খোঁজ মিলেছিল ১০০ বছর আগে। ১৯২৪ সালে। একটি মাথার খুলি। সন্ধান মেলে এক আদিম প্রজাতির। তার পরে বহু বছর ধরে মনে করা হত, এরাই ছিল সেই সাধারণ পূর্বসূরি। যাদের থেকে আদিমানব এবং বানর উভয়েরই আবির্ভাব হয়েছে। কিন্তু সেই ধারণা ভেঙে দিয়েছে নতুন এক জীবাশ্ম। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে এই দুই জীবাশ্মই মিলেছে আফ্রিকাতেই।
দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গ থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দক্ষিণপশ্চিমে রয়েছে তাউং শহর। ১৯২৪ সালে এখানেই এক খাদানে খোঁড়াখুড়ির সময় পাওয়া যায় একটি খুলি। আকারে মানুষের খুলির তুলনায় অনেকটা ছোট। অনেকটা কফি মগের মাপের। এই খুলির গড়ন আদিমানবের চেয়ে অনেক আলাদা। আবার বানর বা এপ প্রজাতিগুলির থেকেও এর অনেক ফারাক।
ওই খুলিটিই পৃথিবীকে পরিচয় করায় এক আদিম প্রজাতির সঙ্গে। অস্ট্রালোপিথেকাস আফ্রিকানাস। বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া এই প্রজাতিকে ‘দক্ষিণ আফ্রিকার মানব-বানর’ বলেও অভিহিত করেন অনেকে। এই আদিম প্রজাতির আবিষ্কার করেন জোহানেসবার্গের উইটওয়াটার্সর্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতাত্ত্বিক রেমন্ড ডার্ট। তবে এই খুলিটি তিনিই খুঁড়ে বের করেছিলেন কি না, তা নিয়ে দ্বিমত রয়েছে প্রত্নতাত্ত্বিকদের অন্দরে।
অনেকেই দাবি করেন, তাউঙের খাদান শ্রমিকেরাই প্রথমে একটি খুলির সন্ধান পান। সেখান থেকে খুলিটি যায় জোসেফিন স্যালমন্সের হাতে। তিনি ছিলেন ডার্টের ছাত্রী। খুলিটি কিসের, তা বুঝতে না পেরে স্যালমন্স সেটি নিয়ে আসেন ডার্টের ক্লাসে। ওই খুলিটি দেখার পরই উত্তেজিত হয়ে ওঠেন ডার্ট। খাদানে পাওয়া ওই জীবাশ্মটি কোনও আদিম প্রজাতির হতে পারে বলে অনুমান করেন তিনি। সেই সূত্র ধরেই ডার্ট যোগাযোগ করেন তাঁর সহকর্মী রবার্ট ইয়াঙের সঙ্গে। ইয়াং ওই খাদান ভাল ভাবে চিনতেন। তিনিই খাদান শ্রমিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আরও কোনও খুলি পাওয়া যায় কি না, সে দিকে নজর রাখতে বলেন। পরে সেখানে একটি পাথরের টুকরোর মধ্যে খুলির ছাঁচ দেখা যায়। খাদান শ্রমিকদের থেকে তা হাতে পান ইয়াং। পরে তিনি সেটি পৌঁছে দেন ডার্টের কাছে।
যদিও ডার্টের স্মৃতিকথন ‘অ্যাডভেঞ্চারস উইথ দ্য মিসিং লিঙ্ক’-এ এ বিষয়ে কোনও উল্লেখ নেই। বরং তিনিই ধ্বংসস্তূপ থেকে খুলিটি আবিষ্কার করেছিলেন, এমনটাই আভাস মিলেছিল ওই স্মৃতিকথনে। খুলি আবিষ্কারের পরের বছর, ১৯২৫ সালে ‘নেচার’ জার্নালে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন তিনি। সেখান থেকেই এই পূর্বসূরির সঙ্গে পরিচিতি হয় বিশ্বের। নতুন আবিষ্কৃত এই পূর্বসূরির তিনি নামকরণ করেন অস্ট্রালোপিথেকাস আফ্রিকানাস।
এই খুলির আবিষ্কার বিবর্তনের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বলে বিবেচনা করা হয়। কারণ, এর আগে আদিমানবের কোনও পূর্বসূরির এতটা অক্ষত খুলি পাওয়া যায়নি। পাশাপাশি এই জীবাশ্ম গবেষণা করে এমন কিছু তত্ত্ব উঠে এসেছিল, যা চার্লস ডারউনের অনুমানকে একটি স্পষ্ট দিক্নির্দেশ দিয়েছিল। ডারউইনের ধারণায়, মানুষ সরাসরি বানর থেকে বিবর্তিত হয়নি। বরং উভয়েরই একটি সাধারণ পূর্বসূরি ছিল। সেই আদিম পূর্বসূরি প্রায় ৬০ লক্ষ থেকে ১ কোটি বছর আগে আফ্রিকায় বাস করত। সেখান থেকেই বিবর্তনের ধারায় মানুষ এবং বানরের আবির্ভাব হয়েছে বলে অনুমান ছিল ডারউইনের। তবে এটি ছিল শুধুই ধারণা। এর কোনও প্রমাণ ছিল না ডারউইনের কাছে।
তাউঙের খাদান থেকে পাওয়া খুলি বিশ্লেষণ করে দেখা যায় এটি আদিমানবদেরও নয়। আবার বানর বা এপ-দেরও নাম। উভয়ের থেকেই এই খুলির বেশ ফারাক ছিল। যা থেকে গবেষকেরা দাবি করেন, এই অস্ট্রালোপিথেকাস আফ্রিকানাসই ছিল আদিমানব এবং বানরদের সাধারণ পূর্বপুরুষ, যা আফ্রিকায় বিবর্তিত হয়েছিল। তবে এই খুলি কত প্রাচীন, তা পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। শুরুতে বহু বছর ধরে অনুমান করা হত, খুলিটি অন্তত ৩৭ লক্ষ বছরের পুরানো। তবে সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় জানা যায়, খুলিটির বয়স প্রায় ২৫ লক্ষ বছর।
আরও পড়ুন:
আবিষ্কারের পর থেকে প্রায় ৫০ বছর ধরে মনে করা হত, আদিমানবদের সরাসরি পূর্বসূরি ছিল অস্ট্রালোপিথেকাস আফ্রিকানাসরাই। তবে এই ধরাণ নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেয় ১৯৭৪ সালে খুঁজে পাওয়া আরও এক জীবাশ্ম। আফ্রিকা মহাদেশের ইথিওপিয়ায় খননকার্য চলাকালীন পাওয়া যায় সেই জীবাশ্ম। বিশ্লেষণ করে দেখা যায় সেটি ৩২ লক্ষ বছরের পুরানো। তবে সেটি আফ্রিকানাসদের নয়। সেটি ভিন্ন এক প্রজাতির— অস্ট্রালোপিথেকাস আফারেনসিস-এর। এই খুলি বিশ্লেষণের পরে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা দাবি করেন, আদিমানবের সরাসরি সাধারণ পূর্বসূরি ছিল এই নতুন প্রজাতিই।
আরও পড়ুন:
ইথিয়োপিয়ার এই জীবাশ্মটি ছিল একটি নারীর জীবাশ্ম। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা এর নাম রেখেছেন ‘লুসি’। বস্তুত, এই ‘লুসি’ হল এক আদিম নারী-বানর জীবাশ্ম। এখনও পর্যন্ত অস্ট্রালোপিথেকাস অ্যাফারেনসিস প্রজাতির যত জীবাশ্ম পাওয়া গিয়েছে, তার মধ্যে সবেচেয়ে পূর্ণাঙ্গ এটিই। বিবর্তনের বিবিধ গবেষণায় এই জীবাশ্ম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তবে ২০০৯ সালে আরও কিছু জীবাশ্মের খোঁজ পাওয়া যায়। প্রথমে অনুমান করা হয়েছিল, সেটি ‘লুসি’-র প্রজাতিরই জীবাশ্ম। কিন্তু পরে দেখা যায়, সেগুলি সম্পূর্ণ ভিন্ন এক আদিম প্রজাতির জীবাশ্ম, অস্ট্রালোপিথেকাস ডেইরিমেডার। প্রাথমিক গবেষণায় বিজ্ঞানীদের অনুমান, লুসির প্রজাতির আগেই আবির্ভাব হয়েছিল অস্ট্রালোপিথেকাস ডেইরিমেডার। এই দুই প্রজাতিই ছিল দু’পেয়ে। ডেইরিমেডার পায়ের বুড়ো আঙুলটি ছিল বিপরীতমুখী। লুসির প্রজাতিতে এমনটা ছিল না। অনুমান করা হয়, গাছে ওঠার জন্যই অস্ট্রালোপিথেকাস ডেইরিমে়ডার পায়ের বুড়ো আঙুলের গড়ন ওই ধরনের ছিল। গাছের ডালপালা ধরার জন্য এতে বেশি সুবিধা হত তাদের। ফলে লুসির প্রজাতিই আদিমানব এবং বানরের সর্বশেষ সাধারণ পূর্বপুরুষ ছিল কি না, তা নিয়েও ফের নতুন করে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে।