Advertisement
E-Paper

হ্যালো 90's

শ্রীকান্ত আচার্য

শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ২২:২৮
বছর চোদ্দো আগে ঘরোয়া গানের এক আড্ডায় রিমেক-এর দুই মহারথী: ইন্দ্রনীল সেন ও শ্রীকান্ত আচার্য।

বছর চোদ্দো আগে ঘরোয়া গানের এক আড্ডায় রিমেক-এর দুই মহারথী: ইন্দ্রনীল সেন ও শ্রীকান্ত আচার্য।

রিমেক আগেও হয়েছে। সত্তরের দশকে অনুপ ঘোষাল রুমা গুহঠাকুরতার গান রিমেক করেছিলেন। ‘এমনই বরষা ছিল সে দিন’, ‘আমার আঁধার ঘরের প্রদীপ’ অনেকেই রেকর্ড করেছেন। কিন্তু এ সবই গুটিকয় উদাহরণ। অ্যালবামের পর অ্যালবাম বেরোচ্ছে, সব রিমেক-এর, এই ঘটনার সাক্ষী নব্বইয়ের দশকই। আসলে, পঞ্চাশ থেকে আশির দশক অবধি আধুনিক বাংলা গানের একটা বিশেষ ঘরানা ছিল। কয়েক জন শিল্পী, গীতিকার ও সুরকার মিলে সে ঘরানা তৈরি করেছিলেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, আরতি মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় এঁরা একই সঙ্গে ছবির গান ও বেসিক গান, এই দুইকেই হিট করাতেন। গানের কথা লিখতেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, শ্যামল গুপ্ত, এঁরা। মুম্বই থেকে গাইতেন লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে। আশির দশকে একটা বদল এল। সুর-গান-গায়কির গ্রাফ, কাজের মান, বাণিজ্যিক বাংলা ছবির মান একটু নিম্নমুখী হল। বদলাল প্রযুক্তিও, অ্যাদ্দিন ছিল রেকর্ড, এ বার এল অডিয়ো ক্যাসেট। আগে রেকর্ড কোম্পানি ছিল হাতে গোনা, এখন বাজারে এল বহু ক্যাসেট কোম্পানি। অনেক ক্যাসেট মানেই অনেক গানও, তাই দরকার পড়ল প্রচুর শিল্পীরও। কিন্তু তিন দশক ধরে রেকর্ড-কাঁপানো শিল্পীদের তখন বয়স হয়েছে, সেই কণ্ঠমাধুর্য আর নেই, অনেকে প্রয়াতও। তাই দরকার পড়ল প্রচুর নতুন গানের। প্রতি বছর ধারাবাহিক ভাবে নতুন ও ভাল গানের জোগান তো চাট্টিখানি কথা নয়। পালটে যাওয়া এই পরিস্থিতির সঙ্গে যুঝবার দারুণ অস্ত্রই ছিল রিমেক। কোম্পানিগুলো দেখল, পুরনো যে সব গান মানুষের মন ছেয়ে আছে, সেগুলো নব্বইয়ের দশকেও ভীষণ টাটকা, মানুষ সেগুলোর হ্যাংওভার কাটাতে পারছেন না। আবার, ক্যাসেটের সাউন্ড কোয়ালিটিও রেকর্ডের তুলনায় বহু গুণ ভাল। সাউন্ডের এই স্মার্টনেসও রিমেককে অনেকটা এগিয়ে দিয়েছিল। পঞ্চাশের দশকের গীতা দত্তের গাওয়া একটা গান হয়তো ক্যাসেটে শ্রীরাধার গলায় আরও ভাল লাগছে। রিমেক রাতারাতি হিট হয়ে গেল।
এই সময়ই অ্যাটলান্টিস কোম্পানি নিয়ে আসে ইন্দ্রনীল সেন-এর ‘দূরের বলাকা’ অ্যালবাম সিরিজ। সুপার ডুপার হিট। আর কোনও শিল্পী রিমেককে ওঁর থেকে বেশি জনপ্রিয় করতে পারেননি। তত দিনে সুমনদা আর নচিকেতা এসে গেছেন, ওঁদের নিজস্ব, অসাধারণ সব কম্পোজিশন দিয়ে ওঁদের শ্রোতা তৈরি করে ফেলেছেন। মানুষ কমবেশি ভাললাগা-মন্দলাগা নিয়ে সবই শুনছেন, ইন্দ্রনীলের রিমেকও, সুমন-নচিকেতাও। কলকাতায় একটা অনুষ্ঠানে গান শুনতে গেছি, প্রথমে সুমনদা, পরে ইন্দ্রনীলের গান। সুমনদা কাঁপিয়ে দিলেন, আবার ইন্দ্রনীলের ভরাট গলায় ‘পিয়ালশাখার ফাঁকে’, অথবা ‘এই সুন্দর স্বর্ণালি সন্ধ্যায়’ শুনেও শ্রোতারা বুঁদ।
আমি তখন উত্তরবঙ্গে, ভরপুর চাকরি-জীবন, ছ’সাত বছর গান-জগৎ থেকে দূরে। নিজের হারমোনিয়ামটা পর্যন্ত এক বন্ধুকে দিয়ে দিয়েছি, পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে বলে। ১৯৯৫-এর পুজোর পর চাকরি ছেড়ে দিলাম। ভীষণ ভাবে গানে ফিরতে চাইছিলাম। ’৯৬-এর শুরুতে যোগাযোগ হল সাগরিকা মিউজিক কোম্পানির সঙ্গে। আমি একটা ডেমো ক্যাসেট দিয়েছিলাম ওঁদের, সেখানে মান্না দে, শ্যামল মিত্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান ছিল, রবীন্দ্রসংগীতও ছিল। ওঁরা জানালেন, আমার দুটো অ্যালবাম ওঁরা করতে চান, একটা রবীন্দ্রনাথের গানের, একটা রিমেক-এর। আমি তো রীতিমত চমকিত। ’৯৬-এর পুজোর আগে বাজারে এল আমার রিমেক অ্যালবাম ‘মনের জানালা’। আমি তো ধরেই নিয়েছি আমার গান কেউ শুনবে না। তাই কাউকে কিচ্ছু বলিওনি। কিন্তু অ্যালবামটা সুপারহিট হল। পুজোর পরই কোম্পানি আমাকে বলল, দাদা, পরের অ্যালবামের চিন্তাভাবনা শুরু করে দিন। আমি ভাবলাম, ও এক বার তালেগোলে হিট করে গেছে, ঝড়ে বক মরার মতো, দ্বিতীয়টা আর হবে না। পরের বছর ‘নীল ধ্রুবতারা’ বেরোল, আগেরটার থেকেও হিট। ’৯৮ আর ’৯৯-এ আরও দুটো অ্যালবাম বেরোল। কিন্তু তার পর আমি ভাবলাম, রিমেক একটা চলতি ট্রেন্ড, শ্রোতারা শুনছেন কারণ গানগুলো তাঁদের খুব প্রিয়, তাঁরা একটা ফ্রেশ ভয়েসে সেগুলো শুনে আনন্দ পাচ্ছেন। এই হিটের পিছনে আমার কৃতিত্বের কিছু নেই। একেবারে নতুন, মৌলিক গান গেয়ে মানুষকে আনন্দ দিতে পারাটা ঢের বেশি চ্যালেঞ্জিং, কৃতিত্বেরও। তাই মন দিলাম একেবারে আমার নিজস্ব গান গাওয়ার দিকে। সেই ভাবনা থেকেই ২০০০ সালের অ্যালবাম ‘বৃষ্টি তোমাকে দিলাম’।
রিমেক-এর ভাল-মন্দ দুটো দিকই আছে। পুরনো সুপারহিট গানের পাশাপাশি অনেক হারিয়ে-যাওয়া, স্বল্পশ্রুত গান প্রচারের আলোয় এসেছে রিমেক-এর দৌলতেই। কোয়ালিটি আর পপুলারিটি সব সময় হাত-ধরাধরি করে চলে না। এ রকম বহু ‘ভাল’ গান রিমেক তুলে এনে হিট করিয়েছে, যেগুলো আগে জনপ্রিয় হয়নি, মানুষ বেশি শোনেনইনি। ষাট কি সত্তরের দশকে তো গান শোনার অত মাধ্যম ছিল না। নব্বইয়ের দশকে ঘরে ঘরে ক্যাসেটপ্লেয়ার, তখন পুরনো গান রিমেক হয়ে আক্ষরিক অর্থে লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছেছে। রিমেক যেমন অসাধারণ সব গানকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছে, তেমনই তৈরি করেছে গান শোনার কান, সমঝদার শ্রোতা।
আর খারাপ দিক: নস্ট্যালজিয়া একটা ভয়ংকর বাজে জিনিস। নতুন যা কিছুর সামনেই একটা দেওয়াল তুলে দেয়। বাঙালি তো নস্ট্যালজিয়ার বালিশে মাথা দিয়েই জীবন কাটিয়ে দিতে পারলে বাঁচে। রিমেক-এ অভ্যস্ত হয়ে গেলে, ফি-বছর সেই একই পুরনো গান শুনতে থাকলে নতুন সামনে এসে দাঁড়াবে কী করে? রিমেক-এর গাজর সামনে ঝুলিয়ে কোম্পানিগুলো অসম্ভব প্রতিভাধর সব গীতিকার-সুরকারদের নিরুৎসাহ করেছে। বাংলা গানের কথায়-সুরে কী পরীক্ষানিরীক্ষা হচ্ছে, বা আদৌ হচ্ছে কি না, তা তো নতুন গানেই বোঝা যাবে। অথচ রিমেক সেই পথটাকে রুদ্ধ করে দিয়ে ঘড়ির কাঁটাকে পুরো উলটো দিকে ঘুরিয়ে দিল। নতুনের প্রতি একটা ভয়ংকর অনীহা, না শুনেই নতুন একটা গানকে খারাপ বলে দেগে দেওয়াটা খুব খারাপ অভ্যেস। নতুনকে যদি তুলে আনতে না পারি, উৎসাহ দিতে না পারি, সে ব্যর্থতাও ক্ষমাহীন। রিমেক-এর দিন গিয়ে ভালই হয়েছে। নতুনের রাস্তা যে আগলে দাঁড়ায়, সে আর যা-ই হোক, ঠিক কাজ করে না।

নব্বইয়ের দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে? লিখুন এই ঠিকানায়: হ্যালো 90s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। বা, লেখা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy