Advertisement
E-Paper

ঘরে ঘরে এ বার কম খরচে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেবে ব্যাকটেরিয়া!

আমার, আপনার ঘরে এ বার বিদ্যুৎ পৌছে দেবে ব্যাকটেরিয়া! অফুরান বিদ্যুৎ, খুবই কম খরচে। যে-বিদ্যুতে চলবে মোবাইল ফোন। ট্রানজিস্টর, ক্যাপাসিটর। চলবে মোবাইল টেলিভিশন, অডিও, ভিডিও রেকর্ডার।

সুজয় চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০১৬ ১৫:৫৬
ব্যাকটেরিয়া দিয়ে বানানো সেই ন্যানো-ওয়্যার।

ব্যাকটেরিয়া দিয়ে বানানো সেই ন্যানো-ওয়্যার।

আমার, আপনার ঘরে এ বার বিদ্যুৎ পৌছে দেবে ব্যাকটেরিয়া! অফুরান বিদ্যুৎ, খুবই কম খরচে। যে-বিদ্যুতে চলবে মোবাইল ফোন। ট্রানজিস্টর, ক্যাপাসিটর। চলবে মোবাইল টেলিভিশন, অডিও, ভিডিও রেকর্ডার। অপারেশন থিয়েটারে হৃদযন্ত্রের ধুকপুকানি বা কিডনির কাজকর্ম বোঝার মেডিক্যাল সেন্সরেও বিদ্যুৎ জোগাবে এ বার ‘দধীচী’ ব্যাকটেরিয়ার শরীর দিয়ে গড়া বিদ্যুৎ পরিবাহী তার। আমাদের জীবনে, যাপনে আরও বেশি করে ঢুকে পড়বে ব্যাকটেরিয়ারা। এই অণুজীব আরও বেশি করে হয়ে উঠবে আমাদের বন্ধু!

আপাদমস্তক ব্যাকটেরিয়ার শরীর দিয়ে গড়া বিদ্যুৎ পরিবাহী তার-ই (ন্যানো-ওয়্যার) আর কয়েক বছর পর আমাদের ঘর, সংসার, কাজের জগতে ব্যবহৃত যাবতীয় ইলেকট্রনিক গ্যাজেটস চালাবে। তাকে যখন তখন, যত্রতত্র বয়ে নিয়ে বেড়ানোর সাহস জোগাবে। যুদ্ধক্ষেত্রে জওয়ানদের খাবারদাবার, জামাকাপড়, ওষুধপত্র, অস্ত্র পাঠাতে বিমানের বিকল্প জ্বালানি বানানোরও মূল রসদটা জোগাবে এই ব্যাকটেরিয়াই।

কোনও গল্পকথা নয়। নয় কোনও কল্প কাহিনীও। নজরকাড়া এই গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে বিজ্ঞান-জার্নাল ‘নেচার-ন্যানোটেকনোলজি’-র অগস্ট সংখ্যায়। যার শিরোনাম- ‘সিন্থেটিক বায়োলজিক্যাল প্রোটিন ন্যানো-ওয়্যারস্‌ উইথ হাই কনডাক্টিভিটি’। মূল গবেষক আমহার্স্টের ম্যাসাচুসেট্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, মাইক্রো-বায়োলজিস্ট ডেরেক লাভলে গবেষণাপত্রে লিখেছেন, ‘‘ব্যাকটেরিয়ার শরীর দিয়ে গড়া এই বিদ্যুৎ পরিবাহী তার বা ন্যানো-ওয়্যার বানানো যাবে সৌরশক্তি, কার্বন ডাই-অক্সাইড বা উদ্ভিদের বর্জ্য পদার্থের মতো পরিবেশ-বান্ধব অপ্রচলিত শক্তির উৎসগুলিকেো ব্যবহার করেই। ব্যাকটেরিয়ার শরীর দিয়ে গড়া এই বিদ্যুতের তারগুলি শিশুরা মুখে দিলেও, তা ক্ষতিকর হবে না (নন-টক্সিক)। এর মধ্যে থাকবে বিশেষ একটি প্রোটিন। ‘ট্রিপ্‌টোফান’। এই বিদ্যুতের তারের ব্যাস হবে দেড় ন্যানো-মিটার। মানে, আমাদের চুলের চেয়ে ৬০ হাজার গুণ বেশি পাতলা (থিনার)। ফলে, এই তারগুলি ব্যবহার করে সূক্ষ্ণ থেকে সূক্ষ্ণতর ইলেকট্রনিক গ্যাজেটস বানানো যাবে। যা খুব সহজে বহনযোগ্যও হবে।’’ গবেষকদলে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে দুই ভারতীয়ের। এক জন বাঙালি- রমেশ ওয়াই অধিকারী। অন্য জন- মুম্বইয়ের সন্তান নিখিল মভলঙ্কর।


যে ভাবে ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে দিয়ে চলে বিদ্যুৎ


ব্যাকটেরিয়া দিয়ে গড়া বিদ্যুৎ পরিবাহী ন্যানোওয়্যার।

কোন ব্যাকটেরিয়া দিয়ে বানানো যাবে এই কম খরচে বেশি বিদ্যুৎ বয়ে নিয়ে যাওয়ার তার?

ইয়েল বিশ্ববিদ্যালেয়ের বায়োফিজিক্স, ন্যানো-টেকনোলজি ও মাইক্রো-বায়োলজির গবেষক রমেশ ওয়াই অধিকারী বলছেন, ‘‘আমরা গবেষণাটা চালিয়েছি বিশেষ এক ধরনের ব্যাকটেরিয়ার ওপর। যারা মাটিতে মিশে থাকে। তাই তাদের নাম ‘জিওব্যাকটার’। যাদের বৈজ্ঞানিক নাম- ‘জিওব্যাকটার মেটালিরেডিওসেন্স’। থাকে মাটিতে। এরাই আপাতত প্রথম হদিশ মেলা কোনও ব্যাকটেরিয়া যারা জৈব পদার্থকে (যৌগ) মরচের মতো এক ধরনের খনিজ পদার্থ আয়রন অক্সাইড দিয়ে জারিত করে (অক্সিডাইজ) কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস তৈরি করে। মানে, ওই ব্যাকটেরিয়াকে এই কাজে বাড়তি শক্তি জোগায় আয়রন অক্সাইড, তার অক্সিজেন


বাঙালি পদার্থবিজ্ঞানী রমেশ ওয়াই অধিকারী

পরমাণুগুলি দিয়ে। ঠিক একই ভাবে আমাদের শরীরও তার রোজকার কাজকর্মের জন্য কাজে লাগায় অক্সিজেনকে। এই ব্যাকটেরিয়াদের শরীরের মধ্যে দিয়ে ঝড়ের গতিতে ছুটতে পারে বিদ্যুৎ। এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে। তবে সেই বিদ্যুৎ আমাদের কাজে লাগার মতো পর্যাপ্ত নয়। তাই আমরা ওই বিশেষ প্রজাতির ব্যাকটেরিয়ারই একটি ‘জেনেটিক্যালি মডিফায়েড’ (জিএম) প্রতিরূপ বানিয়েছি গবেষণাগারে। যা জলে ডুবিয়ে রাখলেও বাধাহীন ভাবে বিদ্যুৎ পরিবহণ করতে পারে, প্রচুর পরিমাণে। আমরা দেখেছি, ওই ‘জেনেটিক্যালি মডিফায়েড’ জিওব্যাকটার ব্যাকটেরিয়ার বিদ্যুৎ পরিবহণ ক্ষমতা সাধারণ জিওব্যাকটারের চেয়ে কম করে ২ হাজার গুণ বেশি। আর ওই ‘জেনেটিক্যালি মডিফায়েড’ জিওব্যাকটার ব্যাকটেরিয়ার শরীরে বিদ্যুৎ ছোটেও অসম্ভব দ্রুত গতিতে।’’


সেই ‘জিওব্যাকটার’ ব্যাকটেরিয়া, যা দিয়ে বানানো যাবে বিদ্যুৎ পরিবাহী তার

কিন্তু কী ভাবে মাটিতে মিশে থাকা ওই বিশেষ প্রজাতির ব্যাকটেরিয়ার ‘জেনেটিক মডিফায়েড’ প্রতিরূপের শরীরে বিদ্যুৎ পরিবহণের ক্ষমতা এতটা বাড়ানো সম্ভব হল?

আমেরিকার জাক্সোনভিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োফিজিক্সের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, মুম্বইয়ের সন্তান নিখিল মভলঙ্কর বলছেন, ‘‘ওই বিশেষ প্রজাতির (জিওব্যাকটার) ব্যাকটেরিয়ার প্রাকৃতিক রূপটির শরীরে যে দু’টি অ্যামাইনো অ্যাসিড (প্রোটিন) থাকে, আমরা তার ‘জেনেটিক্যালি মডিফায়েড’ (জিএম) প্রতিরূপ বানানোর সময় সেই দু’টি প্রোটিনকে সরিয়ে নিয়েছিলাম। তার জায়গায় ওই ব্যাকটেরিয়ার প্রতিরূপের শরীরে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম অন্য একটি প্রোটিন। ‘ট্রিপ্‌টোফান’। ঘুম ঘুম ভাব, অবসাদে এলিয়ে পড়ার ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় বলে এই প্রোটিনের যথেষ্ট ‘দুর্নাম’ রয়েছে। কিন্তু ওই প্রোটিনই কেল্লা ফতে করে দিয়েছে! ওই প্রোটিনই ‘জিওব্যাকটার’ ব্যাকটেরিয়ার ‘জেনেটিক্যালি মডিফায়েড’ প্রতিরূপের শরীরে বিদ্যুৎ পরিবহণের ক্ষমতা এক লাফে ২ হাজার গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। কারণ, বিদ্যুৎ পরিবহণের জন্য যা খুব জরুরি, সেই ইলেকট্রন কণা এই প্রোটিনের মধ্যে দিয়ে খুব ভালো ভাবে ছুটতে পারে। ছুটতে পারে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে।’’


ভারতীয় ন্যানোটেকনোলজিস্ট নিখিল মভলঙ্কর

বিকল্প জ্বালানি বানাতেও কি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে এই ‘জেনেটিক্যালি মডিফায়েড’ ‘জিওব্যাকটার’ ব্যাকটেরিয়া?

বাঙালি গবেষক রমেশ জানাচ্ছেন, ইরান, ইরাক, কুয়েত ও আফগানিস্তানের মতো দেশগুলিতে, যেখানে বিদ্রোহীরা তেলের কূপগুলি জ্বালিয়ে, পুড়িয়ে দেয় প্রতিপক্ষ সেনার সাঁজোয়া গাড়ি বা বিমানকে জ্বালানি ভরার সুযোগ না দেওয়ার জন্য, সেখানে এই ব্যাকটেরিয়া থেকে বিকল্প জ্বালানি ‘বিউটানল’ বানানো যাবে আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে।

আরও পড়ুন- শরীরে ঢুকে ক্যানসার কোষে সরাসরি ‘গোলা’ ছুড়বে এ বার ব্যাকটেরিয়া!

ফলে, বিদ্যুৎ পরিবহণ থেকে শুরু করে বিকল্প জ্বালানি- জীবনে, যাপনে আরও বেশি করে জড়িতে পড়তে চলেছে ব্যাকটেরিয়া।

ছবি সৌজন্যে: ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় ও জাক্সোনভিলে বিশ্ববিদ্যালয়।

Bacteria Electrical Wires Geobacter
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy