Advertisement
E-Paper

সেই রাক্ষুসে ব্ল্যাক হোল! এই প্রথম সামনে এল ছবি

দেখা গেল, তার সর্বনাশা খিদে মেটাতে মহাকাশে কী ভাবে বিশাল বিশাল নক্ষত্রদের হাড়-মাংস-অস্থি-মজ্জা গিলে নিচ্ছে।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০১৯ ২০:২৮
ব্ল্যাক হোল ‘এম-৮৭’। ছবি ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপের টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে।

ব্ল্যাক হোল ‘এম-৮৭’। ছবি ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপের টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে।

সেই ভয়ঙ্কর দৈত্যাকার সর্বগ্রাসী রাক্ষসটাকে শেষ পর্যন্ত দেখা গেল! দেখা গেল, তার সর্বনাশা খিদে মেটাতে মহাকাশে কী ভাবে বিশাল বিশাল নক্ষত্রদের হাড়-মাংস-অস্থি-মজ্জা গিলে নিচ্ছে। আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কোনও খাবারই ফেলে রাখছে না সেই রাক্ষস। বহু চেষ্টাচরিত্র করে দু’বছর ধরে তার ছবি তোলা হয়েছে। যে ছবি প্রকাশ করা হল বুধবার। দুটি ব্ল্যাক হোলের ছবি তোলা হলেও এদিন প্রকাশ করা হয়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি আলোকবর্ষ দূরে ‘এম-৮৭’ গ্যালাক্সির কেন্দ্রে থাকা ব্ল্যাক হোলটির।

সেই ভয়ঙ্কর রাক্ষসটা রয়েছে এই ব্রহ্মাণ্ডে আমাদের ঠিকানা মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির ঠিক মাঝখানে। আমাদের থেকে ২৬ হাজার আলোকবর্ষ দূরে। রাক্ষসটার নাম- ‘স্যাজিটেরিয়াস এ*’। যে আসলে একটি দৈত্যাকার সর্বগ্রাসী ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বর। যাকে দেখার আগ্রহ আমাদের প্রায় এক শতাব্দী ধরেই!

মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির ঠিক মাঝখানে থাকা সেই ভয়ঙ্কর রাক্ষসটার ওজন কত জানেন? আমাদের সূর্যের ভর যতটা তার ৪০ লক্ষ গুণ! আর তার চেহারাটা? বৃত্তাকার সেই দানবের শুধু ব্যাসার্ধটাই হল ১ কোটি ২০ লক্ষ কিলোমিটার লম্বা!

এমন ভয়ঙ্কর দৈত্যাকার রাক্ষসের ছবি তোলার মতো অসাধ্যসাধনটা করেছে ইভেন্ট হরাইজ্‌ন টেলিস্কোপ (ইএইচটি)। যা বানানো হয় পৃথিবীর ৮টি মহাদেশে বসানো অত্যন্ত শক্তিশালী ৮টি রেডিও টেলিস্কোপের নেটওয়ার্ক দিয়ে। কাজ শুরু করেছিল ২০১৭-য়।

কলকাতার ইন্ডিয়ান সেন্টার ফর স্পেস ফিজিক্সের (আইসিএসপি) অধিকর্তা, দেশের বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী সন্দীপ চক্রবর্তী বলছেন, ‘‘একটি বিরলতম ঘটনা। যা ব্রহ্মাণ্ডের অনেক জটিলতম রহস্যের জট খুলে দিতে পারে।’’

এত দিন ব্ল্যাক হোলের কোনও ছবি পাওয়া সম্ভব হয়নি। সন্দীপ বললেন, ‘‘গাণিতিক তথ্যের ভিত্তিতে ১৯৮২ সালেই প্রথম কল্পনায় একটি ছবি আঁকা হয়েছিল ব্ল্যাক হোলের। সেটা এঁকেছিলেন এক শিল্পী। তাঁর নাম জঁ পিয়ের ল্যুমিয়ের। আমার মনে আছে, সেই সময় নোবেল পুরস্কার জয়ী পদার্থবিজ্ঞানী চন্দ্রশেখরের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে দেখি উনি সেই পিয়েরের আঁকা ছবিটাই সামনে টাঙিয়ে রেখেছেন। তার পর আরও অনেক ছবি আঁকা হয়েছে ব্ল্যাক হোলের। কিন্তু সেই সবগুলিই কল্পনাপ্রসূত।’’

আরিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে জানানো হয়েছে, শুধুই আমাদের গ্যালাক্সির ঠিক মাঝখানে থাকা ব্ল্যাক হোলটিরই ছবি তোলেনি ইভেন্ট হরাইজ্‌ন টেলিস্কোপ, ছবি তুলেছে আরও একটি বিশাল গ্যালাক্সির ঠিক মাঝখানে থাকা আরও ভয়ঙ্কর আরও বড় চেহারার একটি রাক্ষসেরও। সেই গ্যালাক্সির নাম- ‘এম-৮৭’। যা আমাদের চেয়ে রয়েছে ৫ কোটি ৩৫ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে। দু’টি রাক্ষসেরই বিরলতম ছবি প্রকাশ করা হল বুধবার।

কেন এত দিন ছবি তোলা সম্ভব হয়নি ওই রাক্ষসদের?

কাউকে আমরা তখনই দেখতে পাই, তার ছবি তখনই তুলতে পারি, যখন কারও থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসে আলো। যাকে বলে প্রতিফলন। কিন্তু ব্ল্যাক হোল এমনই একটি মহাজাগতিক বস্তু যার সর্বগ্রাসী খিদের হাত থেকে কারওরই রেহাই মেলে না। এমনকি, বেরিয়ে আসতে পারে না আলোও। ব্ল্যাক হোল তার অত্যন্ত শক্তিশালী অভিকর্য বলের টানে সব কিছুকেই তার দিকে টেনে নিয়ে আসে। তার পর গপাগপ তাদের খেয়ে ফেলে। যাদের কাছে টেনে নিয়ে আসে ব্ল্যাক হোল, তাদের কাউকেই আর পরে দেখা যায় না তারা ব্ল্যাক হোলের ‘পেটে’ চলে গেলে। তাই এই ব্রহ্মাণ্ডের কোনও ব্ল্যাক হোলেরই ছবি তোলা সম্ভব হয়নি এত দিন।

‘ব্ল্যাক হোল্‌স আর নট সো ব্ল্যাক’!

প্রয়াত কিংবদন্তি পদার্থবিদ স্টিফেন হকিংই প্রথম অঙ্ক কষে বলেছিলেন, ‘‘ব্ল্যাক হোলস আর নট সো ব্ল্যাক।’’ ব্ল্যাক হোলরা পুরোপুরি কালো হয় না। তাদেরও কিছুটা ‘আলো’ থাকে। সেই আলোটা অবশ্য দেখা সম্ভব হয় না। কারণ, সেই আলোটা বেরিয়ে আসে অসম্ভব ঠান্ডায়। অথচ তার চেয়ে অনেক বেশি গরম এই ব্রহ্মাণ্ডের কসমোলজিক্যাল মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড (সিএমবি)। চার পাশের তুমুল হইহল্লায় যেমন শিশুদের কান্না চাপা পড়ে যায়, তেমনই সিএমবি-র তাপমাত্রায় ব্ল্যাক হোলের সেই মিনমিনে আলোও ঢাকা পড়ে যায়। তাকে দেখা সম্ভব হয় না। সেই ‘আলো’র ও-পারে কি আছে (যেখানে রয়েছে বল্যাক হোল) তাও জানা যায় না। দেখা যায় না। শুধু বোঝা যায়, ও-পারে যেন কিছুই নেই। রয়েছে শুধুই শূন্যতা।

ব্ল্যাক হোলের ইভেন্ট হরাইজ্‌নে আলো আসে কোথা থেকে?

সব সময়েই ‘খাই খাই’ অবস্থায় থাকে ব্ল্যাক হোল। কখনওই তার খিদে কমে না। পেটও ভরে না। চার পাশে থাকা কোনও গ্যালাক্সির যে নক্ষত্র, ধুলোবালি, ধুলো আর গ্যাসের মেঘকে তার অত্যন্ত জোরালো অভিকর্ষ বলের টানে কাছে নিয়ে আসে ব্ল্যাক হোলগুলি, সেগুলি ব্ল্যাক হোলের পেটে গিয়ে পড়ার আগে ছুটে আসার সময় একে অন্যকে ধাক্কা মারে। ধাক্কা মারে ব্ল্যাক হোলের চার পাশে থাকা ধুলোবালি আর জমাট বাঁধা গ্যাসের মেঘকে। তার ফলে সৃষ্টি হয় এক ধরনের আলোর। যাকে বলা হয় এক্স-রে। যা আমরা দেখতে পাই না। তবে সেগুলিও তড়িৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গ বা ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ। যা খুব বেশি দূর যেতে পারে না। তাই খুব দূর থেকে তা দেখা সম্ভব হয় না আমাদের। এমনকি, আমাদের হাতে তেমন কোনও শক্তিশালী টেলিস্কোপ এখনও পর্যন্ত নেই, যা দিয়ে ব্ল্যাক হোলের ইভেন্ট হরাইজ্ন থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসা সেই এক্স-রে দেখা সম্ভব।

এ বার কী ভাবে সেই ছবি তোলা সম্ভব হল?

সন্দীপ জানাচ্ছেন, প্রচুর আধানযুক্ত কণা ইভেন্ট হরাইজ্‌নে থাকে বলে ব্ল্যাক হোলের চার পাশের ওই এলাকায় অত্যন্ত শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র বা ম্যাগনেটিক ফিন্ডের জন্ম হয়। সেই শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্রগুলির মধ্যে দিয়ে ইভেন্ট হরাইজ্‌ন থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসে আরও এক ধরনের আলো। যা আসলে রেডিও তরঙ্গ। যার তরঙ্গদৈর্ঘ্য অনেক গুণ বেশি। তা অনেক অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে। যা এক্স-রে পারে না।

আরও পড়ুন- এই প্রথম গ্রহাণুর মৃত্যু-দৃশ্য দেখল নাসা!

আরও পড়ুন- বলয়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকা শনির আরও ৫টি চাঁদের হদিশ পেল নাসা​

সেই রেডিও তরঙ্গকে দেখেই ব্ল্যাক হোলের চেহারাটা বুঝতে পারা সম্ভব। পৃথিবীর ৮টি মহাদেশে বসানো অত্যন্ত শক্তিশালী ৮টি রেডিও টেলিস্কোপ দিয়ে সেই রেডিও তরঙ্গকেই দেখা হয়েছে। তার ফলে, এত দিনে ছবি তোলা সম্ভব হয়েছে ব্ল্যাক হোলের।

EVENT HORIZON TELESCOPE m-87 BLACK HOLE ব্ল্যাক হোল
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy