Advertisement
২৩ জানুয়ারি ২০২৫

অন্ধকার পথে এ বার আলো দেবে গাছ!

রাস্তায় আর ল্যাম্পপোস্ট থাকবে না? বিকেল-শেষে সূর্য ডুবলেই এ বার ঘুটঘুটে অন্ধকারে রাস্তার দু’পাশে সাদা, হলুদ, নীলাভ আর সবুজ আলোয় জ্বলে উঠবে গাছ? আর ল্যাম্পপোস্ট লাগবে না? আগামী দিনে পথে পথে রাতে ‘গাছ’ই হয়ে উঠবে ‘ল্যাম্পপোস্ট’?

ছত্রাক যখন ‘ল্যাম্পপোস্ট’!

ছত্রাক যখন ‘ল্যাম্পপোস্ট’!

সুজয় চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১৭ জুলাই ২০১৬ ১১:২৬
Share: Save:

রাস্তায় আর ল্যাম্পপোস্ট থাকবে না?

বিকেল-শেষে সূর্য ডুবলেই এ বার ঘুটঘুটে অন্ধকারে রাস্তার দু’পাশে সাদা, হলুদ, নীলাভ আর সবুজ আলোয় জ্বলে উঠবে গাছ? আর ল্যাম্পপোস্ট লাগবে না? আগামী দিনে পথে পথে রাতে ‘গাছ’ই হয়ে উঠবে ‘ল্যাম্পপোস্ট’?

আর তা কোনও বড়সড় গাছও নয়। নয় এমন কিছু, যাকে বলে বৃক্ষ। সেই ‘গাছ’ আদতে কয়েকটি বিশেষ প্রজাতির ছত্রাক। জোনাকির মতো, কিছু কিছু সামুদ্রিক প্রাণীর মতো, বেশ কিছু অণুজীবের মতো কিছু কিছু ছত্রাক যে রাতে রীতিমতো আলো দিতে পারে, সেই আলো ছড়াতে পারে আশপাশে, এই প্রথম জানা গেল।

বিজ্ঞান-জার্নাল ‘কারেন্ট বায়োলজি’-র জুন সংখ্যায় গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হওয়ার পর এখন বিশ্বজুড়ে শুরু হয়ে গিয়েছে আলোড়ন। দুই মূল গবেষক সাইবেরিয়ার ‘ইনস্টিটিউট অফ বায়োফিজিক্স’-এর কনস্তানন্তিন পুর্তোভ ও মস্কোয় ‘ইনস্টিটিউট অফ বায়ো-অরগ্যানিক কেমিস্ট্রি’র ইলিয়া ইয়ামপোলস্কি দেখিয়েছেন, শুধু জোনাকি, মাশরুম বা কয়েকটি অণুজীবই নয়, রাতে, ঘুটঘুটে অন্ধকারে আলো জ্বালানোর চমকে দেওয়া ক্ষমতা রয়েছে কয়েকটি বিশেষ প্রজাতির ছত্রাকেরও। যা, আক্ষরিক অর্থেই, একটি বিরলতম ঘটনা।

ব্রাজিলে আমাজন নদীর তীর ধরে গভীর, গহন অরণ্যে ঢুকলে দেখা যায়, সেই জমাট বাঁধা, ঘুটঘুটে অন্ধকারে জোনাকির আলো জ্বলছে, নিভছে। আর সেই গভীর জঙ্গলের মাটিতে বিশাল বিশাল বৃক্ষের গোড়ার দিকে আলোর দ্যুতি বেরিয়ে আসছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মাশরুম থেকে। দু’টোরই কারণ- ‘বায়োল্যুমিনিসেন্স’। এই বিশেষ গুণটি এত দিন জানা ছিল, রয়েছে শুধুই কিছু প্রাণী আর কয়েকটি অণুজীবের মধ্যে। জীববিজ্ঞানীদের ব্যাখ্যা ছিল, মূলত দু’টি কারণে তাদের এই বিশেষ গুণটিকে কাজে লাগায় কিছু কিছু প্রাণী আর কয়েকটি অণূজীব। প্রথমত, ওই আলোর মাধ্যমে তারা প্রজননের আগে বিপরীত লিঙ্গকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে। দ্বিতীয়ত, প্রাণে বাঁচতে বড় ও হিংস্র প্রাণীর চোখ ওই আলো জ্বালিয়েই ধাঁধিয়ে দেয় তারা।


ছত্রাকের সেই মায়াবী আলো!

খ্রিস্টের জন্মের ৩৮২ বছর আগে দার্শনিক অ্যারিস্টটল ও বিশিষ্ট রোমান পণ্ডিত সিনিয়র প্লিনির কিছু লেখালেখির মধ্যে ছত্রাকের এই অদ্ভুতুড়ে আচার-আচরণের উল্লেখ পাওয়া যায়। তাঁরা দেখেছিলেন, গভীর জঙ্গলে ভিজে কাঠের গোড়া থেকে ঠিকরে বেরয় অদ্ভূত আলোর দ্যুতি! পরে ওই ‘ভুতুড়ে আলো’র নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ফক্স-ফায়ার’। যেখানে ‘ফক্স’ শব্দটি এসেছিল প্রাচীন ফরাসি ভাষার ‘ফয়েস’ শব্দ থেকে। যার অর্থ, ‘ভুয়ো’।

ছত্রাকের সেই মায়াবী আলো: দেখুন ভিডিও।

বছর কয়েক আগে ব্রাজিলের সাও পাওলো বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী স্টিফেন স্টেভানি দেখিয়েছিলেন, গভীর জঙ্গলে বড় বড় গাছগুলির গোড়ার দিকে মাটিতে গজানো মাশরুম থেকে যে আলোর দ্যুতি বেরিয়ে আসে, রাতবিরেতে, তা পতঙ্গদের সেখানে ছুটে আসতে আকৃষ্ট করে। আর সেই ‘মায়াবী’ আলোর টানেই ঝাঁকে ঝাঁকে পতঙ্গরা এসে সেখানে ছড়িয়ে যায় পরাগ-রেণু। স্টেভানি এটাও দেখিয়েছিলেন, কৃত্রিম ভাবে এলইডি আলো ফেলেও এই কাজটা কিছুতেই দিনে করানো যায় না। কাজটা হয় শুধু রাতেই, সূর্য ডোবার পর। পূর্ণিমা না থাকলে, ঘুটঘুটে অন্ধকার থাকলে কাজটা আরও ভাল ভাবে হয়। স্টেভানির ওই গবেষণা বিজ্ঞানীদের একটা ধরণাকে ভুল প্রমাণ করেছিল। সেটা হল- দিনে সালোকসংশ্লেষের পর বিপাকের সময়েই ওই ‘অপ্রয়োজনীয় আলো’র জন্ম হয়।


কে বলবেন, এটা ছত্রাক!

জানা ছিল, কিছু প্রাণী বা অণূজীবের কিছু কিছু ‘পিগমেন্ট’ই তাদের ওই অদ্ভুতুড়ে আলো-বিচ্ছুরণের ক্ষমতা দেয়। কিন্তু মাশরুম বা ছত্রাক কী ভাবে ওই আলোর জন্ম দেয়, তার কারণ এত দিন অজানাই ছিল।

ইয়ামপোলস্কি-পুর্তোভের গবেষণা সেখানেই আলোকপাত করেছে। তাঁরা দেখিয়েছেন, লুসিফেরিন নামে একটি বিশেষ ধরনের প্রোটিন রয়েছে ছত্রাক আর মাশরুমে। আলো জ্বালাতে পারে যে সব ছত্রাক, ওই প্রোটিন সেই সব ছত্রাকে তো রয়েছেই, যে ছত্রাকগুলো মোটেই আলো জ্বালাতে পারে না, তাদের মধ্যে ওই প্রোটিন রয়েছে আরও ১০০ গুণ বেশি। এই লুসিফেরিন এমন একটা প্রোটিন, যা বায়ুমণ্ডলের অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে, লুসিফেরেজ নামে একটি উৎসেচকের সাহায্যে। আর তখনই বেরিয়ে আসে নীলাভ-সবুজ আলো।


রুশ বায়ো-অরগ্যানিক কেমিস্ট ইলিয়া ইয়ামপোলস্কি।

তা হলে পরিমাণে অতটা বেশি লুসিফেরিন থাকা সত্ত্বেও কেন বহু ছত্রাক আলো জ্বালাতে পারে না একেবারেই?


মস্কো থেকে পাঠানো ইয়ামপোলস্কির ই-মেল জবাব।

ই-মেলে পাঠানো প্রশ্নের জবাবে মস্কো থেকে ইয়ামপোলস্কির ব্যাখ্যা, ‘‘শুধুই লুসিফেরিন থাকলে চলবে না, আলো জ্বালাতে গেলে একটা উৎসেচকও (এনজাইম) লাগে ছত্রাকের। তার নাম- লুসিফেরেজ। এটাই লুসিফেরিনকে বাতাসে পুড়তে সাহায্য করে। আর লুসিফেরিন বাতাসে ঠিক ভাবে পুড়তে পারলেই ছত্রাক আলো জ্বালাতে পারে। যেমন ভাবে, একটা গাড়ি চলে। যেখানে জ্বালানি (লুসিফেরিন) আর ইঞ্জিন (লুসিফেরেজ)- দু’টোরই দরকার। ইঞ্জিন না থাকলে জ্বালানি পুড়িয়ে যে শক্তিটা পাওয়া যাচ্ছে, সেটা দিয়ে গাড়িটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যেত না। চালানো যেত না। তাই প্রচুর পরিমাণে লুসিফেরিন থাকা সত্ত্বেও, সবকর্টি প্রজাতির ছত্রাক আলো জ্বালাতে পারে না। সে ক্ষেত্রে তাদের শরীর থেকে বাড়তি লুসিফেরিন তুলে এনে আমরা আলো জ্বালানোর ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলতে পারি অন্য ছত্রাকদের। এর ফলে, আগামী দিনে আমরা ল্যাম্পপোস্টের বদলে হয়তো রাস্তার দু’পাশে এই ছত্রাকদের দিয়েই আলোকস্তম্ভ বানাতে পারব। তাতে বিদ্যুতের চাহিদা অনেকটাই কমবে। শুধু তাই নয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে পড়ার ঘটনাও আর ঘটবে না। আর এখনও অনেক দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে তাপবিদ্যুতের ব্যবহার বেশি হওয়ার ফলে যে দূষণের সমস্যা থেকে যাচ্ছে, এই বিকল্প সেই সমস্যা থেকেও বেরিয়ে আসার পথ দেখাবে।’’

ব্রিটেনে ইতিমধ্যেই সেই স্বপ্নের ‘গ্লোয়িং প্ল্যান্ট প্রোজেক্ট’-এর প্রস্তুতি-প্রচার শুরু করে দিয়েছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জিনতত্ত্ববিদ জর্জ চার্চ।

আরও পড়ুন- তীব্র ভূমিকম্পের মুখে দুই বাংলা, মায়ানমার?


এখনও বলবেন, এটা ‘ল্যাম্পপোস্ট’ নয়?

ছবি ও ভিডিও সৌজন্যে: ‘ইনস্টিটিউট অফ বায়ো-অরগ্যানিক কেমিস্ট্রি’, মস্কো।

অন্য বিষয়গুলি:

How research into glowing fungi could lead to trees lighting our streets glowing plant project fungi glows
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy