Advertisement
E-Paper

হ্যালো 90’s

’৮৩-র একদম শুরুতেই মা টের পেলেন তিনি দ্বিতীয় বার গর্ভধারণ করেছেন। অর্থাৎ কিনা আমি আসছি। সে খবরটা তিনি আমার বাবাকে দিলেন। বাবা আবার রাতে খেতে খেতে সে খবরটা ঠাকুরদাকে মৃদু স্বরে জানালেন। ঠাকুরদার খবরটা শুনে কী হয়েছিল জানা নেই। কিন্তু মাঝরাতে উনি বারচারেক ‘আমার নকুলদানা, আমার নকুলদানা’ বলে স্থির হয়ে যান। ডাক্তার ওঁকে দেখে বললেন, ‘সেরিব্রাল! নো নড়াচড়া।’

অরুণোদয়

শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০১৪ ০০:০৮

’৮৩-র একদম শুরুতেই মা টের পেলেন তিনি দ্বিতীয় বার গর্ভধারণ করেছেন। অর্থাৎ কিনা আমি আসছি। সে খবরটা তিনি আমার বাবাকে দিলেন। বাবা আবার রাতে খেতে খেতে সে খবরটা ঠাকুরদাকে মৃদু স্বরে জানালেন। ঠাকুরদার খবরটা শুনে কী হয়েছিল জানা নেই। কিন্তু মাঝরাতে উনি বারচারেক ‘আমার নকুলদানা, আমার নকুলদানা’ বলে স্থির হয়ে যান। ডাক্তার ওঁকে দেখে বললেন, ‘সেরিব্রাল! নো নড়াচড়া।’ কিন্তু ঠাকুরদার এই সেরিব্রালের ফলে আমাদের বিজয়গড়ের বাড়িতে ঢুকল এমন দুটো জিনিস, যা তখন আমাদের কলোনিতে প্রায় বিরলতম। একটি ‘ভারত ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট টিভি’ এবং একটি কমোড। টিভি ঢুকল ঠাকুরদার শয্যাযাপন সহনীয় করে তুলতে। আর কমোড, ঠাকুরদার যাতে লোড ক্লিয়ার করতে লোড না পড়ে, সেই জন্যে। এ দুটোই আশৈশব আমার খুব অহংকারের জিনিস হলেও বাবার কাছে গাঁট্টা খেয়ে বুঝেছিলাম অতিথিদের জোর করে কমোড না দেখানোই ভাল। অগত্যা টিভিই ছিল আমার একমাত্র অহংকারের জিনিস, যা সবাইকে দেখানো যেত।

আমাদের ছোটবেলায় চ্যানেল ছিল মূলত একটা। ডি ডি টু বলে যেটি ছিল, সন্ধে সাড়ে সাতটায় বন্ধ হয়ে যেত। ’৯০-এ আর্জেন্টিনা-বেলজিয়াম ম্যাচের দিন প্রচণ্ড বৃষ্টি পড়ছিল। হঠাৎ একটা বাজ পড়ে টিভিটার পিকচার টিউব পুড়িয়ে টিভিটাকে শিবনেত্র করে দিল। খেলাটা দেখবার জন্য ওই বৃষ্টিতে বাবা আমাদের নিয়ে পিসির বাড়ি চলে গেলেন। সেই সময় খেলা দেখার একটা মজা ছিল, সাদা টিম বনাম কালো টিম, এ ভাবে চিনে নিতে হত নিজের পছন্দের টিমকে। মনে আছে, দূরদর্শন কেন্দ্রর সামনে পঙ্কজ সাহা আর চৈতালী দাশগুপ্তকে দেখে আমার অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার জোগাড়। নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণাও বসে বসে গিলতাম। যে দিন রাজীব গাঁধী মারা গেলেন, বাবা সন্ধেবেলা চা খেতে খেতে বললেন, ‘আজকের খবরটা তরুণবাবু পড়লে ভাল হয়, ওঁর গলায় বিষাদটা খেলে ভাল।’ এবং কী আশ্চর্য, উনিই পড়েছিলেন খবরটা!

হে এ যুগের পাঠক, যদি এই ঘটনাবলি তোমাকে বিস্মিত করে থাকে, তবে আমি নিশ্চিত, তুমি ’৯০-এর দশকে বড় হওনি। তুমি নিশ্চিত ভাবে জনি সোকো-র উড়ন্ত রোবটকে দেখোনি এবং অবশ্যই মহাভারতের সময় বাড়িতে লোকের ভিড়ও নির্ঘাত তোমার জন্মপূর্ব ঘটনা। আপনাদের হেনরি ব্লোফেল্ড-এর কমেন্ট্রি মনে পড়ে? আনন্দের আর এক নাম তখন ছিল ‘চিত্রহার’। সিরিয়ালও ছিল দুর্দান্ত সব। তখনও টিভি মেগাগ্রস্ত হয়নি। সবই সাপ্তাহিক। ব্যোমকেশ-রূপী রজিত কপূর পরের সপ্তাহে কাকে খুনি সাব্যস্ত করেন, এই ভাবনায় হোমওয়ার্ক লাটে। এই ভাবে সুখে, দুঃখে, জীবিকা সমাচারে কাটছিল জীবন। এমন সময় স্কুলের বন্ধু বরুণ ঘোষণা করল, ‘আমরা কেবিল নিয়েছি!’

টেবিল শুনেছি, কেবিল? সে আবার কী? ওর কাছে যা শুনলাম, গা ছমছম করে উঠল। ওতে নাকি অনেকগুলো চ্যানেল, অনেক সিনেমা, দিনভর খেলাধুলো। ও নাকি এক দিনে মিঠুনের ‘ডান্স ডান্স’, অমিতাভের ‘কালিয়া’ আর সুখেন দাসের ‘প্রতিশোধ’ দেখেছে। তার পর একটা ভূতের ছবিও জমিয়ে দেখছিল, নায়িকা বাথরুমে ঢুকতেই বাবা ওকে শুতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। শুনে তো মাথা ঘুরতে শুরু করল। উঠতে বসতে, লোডশেডিঙে, খালি কেবিল, মানে কেব্ল টিভির কথা ভাবি। মা’র কাছে গিয়ে খোনা গলায় কাঁদি। এ দিকে তো দাদার তখন ক্লাস নাইন। সে-ও তখন খবর পাচ্ছে পাশের বেঞ্চের বন্ধু সদ্য রিলিজ-করা ‘বাজিগর’ দেখে ফেলেছে। দাদা মিনমিন করে বাবার কাছে কোনও রকমে বলেছিল বাবা, ইয়ে, মানে কেব্লটা কিন্তু খুব ভাল একটা ইয়ে...। বাবা ঝাড়া আধ ঘণ্টা পেঙ্গুইনরা কেন মোনোগেমাস, ইথিওপিয়ার কফি চাষিদের দুর্দশা কতটা, এ সব থেকে শুরু করে পটলের দোলমায় ভেটকি মাছের পুর সংক্রান্ত অনেক কিছু এমন বললেন যার এক এবং একমাত্র অর্থ, উনি কেব্ল নেবেন না। আমি বন্ধুর কাছ থেকে শেখা ‘ডিসকভারি খুব ভাল’ টাইপের জ্ঞানের কথা আওড়াতে গিয়ে তীব্র পেটানি খেয়ে গেলাম। বাবা ভাবলেন, আমি বাড়িতে ডিস্কো নাচব বলেছি।

এত বিপত্তি সত্ত্বেও আমার মা, বাবাকে কেব্ল নেওয়ার ব্যাপারে রাজি প্রায় করিয়েই ফেলেছিলেন। কিন্তু এ বার বাদ সাধল আমার পিসতুতো দিদি। ওদের বাড়িতে কেব্ল নেওয়ার সাত দিনের মাথায় টিভিতে একটা সিনেমায় পদ্মিনী কোলাপুরি আদিত্য পাঞ্চোলির সঙ্গে পালাল। পর দিন কোলাপুরি পায়ে দিয়ে আমার দিদি পদ্মিনী হলেন পাড়ার লাট্টুদার সঙ্গে। ব্যস, বাড়ি ফিরে বাবা থেকে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন আর বলেন ‘কেব্লটাই সর্বনাশ করে দিল।’ আমার বুকভরা আশা ধক করে গেল নিভে। সুখেন দাসের রেট্রোস্পেকটিভ মিস করে গেলাম। বাড়ির টিভিটারও পড়ন্ত জমিদারদের মতো অবস্থা। আগের সেই দিন আর নেই। বাড়িতে বাড়িতে কালার টিভি চলে এসেছে, কেব্লও। এখন উলটে আমরা যাই অন্যের বাড়িতে খেলা দেখতে। টিভিটার স্বাস্থ্যও ভেঙে আসছিল। চ্যানেল চেঞ্জ করতে হত সাঁড়াশি দিয়ে। বাঁ দিকের কাঁপুনি সারানো হয় তো ডান দিক নাচতে থাকে।

বাবার প্রতিজ্ঞার ভিত নাড়িয়ে দিল ’৯৬-এর লর্ডস। ইয়েস, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় যে দিন প্রথম বার আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে ব্যাট তুললেন। বাবা বাড়িতে ফিরে দাদাকে ডাকলেন। ওদের কথোপকথন কিছুটা এ রকম ছিল:

বাবা: বুম্বা, তোমার তো সামনে উচ্চ মাধ্যমিক।

দাদা: হ্যাঁ বাবা।

বাবা: সৌরভটা, ইংল্যান্ডে...

দাদা: হ্যাঁ বাবা, আমিও সুদীপ্তর বাড়িতে হাইলাইট্স দেখলাম।

বাবা: কিন্তু ভাবছি, কেব্ল নিলে তোমার পড়াশুনো...

দাদা: সামনের সপ্তাহে টেন্টব্রিজে আর একটা টেস্ট।

বাবা: বুলানকে কেব্লটা লাগিয়ে দিতে বলো।

এই কেব্ল চ্যানেলের হাত ধরেই আমি চিনেছিলাম আমার সব থেকে কাছের বন্ধুকে। টিভি সিক্স মক্বা। আসলে মস্কোকেই ওরা মশকরা করে মক্বা লিখত। শুক্র-শনি রাতে কী ভাল বিচিত্রানুষ্ঠানই না করত চ্যানেলটা। আহা, আজও চোখে ভাসে। এবং এই অনুষ্ঠানের সূত্র ধরেই এসেছিল আমার বয়ঃসন্ধির একান্ত গোপন সেই বন্ধুটি। সে এতই আপন, এতই গোপন যে তাকে নিয়ে বিশদ আলোচনায় ঈষৎ কুণ্ঠা বোধ করছি। হে পাঠক, যারা টিভি সিক্স মক্বা-র অনুষ্ঠান দেখোনি তারা নিজেকে ‘আমি তো সিস্টিন চ্যাপেলও সামনে থেকে দেখিনি’ গোছের সান্ত্বনা দিয়ে ক্ষান্ত হও। আর যারা দেখেছ, তাদের উদ্দেশে বলি

বন্ধু তোমার পথের সাথীকে চিনে নিও

মনের মাঝেতে চির দিন তাকে ডেকে নিও

ভুলো না তারে ডেকে নিতে তুমি...

rahuloday@gmail.com

নব্বইয়ের দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে?

লিখুন এই ঠিকানায়:

হ্যালো 90s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। বা, লেখা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy