Advertisement
E-Paper

মঙ্গল মুলুকে ১০ দিন অসহায়, নির্বান্ধব হবে ইসরো-নাসার ৬ যান

পৃথিবী থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে ‘লাল গ্রহ’-এ যাওয়া ইসরো ও নাসার ৬টি মহাকাশযান। গ্রাউন্ড কন্ট্রোল থেকে কোনও কম্যান্ডই ওই ১০ দিন পাঠানো যাবে না মঙ্গল মুলুকে যাওয়া মহাকাশযানগুলিকে। সেগুলি বিগড়ে গেলে গ্রাউন্ড কন্ট্রোল থে‌কে কোনও রকমের কম্যান্ড দিয়ে তাদের সচল করা যাবে না।

সুজয় চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০১৭ ১৫:২১
এই সেই মার্স সোলার কনজাঙ্কশন। ছবি- নাসা।

এই সেই মার্স সোলার কনজাঙ্কশন। ছবি- নাসা।


বিদেশে গিয়ে পরিবার, পরিজন, আত্মীয়স্বজনের থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে কেমন দিশেহারা একটা অবস্থা হয়। টানা ১০ দিনের জন্য ঠিক তেমন অবস্থাতেই পড়তে চলেছে ‘লাল গ্রহ’ মঙ্গলে যাওয়া ইসরো ও নাসার ৬টি মহাকাশযান। তারা মঙ্গল মুলুকে হয়ে পড়তে চলেছে একেবারেই অসহায়, নির্বান্ধব, স্বজনবিচ্ছিন্ন, অভিভাবকহীন। এবং সূর্যই তার কারণ। পৃথিবী আর মঙ্গলের মধ্যে যোগাযোগের সব ক’টি পথই ওই সময় রুখে দেবে সূর্য। আগামী শনিবার, ২২ জুলাই থেকে ১ অগস্ট পর্যন্ত। ইসরো ও নাসা সূত্রে এই খবর জানানো হয়েছে।

এই মুহূর্তে মঙ্গল মুলুকে রয়েছে ইসরোর ‘মঙ্গলায়ন’ বা, ‘মার্স অরবিটার মিশন’ (মম)। যা ‘লাল গ্রহ’কে ঘিরে ঘুরে চলেছে তার বিভিন্ন কক্ষপথে। রয়েছে নাসার আরও তিনটি অরবিটার— ‘মার্স ওডিসি অরবিটার’, ‘মার্স রিকনসাইন্স অরবিটার’ আর ‘মাভেন’। ওই তিনটিই বিভিন্ন কক্ষপথে ঘুরে চলেছে মঙ্গলের চার পাশে। রয়েছে নাসার দু’টি রোভারও। ‘অপরচ্যুনিটি’ ও ‘কিউরিওসিটি’। যারা মঙ্গলের মাটিতে নেমে তার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ঘুরে দেখছে, সেখানকার মাটি তুলছে, সেই মাটিতে কোন কোন পদার্থ মিশে রয়েছে, তা বিশ্লেষণ করছে।

মার্স সোলার কনজাঙ্কশনে কী হয়? দেখুন ভিডিও

পৃথিবী থেকে কোনও ‘চিঠি’ বা কোনও রকম ‘বার্তা’ই সেই সময় পৌঁছবে না মঙ্গলে। সেখান থেকে মহাকাশযানগুলির পাঠানো ‘সিগন্যাল’গুলিও আসার পথে বাধা পাবে, পদে পদে। পৃথিবী থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে ‘লাল গ্রহ’-এ যাওয়া ইসরো ও নাসার ৬টি মহাকাশযান। গ্রাউন্ড কন্ট্রোল থেকে কোনও কম্যান্ডই ওই ১০ দিন পাঠানো যাবে না মঙ্গল মুলুকে যাওয়া মহাকাশযানগুলিকে। সেগুলি বিগড়ে গেলে গ্রাউন্ড কন্ট্রোল থে‌কে কোনও রকমের কম্যান্ড দিয়ে তাদের সচল করা যাবে না। আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে, আগে থেকে পাঠানো কম্যান্ডগুলি যদি ঠিকঠাক ভাবে ‘ডিকোড’ করতে না পারে ওই মহাকাশযানগুলি, তা হলে গ্রাউন্ড কন্ট্রোল থেকে তাদের ভুলত্রুটিগুলি শুধরে দেওয়ার আর কোনও রাস্তাই খোলা থাকবে না বিজ্ঞানীদের সামনে। সে ক্ষেত্রে মঙ্গল মুলুকে গিয়ে মহাকাশযানগুলিকে কার্যত, স্থবির, অযান্ত্রিক হয়েও পড়ে থাকতে হতে পারে।

(ওপরে) ইসরোর ‘মঙ্গলায়ন’ বা ‘মম’, (নীচে) নাসার ‘মাভেন’

বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, আগামী ২২ জুলাই থেকে ১ অগস্ট পর্যন্ত আমাদের নীলাভ গ্রহটি সূর্যের থেকে যে অবস্থানে থাকবে, ‘লাল গ্রহ’ চলে যাবে ঠিক তার উল্টো দিকে। পৃথিবী থেকে দেখলে মনে হবে, মঙ্গল একেবারেই সূর্যের পিছনে চলে গিয়েছে। ‘লাল গ্রহ’কে আড়াল করে দাঁড়িয়েছে সূর্য। জ্যোতির্বিজ্ঞানের পরিভাষায়, এই ঘটনাটাকে বলে- ‘মার্স সোলার কনজাঙ্কশন’। ২৬ মাস অন্তর বা দু’বছর দু’মাস অন্তর সূর্যের চার পাশে মঙ্গলের আবর্তনের স্বাভাবিক নিয়মেই এটা ঘটে।


মার্স সোলার কনজাঙ্কশনে মঙ্গল (বাঁ দিকে) ও পৃথিবী

আর এই স্বাভাবিক নিয়মই দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায় মঙ্গল মুলুকে যাওয়া মহাকাশযানগুলির কাছে। বিজ্ঞানীদের কাছেও। কারণ, ওই সময় সূর্য আড়াল করে দাঁড়ানোয়, পৃথিবীর গ্রাউন্ড কন্ট্রোল রুম থেকে কোনও রকম কম্যান্ড পাঠানো যায় না মহাকাশযানগুলিকে। কোনও কম্যান্ড পাঠানো হলে তা আদৌ পৌঁছবে না মঙ্গলে। যে হেতু ‘লাল গ্রহ’-এর সামনে তখন দাঁড়িয়ে রয়েছে সূর্য। একই কারণে, মঙ্গল মুলুকে যাওয়া মহাকাশযানগুলিও তাদের জোগাড় করা তথ্যাদি, সিগন্যাল গ্রাউন্ড কন্ট্রোল রুমে পাঠাতে পারবে না, বাধাহীন ভাবে। মহাকাশযানগুলির পাঠানো সিগন্যালও বাধা পাবে, নানা ভাবে। যে কোনও মহাকাশযানকেই প্রতি সেকেন্ডে বা সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময়ে একেবারে ‘মায়ের নজরে’ রাখে গ্রাউন্ড কন্ট্রোল রুম। মহাকাশে নানা রকমের বিপদ-আপদ রয়েছে। রয়েছে মহাজাগতিক রশ্মি সহ নানা রকমের জানা ও অজানা হানাদারির ভয়ও! তাই গ্রাউন্ড কন্ট্রোল রুমের ‘নজরের বাইরে’ চলে গেলেই মহাকাশযানগুলির বিপদ বেড়ে যায়। স্বাভাবিক ভাবে উদ্বেগ বেড়ে যায় বিজ্ঞানীদেরও।

(ওপরে) নাসার ‘অপরচ্যুনিটি’ আর নীচে নাসার ‘কিউরিওসিটি’ রোভার

নাসার জেট প্রোপালসান ল্যাবরেটরি (জেপিএল) থেকে ‘মিশন কিউরিওসিটি’র অন্যতম দুই কার্যনির্বাহী সদস্য, মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতির্পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক চন্দ্র ভাস্কর রেড্ডি ও ধ্রুবজ্যোতি মুখোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘এটা খুবই কঠিন সময় আমাদের কাছে। মহাকাশযানগুলির কাছেও। এই সময় আমরা যদি কোনও কম্যান্ড পাঠানোর চেষ্টা করি মহাকাশযানগুলিতে, তা যে শুধুই লক্ষ্যে পৌঁছনোর ব্যাপারে অনিশ্চিত হবে, তা-ই নয়; সেই কম্যান্ডগুলি সূর্যের বাধায় ‘করাপ্ট’ (নষ্ট) করে যেতে পারে। সেই ‘নষ্ট’ হয়ে যাওয়া কম্যান্ড মহাকাশযানগুলিতে পৌঁছলে হিতে বিপরীত হতে পারে। মহাকাশযানগুলির রেডিও সিগন্যাল যোগাযোগ ব্যাবস্থাকে তা পুরোপুরি তছনছও করে দিতে পারে।’’

ইসরো সূত্রের খবর, আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে ওই সময়ের (মার্স সোলার কনজাঙ্কশন) জন্য মহাকাশযান ও রোভারগুলিকে কিছু প্রোগ্রাম (পড়ুন, মাটি থেকে পাঠানো নির্দেশ, গাইডলাইন) আগে থেকেই পাঠানো হয়েছে। একই ব্যবস্থা নিয়েছে নাসাও।

তার পরেও চিন্তার কারণ রয়েছে। কেন?

ধ্রুবজ্যোতিবাবুর কথায়, ‘‘মার্স সোলার কনজাঙ্কশনের সময় যদি সেই প্রোগ্রামগুলিকে ঠিক ভাবে ‘ডিকোড’ (পড়ুন, খুলতে বা বুঝতে) করতে না পারে মহাকাশযানগুলি, তখন তারা তো বিপদে পড়বেই। আর সেই অজানা, অচেনা বিপদের হাত থেকে মহাকাশযানগুলিকে বাঁচানোর কোনও উপায়ও থাকবে না বিজ্ঞানীদের হাতে। তবে মহাকাশযানগুলির টেলিমেট্রি ব্যবস্থা চালু থাকবে। যদিও সেখান থেকে আসা সিগন্যালগুলি ওই সময় কমজোরি হতে পারে। করাপ্টও হতে পারে।’’

সোলার কনজাঙ্কশন বলতে কী বোঝায়? দেখুন ভিডিও

তবে গ্রাউন্ড কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে মঙ্গল মুলুকে যাওয়া মহাকাশযান ও রোভারগুলির যোগাযোগ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার জন্য যে পৃথিবীর সাপেক্ষে মঙ্গলকে একেবারেই সূর্যের পিছনে চলে যেতে হবে, তা কিন্তু নয়। সূর্যের পৃষ্ঠভাগ ছাড়াও তার আর একটি অংশ রয়েছে। তার নাম ‘করোনা’। এটা আদতে সূর্যের বায়ুমণ্ডল। যা সূর্যের পিঠ (সারফেস) থেকে অনেক অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে রয়েছে। পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সময়েও যে ঢেকে যাওয়া সূর্যের আশপাশ থেকে অল্প-স্বল্প আলোর উঁকিঝুঁকি দেখতে পাওয়া যায়, তা সূর্যের ওই করোনার জন্যই। যা ভরা রয়েছে অসম্ভব গরম আর বিদ্যুৎবাহী কণায় (আধান বা চার্জড পার্টিকল) ভরা গ্যাসে।

(ওপরে) নাসার ‘মার্স রিকনসাইন্স অরবিটার’ আর নীচে নাসার ‘মার্স ওডিসি অরবিটার’

পুণের ইন্টার ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স (আয়ুকা)-র অধ্যাপক, ‘অ্যাস্ট্রোস্যাট’-এর সায়েন্স অপারেশনের প্রধান দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলছেন, ‘‘গ্রাউন্ড কন্ট্রোল থেকে মহাকাশযানগুলিকে নির্দেশ, গাইডলাইন প্রতি মুহূর্তে পাঠানো হয় আর মহাকাশযানগুলিও তাদের জোগাড় করা তথ্যাদি গ্রাউন্ড কন্ট্রোলে পাঠায় রেডিও সিগন্যালের (যা চলে রেডিও তরঙ্গের মাধ্যমে) হাত ধরে। সূর্যের করোনার ওই গ্যাস সেই রেডিও তরঙ্গের বিস্তারে বাধা দেয়। করোনার কণাগুলির সঙ্গে রেডিও তরঙ্গের লাগে ঠোকাঠুকি। সেখানেই বেঁকেবুঁকে, করাপ্ট করে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে রেডিও সিগন্যালগুলির।’’

আরও পড়ুন- ছায়াপথের ঝাঁক ‘সরস্বতী’ আবিষ্কার করলেন ভারতীয় বিজ্ঞানীরা

তবে এমন বিপদে পড়লে কী করণীয়, কী ভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়, ইসরো ও নাসা জানাচ্ছে, অতীতে থেকে সেই অভিজ্ঞতা ইতিমধ্যেই কয়েক বার নিয়েছে মহাকাশযানগুলি। এর আগে এমন ‘অগ্নিপরীক্ষা’য় ৭ বার উতরে গিয়েছে মার্স ওডিসি অরবিটার। ৬ বার উতরেছে রোভার অপরচ্যুনিটি, ৫ বার মার্স রিকন্যাইস্যান্স অরবিটারও। দু’বার পাশ করেছে কিউরিওসিটি রোভার আর এক বার মাভেন মহাকাশযান।

তবে অভিজ্ঞতাকেও কখনও সখনও হোঁচট খেতে হয়! অন্তত সেই সম্ভাবনাটা তো আর পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

তাই ওই দশ দিন মঙ্গল মুলুকে যাওয়া মহাকাশযানগুলির জন্য দুশ্চিন্তা থেকেই যাচ্ছে বিজ্ঞানীদের।

ছবি ও ভিডিও সৌজন্যে: নাসা ও ইসরো

Solar Mars Conjunction ISRO NASA MOM MAVEN OPPORTUNITY CURIOSITY মম কিউরিওসিটি মাভেন
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy