Advertisement
E-Paper

উল্কায় প্রাণ সৃষ্টি

যখন এগুলো পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে এসে দগ্ধ হয়ে জ্বলন্ত তারার মতো দৃশ্যমান হয়, তখন এদের ‘মিটিয়র’ বলে।

দর্প নারায়ণ বসু

শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৬:৪৮

মানুষ যখন গুহাবাসী, তখন থেকেই উল্কা মানবজীবনকে প্রভাবিত করেছে। বহু যুগ আগে উল্কাপাত থেকেই মানুষ পেয়েছে লোহার সন্ধান। তারা তখন উল্কাকে বলত আকাশের সন্তান। এর পর মানুষ প্রবেশ করল লৌহযুগে— শুরু হল আধুনিক সভ্যতা।

উল্কা হল প্রকৃতপক্ষে এক রকম পাথর, যা মহাকাশ থেকে পৃথিবীতে আছড়ে পড়ে। উল্কার ইংরেজি প্রতিশব্দ দেখতে গেলে মিটিয়োরয়েড, মিটিয়র এবং মিটিয়োরাইট— এই তিনটি শব্দই মাথায় আসে। কিন্তু এরা এক নয়। মিটিয়োরাইট কোনও গ্রহাণু বা ধূমকেতু থেকে সৃষ্টি হওয়া চূর্ণবিচূর্ণ অংশ, যা পৃথিবীর দিকে ধাবিত হয়। এদেরকে ‘স্পেস রক’ বলা হয়। যখন এগুলো পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে এসে দগ্ধ হয়ে জ্বলন্ত তারার মতো দৃশ্যমান হয়, তখন এদের ‘মিটিয়র’ বলে। মিটিয়রকে ‘শুটিং স্টার’ও বলা হয়। যখন এরা বায়ুমণ্ডল দিয়ে গতিশীল হয়ে ভূমিতে আছড়ে পড়ে, তখন এদের মিটিয়োরাইট বলে। আবার প্রতি ঘণ্টায় দৃশ্যমান মিটিয়র-এর সংখ্যা খুব বেশি হলে তাকে ‘মিটিয়র শাওয়ার’ বলা হয়। বেশির ভাগ উল্কাই তৈরি হয় লোহা বা নিকেল দিয়ে। এরা কোনও গ্রহ বা গ্রহাণু থেকে জন্মলাভ করে। প্রায় সমস্ত উল্কারই জন্ম আমাদের সৌরজগতে, যার মধ্যে বেশির ভাগই আসে মঙ্গল ও বৃহস্পতির মাঝে যে গ্রহাণুবলয় আছে, সেখান থেকে। এ ছাড়া ধূমকেতু থেকেও উল্কার জন্ম হতে পারে। ধূমকেতুর নিউক্লিয়াসে থাকে বরফের পিণ্ড। এটি যখন সূর্যের কাছে আসে, তখন এর বেশির ভাগ অংশই গলে যায়, যা এর লেজ তৈরি করে। এখানে থাকে পাথুরে চূর্ণবিচূর্ণ অংশ। এগুলি ধূমকেতুর কক্ষপথে থেকে যায়। পৃথিবী তার কক্ষপথে চলার সময়ে এই চূর্ণবিচূর্ণ খণ্ডগুলির মুখোমুখি হয়। এগুলি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে পুড়ে যায় এবং উল্কাবৃষ্টির সৃষ্টি করে।

বিংশ শতকের আগে পর্যন্ত কেবলমাত্র ১০০-র কাছাকাছি উল্কারই সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু এখন সেই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৩০ হাজারেরও বেশি। আন্টার্কটিকায় বরফের মধ্যে উল্কা পাওয়ার পর অনেকের মাথায় এই ভাবনা আসে যে, অস্ট্রেলিয়ার শীতল মরু অঞ্চলেও অনেক উল্কা পাওয়া যেতে পারে। ফলে দক্ষিণ ও পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায় উল্কা সংগ্রহের কাজ শুরু হয়। ১৯৮৯ সালে লিবিয়া ও আলজ়িরিয়া থেকে ১০০-র মতো উল্কা উদ্ধার হয়।

উল্কা নিয়ে আলোচনা করাটা এত গুরুত্বপূর্ণ কেন? প্রকৃতপক্ষে, উল্কাই হল বাইরের জগৎ থেকে আসা একমাত্র নমুনা বা মহাকাশের জানালা। আদি উল্কা আমাদের সৌরজগৎ তৈরির প্রাথমিক উপাদান বহন করে। এ ছাড়া কোনও গ্রহাণুর থেকে আসা উল্কা থেকে সেই গ্রহাণুর গঠন, মৃত্তিকার রাসায়নিক উপাদান প্রভৃতি জানা যায়। উল্কা কেবল গ্রহাণু থেকে নয়, অন্য গ্রহ থেকেও পৃথিবীতে এসেছে। এগুলি বিশ্লেষণ করে সেই গ্রহ সম্পর্কে অনেক তথ্য জানা যায়। ১৯৮২ সালের ১৭ জানুয়ারি জন স্কট ও ইয়ান হুইলিয়ানস আন্টার্কটিকার অ্যালান হিলস পর্বতাঞ্চলে প্রথম একটি লুনার মিটিয়োরাইট বা চাঁদের উল্কার সন্ধান পান, যার নাম এএলএইচ এ৮১০০৫। এই উল্কাগুলি থেকে চাঁদের সৃষ্টি রহস্য সম্পর্কে জানা যায়। ১৯৮৪ সালের ২৭ ডিসেম্বর আন্টার্কটিকায় একটি মঙ্গলের উল্কা পাওয়া যায়। ১২ বছর পরে বিজ্ঞানী ডেভিড ম্যাকে-র নেতৃত্বে নাসা দাবি করে, এতে জীবনের অস্তিত্বের চিহ্ন রয়েছে। ধারণা করা হয় যে, এতে ব্যাকটিরিয়া জাতীয় জীবের জীবাশ্ম আছে, যা মঙ্গল গ্রহে জীবের অস্তিত্বকে নির্দেশ করে। এই উল্কাটি আদৌ মঙ্গল গ্রহে কোনও জীবের অস্তিত্ব নির্দেশ করে কি-না, সেই আলোচনা আজও বিতর্কমূলক। তবু এই আলোচনা বিজ্ঞানের শাখা অ্যাস্ট্রোবায়োলজি-র গবেষণাকে প্রসারিত করেছে।

১৯৬৯ সালে অস্ট্রেলিয়ায় মার্চিসনে একটি উল্কাপাত হয়। এই উল্কার নাম মার্চিসন মিটিয়োরাইট। মনে করা হয়, এটি পৃথিবীতে পাওয়া সবচেয়ে প্রাচীন উল্কা। বয়স ৭০০ কোটি বছর, সৌরজগতের থেকেও প্রাচীন। এতে অনেক জৈব উপাদান, যেমন— অ্যামিনো অ্যাসিড অ্যালিফ্যাটিক ও অ্যারোমেটিক হাইড্রোকার্বন, ফুলারিন, অ্যালকোহল, সালফোনিক অ্যাসিড, ফসফোরিক অ্যাসিড পাওয়া গিয়েছে। এ ছাড়াও নিউক্লিক অ্যাসিড তৈরির ক্ষার পিউরিন ও পিরিমিডিন পাওয়া গিয়েছে। এগুলি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা অনুযায়ী, পৃথিবীতে জীবন সৃষ্টির আদি উপাদান।

এখনও এই উল্কা সংগ্রহের কাজ অব্যাহত। আশা করা যায়, এই মহাকাশের জানালার মাধ্যমে অদূর ভবিষ্যতে নানা বিস্ময়ের দ্বার উদ্ঘাটিত হবে।



Meteor
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy