Advertisement
E-Paper

‘ঈশ্বরের মন’ পড়তে পেরেছিলেন আইনস্টাইন!

এক সময় আইনস্টাইন নিজেই ভেবেছিলেন ঈশ্বরের মন বুঝতে তিনি ভুল করেছেন। তাই নিজের আবিষ্কার করা কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্টকে ‘ভুল, বিলকুল ভুল’ বলে খারিজও করে দিয়েছিলেন তিনি।

সুজয় চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১০ অগস্ট ২০১৭ ১৫:১৫
অ্যালবার্ট আইনস্টাইন।- অ্যালবাম থেকে।

অ্যালবার্ট আইনস্টাইন।- অ্যালবাম থেকে।

না, সত্যি-সত্যিই কোনও ভুলচুক হয়নি তাঁর। ‘ঈশ্বরের মন’ একেবারে ঠিকঠাক ভাবেই পড়তে পেরেছিলেন আইনস্টাইন! আজ থেকে ১০০ বছর আগে।

হ্যাঁ, তিনি আইনস্টাইন বলে দিতে পেরেছিলেন, এই ব্রহ্মাণ্ডের মূল চালিকাশক্তির কোনও বিনাশ নেই। সেই শক্তি অবিনাশী! ব্রহ্মাণ্ড কালে কালে যুগে যুগে দিনে দিনে যতই ফুলে-ফেঁপে উঠুক না কেন, ছড়িয়ে পড়ুক না কেন হইহই করে চার পাশে, সেই আদি, অনন্ত চালিকাশক্তির ঘনত্ব (বা ডেন্সিটি) আগেও যা ছিল, এখনও তাই আছে। কোটি কোটি বছর পরেও ব্রহ্মাণ্ডের সেই চালিকাশক্তির ঘনত্ব একই থাকবে। এটাকেই তিনি নাম দিয়েছিলেন ‘কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্ট’।

শুধু তাই নয়, যাকে আমরা মহাশূন্য বলে জানি, সেখানেও ঘাপটি মেরে বসে রয়েছে ব্রহ্মাণ্ডের সেই অবিনাশী শক্তি। শূন্য আসলে শূন্য নয়। তার অন্তর-অন্দর ভরা রয়েছে আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা একটি ‘ভুতুড়ে’ শক্তিতে। ব্রহ্মাণ্ড ফুলছে ফাঁপছে বলে যেই না শূন্যতার সৃষ্টি হচ্ছে, অমনি ঝুপ করে সেই শূন্যতায় ঢুকে পড়ছে এই ‘ভুতুড়ে’ শক্তি। আর সেই শক্তিই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে গোটা ব্রহ্মাণ্ড। মহাশূন্যের সর্বত্র! তার শুরু থেকে এখনও পর্যন্ত। আর এই শক্তিই এক দিন ব্রহ্মাণ্ডকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে দেবে। বেলুন ফোলাতে ফোলাতে যেমন মুখের বাতাসে এক সময় সশব্দে ফেটে যায়! ফলে, নিজে অবিনাশী এই শক্তিই এক দিন হয়ে দাঁড়াবে এই ব্রহ্মাণ্ডের বিনাশের কারণ!

ব্রহ্মাণ্ডে এই শূন্যতার (বৃত্তাকার) মধ্যেই রয়েছে সেই ভুতুড়ে শক্তি। ডার্ক এনার্জি

আমেরিকার ফের্মিল্যাব-এর করা ডার্ক এনার্জি সার্ভের রিপোর্ট জানিয়ে দিল, ১০০ বছর আগে একেবারে ঠিক কথাটাই বলেছিলেন আইনস্টাইন। তাঁদের গবেষণাপত্রটির শিরোনাম- ‘ডার্ক এনার্জি সার্ভে ইয়ার ওয়ান রেজাল্ট: কসমোলজিক্যাল কন্সট্রেইন্টস্ ফ্রম গ্যালাক্সি ক্লাস্টারিং অ্যান্ড উইক লেন্সিং’। যা ফের্মিল্যাবের তরফে গত শুক্রবার (৪ অগস্ট) আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা করা হয়েছে।

আরও পড়ুন- ওজন আধুলির মতো! পৃথিবীকে পাক মারছে ৬ মহাকাশযান

এই ব্রহ্মাণ্ড আসলে যে তিনটি জিনিস দিয়ে গড়া, এই আদি ও অনন্ত চালিকাশক্তি তার অন্যতম। তার নাম ‘ডার্ক এনার্জি’। যার জন্ম কী ভাবে হল, কোথা থেকে হল, তার জন্মের পিছনে কলকাঠি নাড়ল কে, তা এখনও জেনে বা বুঝে ওঠা সম্ভব হয়নি বিজ্ঞানীদের। তাঁরা এত দিনে শুধু এইটুকুই জানতে পেরেছেন যে, প্রায় ১৪০০ কোটি বছর আগে বিগ ব্যাং বা এই ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির প্রাক-মুহূর্তের সেই মহা বিস্ফোরণের পর কোনও সাড়াশব্দ ছিল না বহু দিন। যেন কিছুই হয়নি! অত প্রচণ্ড বিস্ফোরণের পর সব চুপচাপ মেরে গিয়েছিল। তার প্রায় ৪ লক্ষ বছর পর হঠাৎ করেই জন্ম হল আমাদের দৃশ্যমান আলোর। জন্ম নিল আলোর কণা ‘ফোটন’। চার দিকে চার পাশে হু হু করে বেলুনের মতো ফুলে, ফেঁপে উঠতে শুরু করল গোটা ব্রহ্মাণ্ড। যেটা এখনও চলছে। চলবে আরও বহু কোটি কোটি বছর ধরে। ব্রহ্মাণ্ড আরও আরও ফুলে, ফেঁপে উঠে ছড়িয়ে পড়ছে আরও আরও দূরে। ফলে, মহাজাগতিক বস্তুগুলি একে অন্যের চেয়ে দূরে সরে যাচ্ছে উত্তরোত্তর। দূরে সরে যাচ্ছে গ্রহ, নক্ষত্রগুলো। গ্যালাক্সিগুলো। গ্যালাক্সি ক্লাস্টার আর গ্যালাক্সির সুপার ক্লাস্টারগুলো।

আরও পড়ুন- ওজন আধুলির মতো! পৃথিবীকে পাক মারছে ৬ মহাকাশযান

আর সেটা হচ্ছে ‘ঈশ্বরের মন’ বা ‘মাইন্ড অব গড’ সেটা চাইছে বলেই! ব্রহ্মাণ্ডের এই ‘কথা কয়রে দেখা দেয় না’ চালিকাশক্তিকে কেউ কেউ ‘ঈশ্বরের মন’ বলছেন। এই ঈশ্বরের মনকে বিজ্ঞানীরা বোঝার চেষ্টা চালাচ্ছেন বৈজ্ঞানিক মন নিয়ে। শব্দটি জনপ্রিয় হয় ব্রিটিশ পদার্থবিদ পল ডেভিসের বিখ্যাত বই ‘দ্য মাইন্ড অব গড/ দ্য সায়েন্টিফিক বেসিস ফর এ র‌্যাশনাল ওয়ার্ল্ড’ প্রকাশিত হওয়ার পর।

১৪০০ কোটি বছর আগে বিগ ব্যাং-এর পর থেকে এখনও পর্যন্ত যে ভাবে ধাপে ধাপে গড়ে উঠছে, ফুলে, ফেঁপে উঠছে আমাদের ব্রহ্মাণ্ড

সে যাই হোক, গোটা ব্রহ্মাণ্ডকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে চলেছে এই ঈশ্বরের মনেরই একটা অংশ। আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা একটি ‘ভুতুড়ে’ শক্তি। ডার্ক এনার্জি। এই ব্রহ্মাণ্ডের মোট যতটা ভর, ওই ভুতুড়ে শক্তির ভর তার প্রায় ৭০ শতাংশ। ব্রহ্মাণ্ডের বাকি ৩০ শতাংশ ভরের জন্য দায়ী ঈশ্বরের মনের আর দু’টি জিনিস। একটি- ডার্ক ম্যাটার। অন্যটি- সাধারণ পদার্থ বা অর্ডিনারি ম্যাটার। মানুষ, অন্যান্য প্রাণী, উদ্ভিদ, ব্যাকটেরিয়া, অণুজীব, গ্রহ, নক্ষত্র, গ্যালাক্সি, এই সব কিছু যা দিয়ে গড়া, তাদের মোট ভর এই ব্রহ্মাণ্ডের মোট ভরের মাত্র ৫ শতাংশ। ব্রহ্মাণ্ডের বাকি ২৫ শতাংশ ওজনের জন্য দায়ী ডার্ক ম্যাটার।

আরও পড়ুন- অকারণ ভয়ে আর ভুগতে হবে না? পথ দেখালেন দুই বাঙালি

ঈশ্বরের মনের এই তিনটি জিনিসের মধ্যে সাধারণ পদার্থকে আমরা এত দিনে অনেকটাই চিনতে, বুঝতে পেরেছি। ঈশ্বরের মনের আর একটা অংশ ডার্ক ম্যাটারকেও কিছুটা চিনতে পেরেছি আমরা, তার শরীর কী কী জিনিস দিয়ে গড়া তা জানতে না পারলেও। কিন্তু যে অবিনাশী চালিকাশক্তি প্রায় ১৪০০ কোটি বছর ধরে এই ব্রহ্মাণ্ডকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে চলেছে, যে শক্তি ফোলাতে ফোলাতে এক দিন ফেটে যাওয়া বেলুনের মতো ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে দেবে ব্রহ্মাণ্ডকে, সেই ‘ভুতুড়ে’ শক্তি আজও আমাদের নাগালের বাইরেই থেকে গিয়েছে!

ব্রহ্মাণ্ডের মোট ভরের (১০০ শতাংশ) কতটা ডার্ক এনার্জি, কতটা ডার্ক ম্যাটার আর কতটা সাধারণ পদার্থ

ভারতে ডার্ক এনার্জি গবেষণার অন্যতম ব্যক্তিত্ব, মুম্বইয়ের টাটা ইন্সটিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ (টিআইএফআর)-এর থিয়োরিটিক্যাল ফিজিক্সের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর শুভব্রত মজুমদার বলছেন, ‘‘মজার ঘটনা এটাই, ঈশ্বরের মনের সেই নাগালের বাইরে থাকা অংশ- ভুতুড়ে শক্তির আচার, আচরণ ঠিক কেমন, ১০০ বছর আগে সেটা নির্ভুল ভাবে বলে দিতে পেরেছিলেন আইনস্টাইন। তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদে। তাঁর পূর্বাভাস ছিল, ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির পর থেকে শুরু করে ব্রহ্মাণ্ডের আয়ু যত দিন, তত দিন পর্যন্ত ওই অবিনাশী চালিকাশক্তি ডার্ক এনার্জির রূপের কোনও অদলবদল হবে না। সেই অবিনাশী শক্তি অন্য কোনও শক্তিতে রূপান্তরিত হবে না। তার লয় নেই, ক্ষয় নেই। তার ঘনত্ব বদলাবে না বিন্দুমাত্র, ব্রহ্মাণ্ড ফুলে, ফেঁপে যতই বড় হোক, বিশাল থেকে বিশালতর হোক। ব্রহ্মাণ্ড ফুলে, ফেঁপে যত বড় হবে, যত আরও বেশি করে ছড়িয়ে পড়বে চার পাশে, তত বেশি করে তৈরি হবে শূন্যতা বা ভ্যাকুম। আর সেই শূন্যতা বা মহাশূন্যতার ‘খোপে’ হঠাৎ কোথা থেকে এসে ঢুকে পড়বে সেই ভুতুড়ে শক্তি বা ডার্ক এনার্জি। আর সেই শূন্যতার খোপে বসে থাকবে ঘাপটি মেরে!’’

ডার্ক এনার্জি বা ভুতুড়ে শক্তির রহস্য: দেখুন ভিডিও। বোঝাচ্ছেন বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী। সৌজন্যে: ফের্মিল্যাব, আমেরিকা

পাঁচ বছর আগে ‘প্ল্যাঙ্ক’ উপগ্রহের করা একটি সার্ভেতেও দেখা গিয়েছিল আইনস্টাইনের পূর্বাভাস ঠিক ছিল। তাঁর পূর্বাভাসের খুব কাছ দিয়েই গিয়েছিল সেই সার্ভের ফলাফল। কিন্তু সেটা করা হয়েছিল ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির অল্প কিছু মুহূর্তের উপর। সেই সময় দেখা গিয়েছিল, বিগ ব্যাং-এর পরের ৪ লক্ষ বছরে ডার্ক এনার্জি তার রূপ বদলায়নি, তার ঘনত্বের অদলবদল হয়নি। কিন্তু এ বার ডার্ক এনার্জি সার্ভে করা হয়েছে ব্রহ্মাণ্ডের প্রায় ১৪০০ কোটি বছরের ইতিহাসের ওপর। যা অভূতপূর্ব। এক রকম কল্পনাতীতও!

শুভব্রতবাবুর কথায়, ‘‘অনেক অনেক দূরের ২ কোটি ৬০ লক্ষ গ্যালাক্সি আর খুব কাছে পিঠে থাকা অত্যন্ত ভারী, লাল রঙা সাড়ে ৬ লক্ষ গ্যালাক্সি নিয়ে এ বার করা হয়েছে এই সার্ভে। ফলে, ব্রহ্মাণ্ডের অনেক বৃহত্তর সময়ের ছাপ ধরা পড়েছে এই সার্ভেতে। আর তাতেও প্রমাণ হয়েছে, আইনস্টাইন একেবারেই নির্ভুল। ‘ঈশ্বরের মন’ একেবারে ঠিকঠাক ভাবেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। পড়তে পেরেছিলেন। প্রবাদপ্রতিম বিজ্ঞানী স্টিভেন ওয়েইনবার্গ বলেছিলেন, ডার্ক এনার্জি কী জিনিস, সেটাই তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। সবচেয়ে জটিল গোলকধাঁধা!’’

মজার কথাটা হল, এক সময় আইনস্টাইন নিজেই ভেবেছিলেন ‘ঈশ্বরের মন’ বুঝতে তিনি ভুল করেছেন। তাই নিজের আবিষ্কার করা কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্টকে ‘ভুল, বিলকুল ভুল’ বলে একবার খারিজও করে দিয়েছিলেন তিনি।

কলকাতার ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্সের অ্যাকাডেমিক ডিন সৌমিত্র সেনগুপ্ত বলছেন, ‘অনেক পরে আইনস্টাইন অবশ্য স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, ‘‘ভাগ্যিস, খারিজ করে দিইনি একেবারেই! তা হলে সেটা আমার খুব বড় ব্লান্ডার হয়ে যেত!’’ ব্রহ্মাণ্ডের ১৪০০ কোটি বছরের ইতিহাসের ছবি সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে আসার পর দেখা যাচ্ছে, ‘ঈশ্বরের মন’ বুঝতে আদৌ কোনও ‘হিস্টোরিক্যাল ব্লান্ডার’ হয়নি আইনস্টাইনের।’’

ফলে, গত তিন বছরে দু’-দু’বার মহাকর্ষীয় তরঙ্গের আবিষ্কারের পর আরও এক বার এই অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডের অতলান্ত অন্ধকারে ‘ঈশ্বরের মন’ বোঝার খুব জটিল পরীক্ষায় উতরে গেলেন আইনস্টাইন!

গত তিন বছরে এই নিয়ে তৃতীয় বার পাশ করলেন পরীক্ষায়, বুক বাজিয়েই!

Dark Energy Big Bang Dark Energy Survey DES By FermiLab General Theory of Relativity Cosmological Constant Albert Einstein Fermilab Space Astronomy
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy