Advertisement
E-Paper

হ্যালো 90’s

ঠাকুরদা ডাকটা কী রকম সেকেলে। আমি ‘দাদা’ বলেই ডাকতাম। দাদার একটা অদ্ভুত ধারণা ছিল— আমি, বাবা আর দাদা, তিন প্রজন্ম পাশাপাশি একতলার ঘরের সোফায় বসে খেলা দেখলে ইন্ডিয়া কখনও হারে না। ধারণার সূত্রপাত হিরো কাপ সেমিফাইনাল আর ফাইনাল থেকে। সেটা নভেম্বর মাস, ’৯৩ সাল, সবে বাড়িতে কালার টিভি এসেছে, কেব্ল কানেকশন সহ। ভোর রাতে শেন ওয়ার্ন নামক অত্যাশ্চর্য মানুষটা টিভির পরদায়, তো মাঝরাতে ততোধিক সুন্দর ব্রায়ান লারা।

অরিজিৎ সেন

শেষ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
১৯৯৪। সচিন তেন্ডুলকর ও ব্রায়ান লারা, ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে। দুজনে মিলে লিখেছিলেন নব্বইয়ের ক্রিকেট-রূপকথা।

১৯৯৪। সচিন তেন্ডুলকর ও ব্রায়ান লারা, ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে। দুজনে মিলে লিখেছিলেন নব্বইয়ের ক্রিকেট-রূপকথা।

ঠাকুরদা ডাকটা কী রকম সেকেলে। আমি ‘দাদা’ বলেই ডাকতাম। দাদার একটা অদ্ভুত ধারণা ছিল— আমি, বাবা আর দাদা, তিন প্রজন্ম পাশাপাশি একতলার ঘরের সোফায় বসে খেলা দেখলে ইন্ডিয়া কখনও হারে না। ধারণার সূত্রপাত হিরো কাপ সেমিফাইনাল আর ফাইনাল থেকে। সেটা নভেম্বর মাস, ’৯৩ সাল, সবে বাড়িতে কালার টিভি এসেছে, কেব্ল কানেকশন সহ। ভোর রাতে শেন ওয়ার্ন নামক অত্যাশ্চর্য মানুষটা টিভির পরদায়, তো মাঝরাতে ততোধিক সুন্দর ব্রায়ান লারা। আমার পড়াশুনো ডকে উঠল আর বাবার অফিসে নিয়মিত লাল কালি। দাদার আদেশ, পাশাপাশি বসে খেলা না দেখলে ইন্ডিয়া রসাতলে যাবে।

পাশাপাশি বসে দেখলেও যে আহামরি কিছু হত তা নয়। তবে তিন প্রজন্ম একসঙ্গে খেলা দেখার একটা অদ্ভুত মজা ছিল। রাজেশ চহ্বাণকে দেখে দাদার যদি বাপু নাদকার্নির কথা মনে পড়ে, তবে জিমি অ্যাডামস-এর সঙ্গে বাবা ল্যারি গোম্স-এর তুলনা করে।

তিন জন একসঙ্গে প্রেমে পড়ে গেলাম কার্ল হুপার-এর। ’৯৪-এর হেমন্ত। ওয়েস্ট ইন্ডিজ এল দেশে। ব্রায়ান লারা গাদাগুচ্ছের রেকর্ড ভেঙে এসেছে, কিন্তু আমাদের মনে ধরে গেল হুপারকে। প্রতি ম্যাচেই হুপার রান করত আর ভারত জিতত। আর ট্র্যাজিক হিরোর যে আসনটা বাঙালির মনে পাকাপাকি ভাবে থাকে, সেই আসনে কর্ণের পাশেই বসল কার্ল হুপার। ঘন্টে বলত ‘কালো হুপার’।

ইংরেজ বোলারটির নাম ড্যারেন ‘গফ’ না ‘গঘ’ না ‘গাউ’ তা নিয়ে তর্ক হত তিন জনের মধ্যে। বাবা বলত ড্যামিয়েন ফ্লেমিং অস্ট্রেলিয়ান কিন্তু বোলিংয়ের ধরনধারণ ইংরেজদের মতন। রেডিয়োতে চলত রঞ্জি কমেন্ট্রি। দাদা মাথা নেড়ে জানাত, ‘না রে, শুধু গায়ের জোরেই যদি ক্রিকেট হত তবে বরোদার অতুল বেদাদে কবে ইন্ডিয়া টিমে পাক্কা হয়ে যেত!’ বাবা কিছুতেই আমাকে বোঝাতে পারত না, বাংলার হয়ে তিন নম্বরে ব্যাট করেন যে ভদ্রলোক, তাঁর নাম শ্রীকান্ত কল্যাণী হলেও তিনি আদৌ কল্যাণীর লোক নন।

’৯৬-এর গ্রীষ্ম অবধি এই ক্রিকেটীয় ত্রিভুজ অটুট ছিল। যেই না সৌরভ এল, বাবা আমাদের সঙ্গ ছেড়ে দিল। অন্য কারও খেলা দেখত না, অন্য কোনও বিষয়ে আলোচনা করত না। সৌরভ আউট হলে উঠে যেত। বিপক্ষ বোলার-ফিল্ডার-ক্যাপ্টেন, নিজের দলের ক্যাপ্টেন-কোচ, ধারাভাষ্যকার-কর্মকর্তা-আম্পায়ার-ম্যাচ রেফারি এরা সবাই মিলে এই সবেধন নীলমণি বাঁহাতি ব্যাটসম্যানটির কেরিয়ার শেষ করে দিতে যে কী ভয়ংকর ষড়যন্ত্রে মেতেছে, তা ভেবে বাবা শিউরে উঠত।

দাদা খ্যাপাতেও ছাড়ত না মাঝে মধ্যে। ‘যাই বলিস খোকন, সেরা বাঙালি ব্যাটসম্যান এখন আমিনুল ইসলাম বুলবুল, তাই না?’ আমি সম্মতিসূচক মাথা নাড়াতাম। আর খোকন, মানে বাবা, অসহায়ের মতো বলে উঠত, ‘ধুস, আমি চলেই যাব বাড়ি থেকে। এ ভাবে থাকা যায়? টর্চার, টর্চার। বাবা, সত্যি করে বলো তো, তোমার কাছে ভাল ব্যাটসম্যানের সংজ্ঞাটা কী?’ দাদা দুষ্টু দুষ্টু হেসে হ্যারল্ড পিন্টার-এর কবিতাটা বলত: I saw Len Hutton in his prime/ Another time/ another time. হাটন-এর সময় সোনালি ছিল বটে, তবে নব্বইকেও দাদা কম ভালবাসত না।

ত্রিভুজ থেকে বাবা বিদায় নিল। রইলাম দাদা আর আমি। দাদা আমাকে দেখাত, সঈদ আনোয়ার যখন লেট কাট করে, অবিকল জি আর বিশ্বনাথ-এর মতো দেখতে লাগে। বা দেবাশিস মোহান্তির বোলিং অ্যাকশন অনেকটা ম্যাক্স ওয়াকারের মতো।

’৯৯-এর জানুয়ারির শেষ। ভারত-পাকিস্তান খেলছে চেন্নাইয়ে। শেষ ইনিংসে ইন্ডিয়ার টার্গেট ২৭১। থার্ড ডে’র শেষে ইন্ডিয়া ২ উইকেটে ৪০। তেন্ডুলকর ২০ নট আউট। একটা শট মনে পড়ে, ওয়াকার ইউনিসকে মারা কভার ড্রাইভ। শেষ বিকেলে যখন শটটা মারছিল, দুটো পা-ই হাওয়ায়। জানি না কী ভাবে সম্ভব, কিন্তু নিজের চোখে দেখা। আর মনে আছে, বিকেলের দিকে কয়েক মিনিটের জন্য চেন্নাইয়ের সূর্য ব্যাটসম্যানের চোখের ওপর পড়ত। সেই কয়েক মিনিট খেলা বন্ধ রাখা হত। সে দিন, তেন্ডুলকরের রোদে উদ্ভাসিত মুখটা দেখেছিলাম। ওই খেলাটা টিভিতে প্রায়ই দেখানো হয় এখনও। তবে ওই রোদেলা মুখটা হাইলাইট্স থেকে বাদ পড়েছে।

পর দিন, ৩১ জানুয়ারি। সকাল থেকে উইকেট পড়ছে হু হু করে। সৌরভ যখন আউট হল, ইন্ডিয়া ৫ উইকেটে ৮২। দাদা তখন বেশ অশক্ত। টানা বসে খেলা দেখতে পারে না। দুপুরে খেয়ে উঠে আমায় জিজ্ঞেস করল, সচিন আছে? আমি বললাম, কখন আউট! বললাম, যাতে নজর না লাগে। এক জন মানুষ ক’বার মরতে পারে!

দাদা বিছানায় শুয়ে ছটফট করছিল, বুঝিনি কখন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। ‘তুই যে বললি আউট!’ আবার আমরা পাশাপাশি বসলাম। আমি, দাদা। বাবা-ও। সেই ’৯৩-এর মতো। সচিনও খেলল। কেমন খেলল সে বর্ণনা আমি করব না। পারব না।

এক মাস পরই আমার মাধ্যমিক। এর মধ্যে ওই সময়টা, মানে ওই যেটুকু সময় সচিন ছিল উইকেটে, সময়টা থেমে গেছিল হঠাৎ। দুশ্চিন্তা-আশঙ্কা-হতাশা-উদ্বেগ-ভয়, সব যেন ওই ছোট্ট মানুষটার ব্যাটের দাপটে লুকিয়ে পড়েছিল কোথাও। অনেক পরে নেভিল কার্ডাসে খুঁজে পেয়েছি এই রকম মুহূর্তগুলোকে। ওই খেলাটা ঠিক খেলা নয়। অন্য কিছু। একটা মায়া। একটা জাদু।

সতেরো রান দূরে সচিন আউট হল। ভারত হারল বারো রানে।

তবু, নব্বইয়ের দশকটা সচিনের। এত বড় দেশের, এত অসংখ্য বিচিত্র মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা-স্বপ্ন একটা মানুষ বয়ে বেড়িয়েছে একা। একটা মানুষ ইতিহাস বদলে ফেলতে পারে। একটা মানুষ একার কাঁধে বহন করতে পারে একটা সময়কে। কেউ বলবে, বাড়াবাড়ি, এটা তো নিছকই খেলা একটা। আপনি নব্বইয়ে বড় হয়েছে এমন যাকে ইচ্ছে জিজ্ঞেস করুন, এটা কি স্রেফ একটা খেলা? ওই লোকটা কি নেহাতই এক জন খেলোয়াড়? চেন্নাইয়ের ইনিংসটা শুধু একটা দারুণ ইনিংস? না একটা গোষ্পদ যাতে গোটা একটা আকাশ ধরা পড়ে, আধ বেলা, যাতে গোটা নব্বই লেখা আছে?

সে দিন, ৩১ তারিখ রাতে, দাদা বাথরুমে পড়ে যায়। ভোর রাতে দাদা প্রলাপের মতো বলছিল, আর একটু যদি থাকত... পরের বছর দাদা মারা যায়। ১৩ জানুয়ারি। এই এক বছর দাদা বিছানায় শুয়ে ছিল অর্ধমৃত অবস্থায়। ও ভাবেই চলে যেতে দেখেছে নব্বইকে।

senarijit@hotmail.com

নব্বইয়ের দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে?

লিখুন এই ঠিকানায়: হ্যালো 90s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১।

বা, লেখা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

arijit sen hello 90’s hello 90
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy