মানুষ সামাজিক জীব। তারা একা বাঁচতে পারে না। সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তোলাই তাদের স্বাভাবিক প্রবণতা। গবেষণা বলছে, সৃষ্টির আদি পর্ব থেকে মানুষের মস্তিষ্ক বিবর্তিতই হয়েছে সামাজিক বন্ধন গড়ার জন্য। তবে ঠিক কতগুলি সম্পর্কের ভার আমাদের মস্তিষ্ক সামলাতে পারে, তার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। মানুষের পক্ষে এক জীবনে খুব বেশি হলে ১৫০টি সম্পর্ক লালন করা সম্ভব, দাবি গবেষকদের।
মানুষের মস্তিষ্কের ওজন প্রায় ১.৩৬ কিলোগ্রাম, সাধারণ ভাবে দেহের ওজনের দুই শতাংশ। এই মস্তিষ্কের এক- তৃতীয়াংশ জুড়ে থাকে নিওকর্টেক্স অঞ্চল। স্মৃতিশক্তি, ভাষার বিকাশ, বিভিন্ন সমস্যার সমাধান এবং আত্মচেতনার জন্য মস্তিষ্কের এই অংশ দায়ী। এই অংশই মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, বন্ধুত্ব, আত্মীয়তা এবং সর্বোপরি ‘সামাজিকতা’কে নিয়ন্ত্রণ করে। বিজ্ঞানীদের মতে, সামাজিক বন্ধন আমাদের আয়ু বাড়িয়ে দেয়। মানুষ যত একে অপরের সঙ্গে মিশবে, কথা বলবে এবং সম্পর্ক গড়ে তুলবে, তত স্ট্রোক, অবসাদ, স্মৃতিবিভ্রম, হার্টের রোগের সম্ভাবনা কমবে। তত বেশি দিন মানুষ বাঁচতে পারবে।
আরও পড়ুন:
পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্য মানুষের সামাজিক বন্ধন প্রয়োজন। আবশ্যিকও বলা চলে। তবে তার সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। অগুন্তি সামাজিক বন্ধন আমরা গড়ে তুলতে পারি না। গবেষণা বলছে, এক জীবনে সর্বোচ্চ ১৫০ জনের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাঁদের কারও সঙ্গে সম্পর্ক বেশি ঘনিষ্ঠ হয়, কারও সঙ্গে কম। এ ছাড়া, সারা জীবনে যত জনকে আমরা চিনি, তার সংখ্যা হতে পারে হাজারের বেশি। তবে মানুষের সামাজিক ‘নেটওয়ার্ক’ সীমা ১৫০।
মানুষের আগে শিম্পাঞ্জি, বাঁদরদের নিয়ে এই সংক্রান্ত গবেষণা করে দেখা হয়েছে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, মস্তিষ্কের নিওকর্টেক্সের বিস্তৃতির উপরে সামাজিক নেটওয়ার্কের সীমা নির্ভর করে থাকে। শিম্পাঞ্জিদের ক্ষেত্রে এই সীমা ৫০-এ সীমাবদ্ধ। মানুষের নিওকর্টেক্সের আকার বড় বলে নেটওয়ার্কও বড়। ব্রিটিশ মনোবিদ রবিন ডানবার বিষয়টি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন। তাঁর মতে, মানুষের সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে ১৫০ সংখ্যাটি সৃষ্টির আদি পর্ব থেকেই এক। সমাজমাধ্যম এবং ডিজিটাল যোগাযোগের যুগেও তা বদলায়নি।
১৫০ জনের মধ্যে আমাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন অন্তত পাঁচ জন। সাধারণত বন্ধু বা পরিবারের সদস্য হয়ে থাকেন তাঁরা। আবেগগত দিক থেকে এঁদের আমরা সবচেয়ে কাছের বলে মনে করি। মনের সব কথা এই পাঁচ জনের সঙ্গে ভাগ করি। সপ্তাহে অন্তত এক বার এঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। এর বাইরে আমাদের আরও অন্তত ১০ জন বন্ধুর বৃত্ত থাকে, যাঁদের সঙ্গে মাসে অন্তত এক বার দেখা হয়। মোট এই ১৫ জন আমাদের সামাজিক মনোযোগের ৬০ শতাংশ পেয়ে থাকেন। বাকিদের জন্য পড়ে থাকে ৪০ শতাংশ।
গবেষণা বলছে, এই ১৫ জনের সঙ্গে আরও কিছু মানুষ মিলিয়ে মোট ৫০ জনের আর একটি বড় সামাজিক বৃত্ত তৈরি হয়। মাঝেমধ্যে দেখা করে হইহুল্লোড় করার মতো সম্পর্ক এঁদের সঙ্গে। তার বাইরে মনের তেমন কোনও যোগ এই বৃত্তের সঙ্গে থাকে না। সামাজিক যোগের এর পরের বৃত্তেই রয়েছে ১৫০ জন। খুব ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ না থাকলেও জীবনের বড় কোনও ঘটনায় বা অনুষ্ঠানে এঁদের আমন্ত্রণ জানানো যায়। এঁদের সঙ্গে সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ডানবার বলেছেন, ‘‘রাত ৩টেয় হংকং বিমানবন্দরে আচমকা এঁদের কারও সঙ্গে দেখা হলে পিঠ চাপড়ে দিতে আমরা দ্বিধা করব না।’’
জীবনের সব পর্বেই যে এই ১৫০ জন ধ্রুবক থাকবেন, তা নয়। সময় এবং পরিস্থিতির বিচারে এই বৃত্তের মানুষ পাল্টে যেতে পারেন। যাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাবে, ধীরে ধীরে তাঁরা আমাদের সামাজিক নেটওয়ার্কের বাইরে বেরিয়ে যাবেন। নতুন কেউ সেই স্থানে চলে আসবেন। পাড়ার লোকজন, অফিসের সহকর্মী এই বৃহত্তর বৃত্তের অঙ্গ।
১৫০ জনের বৃত্তের বাইরে আরও ৩৫০ জনের কথা বলেছেন ডানবার, যাঁদের সঙ্গে আমাদের পরিচয়মাত্র থাকে। কোনও অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানোর মতো সম্পর্ক নয়। এ ছাড়া সারা জীবনে আরও অন্তত ১০০০ জন থাকবেন, যাঁদের মুখ আমরা চিনি। যেমন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কিংবা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। আমরা এঁদের চিনলেও এঁরা আমাদের চেনেন না। ফলে এই পরিচিতি ‘একতরফা’।
ডানবারের এই ধারণার সঙ্গে অনেকে একমত হতে পারেন না। গবেষকদের একাংশের মতে, মানুষের সামাজিক যোগাযোগের সীমা ১৫০-তে বেঁধে দেওয়া সম্ভব নয়। তা ব্যক্তিবিশেষের উপর নির্ভর করে। বিশেষ করে সমাজমাধ্যমের যুগে পরিচিতি এবং সম্পর্কের পরিধি আরও বেড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক, মত বিশেষজ্ঞদের একাংশের।