এ দেশে শরবত এসেছিল মোগলদের হাত ধরে। শোনা যায়, সম্রাট বাবরের রাজসভায় সুরাপাত্রের পাশে সাজানো থাকত নানা রকম ফল এবং ফুলের সুগন্ধে ভরা পানীয়। যাকে মোগলেরা বলত শরবত। এই শরবতের ব্যাপারে অত্যন্ত শৌখিন ছিলেন সম্রাট। ‘চিল্ড’ ছাড়া খেতেন না। তাই শরবত ঠান্ডা রাখার জন্য তাতে দেওয়া হত বরফ। ১৫২৬ সালে বাবর এসেছিলেন ভারতে। ৫০০ বছর আগে তখনও ফ্রিজ আবিষ্কার হয়নি। কৃত্রিম ভাবে বরফ বানানোর প্রক্রিয়া জানা ছিল না। তাহলে বরফ আসত কোথা থেকে? কথিত আছে, বাবর তাঁর প্রিয় শরবতের জন্য বরফ আনাতেন হিমালয় থেকে! এ হেন শরবতের নানা রকমফেরের মধ্যে মোগল রাজদরবারে রাজা এবং রাজপার্ষদদের একটি প্রিয় পানীয় ছিল বেলের শরবত।
পাকা বেল ফলের শাঁসের সঙ্গে জল, মরিচ বা লঙ্কা, নুন, পুদিনা, চিনি এবং লেবুর রস মিশিয়ে তৈরি হত বেলের শরবত। বা কখনও শুধুই লেবু, নুন আর চিনি মেশানো হত তাতে। মোগল রাজদরবারের সেই শরবতের স্বাদ পেয়েছিল ভারতে বাণিজ্য করতে আসা ব্রিটিশেরাও। তত দিনে অবশ্য সম্রাটের প্রিয় পানীয় আমজনতারও প্রিয় হয়ে উঠেছে। বেলের শরবত হজমে সাহায্যকারী এবং ক্ষুধাবর্ধক পানীয় হিসাবে খাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। তার আরও নানা ওষধি গুণ বুঝতে পারছে ধীরে ধীরে। ভারতে এসে ব্রিটিশ শাসকেরাও তার স্বাদ পেলেন এবং পানীয়ের প্রশংসা করে প্রতিবেদন লিখলেন ব্রিটেনের গেজেটে।

১৮৯৪ সালে নিউ সাউথ ওয়েলসের এগ্রিকালচারাল গেজেটে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ-সহ প্রকাশিত হল বেলের শরবতের গুণগান। তাতে লেখা হল, ‘‘বেলের ঘন শাঁস সমেত শরবত খাওয়া হয় ভারতে। শরবত বলতে আমরা যেমন পাতলা জলের মতো পানীয় বুঝি, এটা তেমন নয়। এটা এতটাই ঘন যে চামচে করে খাওয়া যায়। আর এটা খেলে ডায়েরিয়া, ডিসেন্ট্রির মতো সমস্যাও হয় না। ’’
বেলের শরবতের জনপ্রিয়তা মোগলদের হাত থেকে ছড়িয়েছিল দেশের নানা প্রান্তে। উৎকল বা আজকের ওড়িশা সম্ভত তার মধ্যে একটি। তবে ওড়িশায় বেলের শরবত নতুন পরিচয় পায়। তার নাম হয় বেল পানা। বদলে যায় বানানোর প্রক্রিয়াও।
ওড়িশার বেলের পানায় দেওয়া হত দুধ, ছানা, কোরানো নারকেল, গুড়, মরিচ, আদা ইত্যাদি। সেই পানীয় খাওয়া হত মহা বিষুব সংক্রান্তির দিন। দিনটিকে উৎকল অঞ্চলের নতুন বছরের সূচনা হিসাবে দেখা হয়। মন্দিরে পুজো দিয়ে নতুন বছর শুরু করার চল রয়েছে ওড়িশায়। ওই দিন মন্দিরে ভক্তদের প্রসাদ হিসাবে দেওয়া হত এবং আজও দেওয়া হয় বেলের পানা। তবে মন্দিরের ভোগ হিসাবে দেওয়া বেল পানায় তুলসীপাতাও দেওয়া হয়। নববর্ষের দিনে বেলের পানা খাওয়া হয় দিনটির নামই হয়ে যায় পানা সংক্রান্তি। ওড়িশা ক্যালেন্ডারে নববর্ষ আসে বাংলার মতোই এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে। বৈশাখের প্রথম দিন শরীর ঠান্ডা করার শরবত খেয়ে পানা সংক্রান্তি পালন করেন ওড়িশার মানুষ।
বেলের পানা বা শরবত খাওয়ার প্রচলন হয় বাংলাতেও । সেই পদ্ধতি কিছুটা মোগল আর কিছুটা ওড়িশা অনুপ্রাণিত। তবে বাংলারটি অনেক বেশি সহজ।

কী ভাবে বানানো হয়?
উপকরণ:
১টি পাকা বেল
১/২ চা চামচ গুড় (চাইলে বাদ দিতেও পারেন )
১ চিমটে বিট নুন
১ চা চামচ লেবুর রস
দেড় কাপ জল
প্রণালী: বেল আধাআধি ফাটিয়ে নিয়ে চামচ করে শাঁস বার করে নিন। একটি পাত্রে বেলের শাঁস তাতে সামান্য জল দিয়ে হাতে করে চটকে ক্বাথ বানিয়ে নিতে হবে। এ বার সেটি একটি ছাঁকনিতে ছেঁকে নিন। যাতে দানা আর আঁশ আলাদা হয়ে যায়। এ বার ছেঁকে নেওয়া বেলের ক্বাথের সঙ্গে মেশান জল এবং অন্যান্য উপকরণ। ভাল ভাবে গুলে নিয়ে গ্লাসে বরফের টুকরো দিয়ে তার উপর ঢেলে দিন। মনে রাখবেন বেলের শরবত খুব বেশি তরল হবে না। তাই সেই বুঝে জল মেশাবেন।