আর একটা ছবি ‘শওকিন’ নিয়ে আর এক গল্প। আমার জন্ডিস হওয়ার জন্য সাউথ পয়েন্টে একটা বছর আমি রিপিট করেছিলাম। আগের বছরের বন্ধুরা সব আসত। যখন আসত, আমি গিয়ে টিচারকে বলতাম, স্যর আয়্যাম হ্যাভিং আ ভমিটিং টেনডেন্সি, ওয়ান্ট টু গো হোম। বাইরে যেতাম, শার্টটা পালটেই সোজা ছবি দেখতে হল-এ। ও রকম ভাবেই ওই ছবিটা দেখা। তিন বুড়ো, একটি মেয়ে। সেই মেয়ের বয়ফ্রেন্ডের রোলে মিঠুন। আমি যখন বন্ধুদের সঙ্গে গোয়া বেড়াতে গেছি, হোটেলের সুইমিং পুলে ভিড়। দারুণ সুন্দরী সব টু-পিস পরা মেয়ে সাঁতার কাটছে। আমি ভাল সাঁতার কাটতে পারতাম, কিন্তু চশমা পরতাম বলে জলে নামতাম না, দেখতে পেতাম না কিছু। বন্ধুরা যখন সব্বাই নীচে, আমি দোতলায় ‘ব্যাম্বু হোটেল’-এর ঘরে। ওখান থেকে বাইনোকুলার-চোখে পুলে জলকেলি দেখছি। এটাও ওই ‘শওকিন’ দেখেই শেখা। পরে ‘অগ্নিপথ’ দেখেছি বহু বার, যদিও ১৯৯০-য়ে, দারুণ অ্যাক্টিং মেটেরিয়াল। তখন তো মিঠুন অমিতাভ বচ্চনের থেকেও সুপারহিট নায়ক!
যখন লন্ডনে ‘অনুরণন’-এর শুটিং করছি, মিঠুন চক্রবর্তী সেট-এ এসেছিলেন এক দিন। আমাদের ছেলেবেলায় তো আর নায়কদের এত কাছে পাওয়া যেত না। সেই প্রথম দেখায় বুঝলাম, ছোটবেলার স্টার-এর প্রতি আমার উন্মাদনা একই আছে, বিন্দুমাত্র কমেনি।
aroychowdhury@gmail.com
মিঠুনের আরও কিছু দুর্লভ ছবি দেখতে, অ্যাপ্ল অ্যাপ স্টোর (আই ফোন) অথবা
গুগ্ল প্লে স্টোর (অ্যান্ড্রয়েড) থেকে ABP AR App-টি ডাউনলোড করে এই ছবিটি স্ক্যান করুন।
আশির দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে?
লিখুন এই ঠিকানায়: হ্যালো 80s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। বা, লেখা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy