তবু এই বর্ষায় বাঙালিমাত্রেরই যেন ঈশ্বরী ইলিশের কাছে প্রার্থনা, আমার সন্তান যেন থাকে ভাপা-পাতুরিতে৷ পাতুরি শব্দটা যে পাথুড়ি থেকে এসেছে সেই তথ্যটিও এখানে বলা থাক৷
তবে, বাঙালিমাত্রের বলে একটা সূক্ষ্ম কলহকে চাপা দিয়েছি, মার্জনা করবেন৷ গঙ্গা আর পদ্মার ইলিশ তো মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের মতোই বাঙালির চিরকালের কলহ-প্রসঙ্গ। এ প্রসঙ্গে শাঁটুলবাবুরই স্মৃতি শিরোধার্য করে ভোজনশিল্পী কলকাতাবাসীর নিশ্চয় মনে পড়বে কমলকুমার মজুমদারকে। চৌরঙ্গি-বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের মোড়ে এক দুপুরে কমলবাবু নাকি এক বাঙালের ঘাড় ধরে মার মার করছিলেন। ‘বেটা বাঙালের’ অপরাধ যে সে সুতোনুটি-গোবিন্দপুরের বুকের ওপর দাঁড়িয়ে বলেছিল পদ্মার ইলিশ গঙ্গার ইলিশের চেয়ে মিষ্টি। কথাটা অসম্ভব, কারণ, কমলবাবুর যুক্তি: ব্যাটা জানে না যে গঙ্গার ইলিশ আজ দেড়শ বছর ধরে কোম্পানির তেল খাচ্ছে!
এই সব প্রশস্তি থেকে ফুটে বেরোয় একটি কথা, যুগে যুগে ইলিশ ভুলিয়েছে কবিদের প্রাণ, বিশেষ করে রসনা যাঁদের প্রখর সেই কবিদের। বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল গানে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, সেই যে আমার সুরের খেতের প্রথম সোনার ধান..., আর বুদ্ধদেব বসু ইলিশকে বললেন জলের উজ্জ্বল রুপোলি শস্য। এ দুইয়ে মিলে মাছে-ভাতে বাঙালির এক অভিজাত ধারণা যেন তৈরি হয়ে গেল। রবীন্দ্রনাথ ইলিশ মাছ নিয়ে খুব একটা লেখেননি, তবে প্রজাপতির নির্বন্ধ-এ উপমা প্রসঙ্গে এক বার ইলিশ মাছকে এনেছেন, ‘ইলিশ মাছ অমনি দিব্যি থাকে, ধরলেই মারা যায়- প্রতিজ্ঞাও ঠিক তাই, তাকে বাঁধলেই তার সর্বনাশ।’
ইলিশ মাছ অমনি দিব্যি থাকে, ধরলেই মারা যায়। এর সঙ্গেই জড়িয়ে আছে ইলিশের সূক্ষ্ম উপভোগ্যতা। অত্যন্ত মেজাজি এই মাছ, স্বাধীনতাপ্রিয়। ইলিশের বৈজ্ঞানিক ইতিহাস এবং তার স্বভাবচরিত্রের বিশ্লেষণও ঠিক একই কথা বলে। গঙ্গার মতো ভারতের অন্যান্য সমুদ্রগামী নদীতে ইলিশ মেলে। কিন্তু ইলিশ আসলে নদীতে থাকতে ভালবাসে না। আসলে ইলিশ নদীতে আসে সংসারের টানে, সংসার যবে মন কেড়ে লয় তখনই তার নদীতে আগমন। আসলে ভারত মহাসাগরই ইলিশের বাসস্থান। ভারত থেকে আরম্ভ করে পশ্চিমে পারস্য উপসাগর ও পূর্বের দ্বীপপুঞ্জের কিছু দ্বীপ ইলিশের বসবাসের স্থল। কিন্তু জীবনের অধিকাংশ সময় সমুদ্র-স্বাধীনতায় থাকলেও কেবল উত্তরাধিকারীর জন্ম দেওয়ার জন্য উজান বেয়ে নদীতে ঢোকে ইলিশ, সেই সঙ্গে রসিকের কাছে ধরা দেয়। কিন্তু হায়, সে রসিকও কি আজ আছেন? প্রবীণেরা আজও স্মৃতিবিলাসে মজে যে বলেন, ‘আমাদের যৌবনে একটি ইলিশ মাছ ভাজলে তার সুগন্ধে পাড়া ভরে যেত, আজ তো তেমন হয় না৷’ ইলিশ তার গন্ধ হারাচ্ছে নাকি আমাদেরই ইলিশ খাওয়ার আনন্দময় প্রাণটি নষ্ট হয়ে গিয়েছে সে এক জটিল সমাজতাত্ত্বিক প্রশ্ন৷
সে আপাতত শিকেয় থাক৷ ইলিশকে ভালবেসে মুজতবা আলীর একটি তুঘলকী গল্প শুনিয়ে শেষ করি৷ আলি-সাহেবের মতে, মহম্মদ বিন তুঘলকের মৃত্যু হয়েছিল বেশি ইলিশ খাওয়ার ফলে, পেটের রোগে৷ তবে ইলিশ খেয়ে মৃত্যু হওয়াতেই তাঁর বেহেস্ত লাভ হয়েছে, মনে করতেন আলি-সাহেব৷
জনান্তিকে জানিয়ে রাখি, এ ইতিহাসের পাথুরে প্রমাণ, নেই, পাথুড়ি প্রমাণ খুঁজলেও মিলতে পারে!