Advertisement
E-Paper

ল্যাপটপ, ডেস্কটপের বিকল্প আসছে...

লিখছেন ‘শান্তিস্বরূপ ভাটনগর’ পুরস্কার বিজয়ী প্রথম মহিলা পদার্থবিজ্ঞানী অদিতি সেন দে।সেই সাধারণ কম্পিউটারের জায়গা নেবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার। যা পৃথিবীর এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে পাঠানো ই-মেলের গতিকেও বাড়িয়ে দেবে অন্তত কয়েকশো গুণ। মোবাইল ফোন বা ই-মেলে তথ্য বা ডেটাও ভরে রাখা যাবে অনেক বেশি পরিমাণে।

শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৯ ০৮:৩০
ইনসেটে, পদার্থবিজ্ঞানী অদিতি সেন দে।

ইনসেটে, পদার্থবিজ্ঞানী অদিতি সেন দে।

একটা সুবিশাল সংখ্যার মৌলিক গুণনীয়ক বের করতে গিয়ে যদি এখনকার কম্পিউটারের সময় লাগে ৪৫০ থেকে ৫০০ কোটি বছর, তা হলে তা কি সত্যি সত্যিই কোনও কাজে লাগতে পারে আমাদের? না, পারে না। কারণ, সেটাই তো পৃথিবীর বয়স। সভ্যতা বয়সে তো তার কাছে শিশুই!

ফলে, বাড়ি আর অফিস-আদালতে যে কম্পিউটার আমরা ব্যবহার করে চলেছি, তা দিয়ে খুব বেশি দূর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। লাগবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার। যার দৌলতে মোবাইল ফোন বা ই-মেলে তথ্য বা ডেটা ভরে রাখা যাবে অনেক বেশি পরিমাণে। অনেক বেশি দিন ধরে। অনেক বেশি সুরক্ষিত ভাবে।

সেই কোয়ান্টাম কম্পিউটার আমাদের সুরক্ষিত আর অসুরক্ষিত, দু’ধরনের যোগাযোগব্যবস্থাকেই করে তুলবে অনেক বেশি দক্ষ। এখনকার যাবতীয় প্রযুক্তিকেই অনেক বেশি উন্নত করে তোলা যাবে কোয়ান্টাম প্রযুক্তির মাধ্যমে।

যোগাযোগব্যবস্থা: কোনটা সুরক্ষিত? কোনটা অসুরক্ষিত?

এই কথাটা বলার পরেই যে প্রশ্নটা উঠবে, তা হল; কাকে বলে অসুরক্ষিত যোগাযোগব্যবস্থা? কাকেই বা বলা হয় সুরক্ষিত যোগাযোগব্যবস্থা?

রেডিও বা টেলিভিশনে আবহাওয়ার পূর্বাভাস, ইন্টারনেটে পরীক্ষার ফলাফলের ঘোষণা, বন্ধু, আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে টেলিফোনে কথোপকথন, আমাদের রোজকার জীবনের এই সব ঘটনাই অসুরক্ষিত যোগাযোগব্যবস্থার সেরা উদাহরণ। কেন এই ধরনের যোগাযোগব্যবস্থা অসুরক্ষিত? কারণ, এই ধরনের বার্তা পাঠানোর সময়, যিনি পাঠাচ্ছেন আর যাঁর উদ্দেশ্যে সেই বার্তা পাঠানো হচ্ছে, সেই দু’জনকে ছাড়াও ওই বার্তা কোনও তৃতীয় ব্যক্তিরও কানে পৌঁছতে পারে। যদিও তাতে সেই বার্তা-প্রেরক বা প্রাপক, কারওরই তেমন অসুবিধা হয় না। তাই সেই তথ্যের সুরক্ষাকে সুনিশ্চিত করারও তেমন প্রয়োজন হয় না।

‘ভাটনগর’ পুরস্কারের মেডেল নিচ্ছেন অদিতি সেন দে। ২৮ ফেব্রুয়ারি, দিল্লির বিজ্ঞান ভবনে

সুরক্ষিত যোগাযোগব্যবস্থার ক্ষেত্রে কিন্তু সেটারই প্রয়োজন হয় সবচেয়ে বেশি। সেখানে সবচেয়ে আগে দরকার হয় তৃতীয় ব্যক্তির অনুপ্রবেশ বন্ধ করা।

রোজকার জীবনে তার প্রয়োজন হয় কোথায় কোথায়? ইন্টারনেটের মাধ্যমে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে টাকা পাঠানোর সময়। সেনাবাহিনীর সদর দফতর থেকে রণক্ষেত্রে লড়াকু সেনা জওয়ানদের কাছে জরুরি বার্তা পাঠানোর সময়। সেই সময় ওই বার্তা তৃতীয় ব্যক্তির কানে পৌঁছলে বা চোখে পড়ে গেলেই ভয়ঙ্কর বিপদ।

আরও পড়ুন- ভানুমতীর খেল! একটা কণাই বদলে দিল আমাদের জীবন​

আরও পড়ুন- অন্যান্য প্রযুক্তির মতো, ইন্টারনেটও তার নিজস্ব বিপদ সঙ্গে নিয়ে এসেছে​

তাই এই ধরনের যোগাযোগব্যবস্থার ক্ষেত্রে সবচেয়ে আগে প্রয়োজন তথ্যের সুরক্ষার। যাতে সেই তথ্যের দেওয়ানেওয়াটা শুধুই সীমাবদ্ধ থাকে বার্তা-প্রেরক আর প্রাপকের মধ্যে। আর কেউ যেন সেই বার্তায় নাক না গলাতে পারে।

এখনকার কম্পিউটারের সীমাবদ্ধতা কোথায়?

এখনকার কম্পিউটার আমাদের খুবই কাজে লাগছে ঠিকই, কিন্তু যোগাযোগব্যবস্থাকে দ্রুততর ও আরও বেশি সুরক্ষিত করে তোলার জন্য সাধারণ কম্পিউটারের একটি সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

কারণ সেই সাধারণ কম্পিউটারগুলি চলে ক্লাসিকাল মেকানিক্স বা ক্লাসিকাল ইনফর্মেশন থিয়োরির নিয়মকানুন মেনে। তাই বিশ শতকের গোড়ার দিক থেকেই নানা রকমের সমস্যায় পড়ছিলেন বিজ্ঞানীরা। জটিল গাণিতিক ফলাফলের ব্যাখ্যা তাঁরা দিতে পারছিলেন না। ফলে, সেই ফলাফল থেকে গবেষণাকে তাঁরা এগিয়েও নিয়ে যেতে পারছিলেন না।

কী ভাবে চলে কোয়ান্টাম কম্পিউটার, দেখুন ভিডিয়ো

কেন সমস্যায় পড়তে শুরু করলেন বিজ্ঞানীরা?

বিজ্ঞানীরা দেখলেন, ক্লাসিকাল নীতি মেনে সূর্য, তারা, গ্রহ, উপগ্রহরা যে ভাবে চলাফেরা করে, সেই একই নিয়মকানুন মেনে চলে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা বা কণিকারাও। তাঁরা আবার এটাও দেখলেন, অণু, পরমাণু বা তার চেয়েও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা বা কণিকাদের আচার, আচরণ, মতিগতি ক্লাসিকাল মেকানিক্স দিয়ে সব সময় ব্যাখ্যাও করা যাচ্ছে না।

সেখান থেকেই জন্ম নিল আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের নতুন একটি ধারা। কোয়ান্টাম মেকানিক্স বা কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান। শুধু মাত্র অনুবীক্ষণের নিচেই যে ধরনের কণা বা কণিকাকে দেখা যায় বা যা না, অথবা তাদের অস্তিত্ব উপলব্ধি করা যায়, স্থির ও গতিশীল অবস্থাতেও তাদের আচার, আচরণ, মতিগতিকে প্রথম সঠিক ভাবে ব্যাখ্যা করতে পারল বিজ্ঞানের সেই নবতম ধারা কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান।

তার ফলে, আশায় বুক বাঁধতে শুরু করলেন বিজ্ঞানীরা। তা হলে হয়তো এ বার ওই কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাহায্যে আরও অনেক বেশি উন্নত প্রযুক্তিও বানানো সম্ভব হবে। যা সাধারণ কম্পিউটারের ওই সীমাবদ্ধতাগুলিকে দূর করতে সাহায্য করবে। যোগাযোগব্যবস্থাকে করে তুলতে পারবে অনেক বেশি সুরক্ষিত ও দক্ষ।

কেন এতটা আশাবাদী বিজ্ঞানীরা?

আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে এখনও পর্যন্ত আমরা যে ধরনের কম্পিউটার ব্যবহার করে চলেছি, সেগুলোর কাজকর্মে যে একক বা ইউনিট ব্যবহৃত হয়, তার নাম ‘বাইনারি ডিজিট’। যাকে সংক্ষেপে বলা হয়, ‘বিট্‌স’। সেই ‘বিট্‌স’-কে প্রকাশ করা যায় শুধুই দু’ভাবে। তার শুধুমাত্র দু’টি মান রয়েছে। শূন্য (০) আর এক (১)।

কোনও পদার্থের যদি দু’টি অবস্থা থাকে আর সেই দু’টি অবস্থাকে যদি আলাদা ভাবে বোঝা যায়, তা হলে, তার একটি অবস্থানকে শূন্য (০) আর অন্য একটি অবস্থানকে এক (১) দিয়ে চিহ্নিত করা যেতে পারে। কিন্তু কোনও সময়ে যদি সেই পদার্থের দু’টি অবস্থাকে আলাদা ভাবে বোঝা না যায়, তা হলে, সেটা ব্যাখ্যা করতে পারে কোয়ান্টাম মেকানিক্সই।

ওই দু’টি মান বা সংখ্যা দিয়েই আমাদের রোজকার জীবনে ব্যবহৃত যাবতীয় কম্পিউটার সব কিছুর যোগ, বিয়োগ আর গুণ, ভাগ করে। যাবতীয় তথ্যের সংরক্ষণ করে। করে বিভিন্ন গাণিতিক সমস্যার সমাধানও।

গুগলের ৫০ কিউবিটের কোয়ান্টাম কম্পিউটার

যেমন, আমরা যদি ২ বা ৩ লিখি বা তাদের যোগফল বা গুণফল নির্ণয় করতে চাই, তা হলে এখনকার কম্পিউটারগুলি আগে সেই ২ বা ৩ সংখ্যাটিকে ‘বিট্‌স’-এ রূপান্তরিত করবে। ২ সংখ্যাটিকে ‘বিট্‌স’-এ লিখলে দাঁড়ায় ‘১০’। মানে, ১ আর তার পাশে একটা শূন্য।

আর ৩ সংখ্যাটাকে সাধারণ কম্পিউটারগুলি ‘বিট্‌স’-এ লিখবে কি ভাবে জানেন? ‘১১’। মানে, একটা ১-এর পাশে আরও একটা ১।

ক্লাসিকাল ইনফর্মেশন থিয়োরি অনুযায়ী, যে কোনও পূর্ণ সংখ্যাকে শুধুই শূন্য (০) আর এক (১)-এর সমাহারে প্রকাশ করা সম্ভব।

কাকে বলে সুপার পজিশন প্রিন্সিপাল?

কোয়ান্টাম মেকানিক্স জগৎটাকে আদৌ ক্লাসিকাল মেকানিক্সের চোখে দেখে না। দেখতে চায়ও না। তাই ক্লাসিকাল মেকানিক্সের সঙ্গে তার মতেও মেলে না। কোয়ান্টাম মেকানিক্স বলে, অণু, পরমাণু বা যে কোনও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা বা কণিকার বিভিন্ন অবস্থাকে ‘০’ এবং ‘১’ দিয়ে চিহ্নিত করা যেতে পারে, এটা যেমন ঠিক, তেমনই ঠিক, সেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা বা কণিকারা একই সঙ্গে থাকতে পারে দু’টি অবস্থানে। একই সময়ে। তা ‘০’ হতে পারে, আবার একই সঙ্গে হতে পারে ‘১’।

গুগলের ৭২ কিউবিটের কোয়ান্টাম কম্পিউটার

এই ‘সুপার পজিশন প্রিন্সিপাল’-এর উপর দাঁড়িয়েই নতুন ধরনের কম্পিউটার বানিয়ে অত্যন্ত জটিল গাণিতিক ধাঁধার জট অত্যন্ত দ্রুত গতিতে খোলার চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীরা। আর তারই মাধ্যমে আমাদের যোগাযোগব্যবস্থাকে অনেক বেশি সুরক্ষিত ও দ্রুততর করে তোলার স্বপ্নটা দেখতে পারছেন। কম্পিউটারের মগজ আরও জোরালো করে তোলার ভাবনাটা ভাবতে পারছেন।

সাধারণ কম্পিউটার যেমন চলে ‘বিট্‌স’-এর ভিত্তিতে, তেমনই সেই কোয়ান্টাম কম্পিউটার চলবে ‘কোয়ান্টাম বিটস’ বা ‘কিউবিট্‌স’(qubits)-এর উপর দাঁড়িয়ে।

কিউবিট বলতে কী বোঝানো হয়?

পৃথিবীর চেহারাটা আদতে একটি গোলকের মতো। সেই গোলকের উত্তর আর দক্ষিণ মেরুকে যদি শূন্য (০) আর এক (১) বিট বলে ধরা হয়, তা হলে সেই গোলকের যে কোনও বিন্দু (পয়েন্ট) একটি কিউবিটের অবস্থানের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। যার অর্থ, সেই বিন্দুটি শূন্য (০)-ও নয়, আবার এক (১)-ও নয়। অথচ, একই সঙ্গে শূন্য (০) এবং এক (১)-ও। এটাই হল, শূন্য (০) এবং এক (১)-এর সুপার পজিশন।

এর ফলে কী হতে পারে, জানেন?

এরই সাহায্যে উন্নত যোগাযোগব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে অনেক বেশি তথ্যের আদানপ্রদান সম্ভব হবে। আর এইখানেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা কিউবিটের। যা কোয়ান্টাম কম্পিউটারকে আরও বেশি তথ্য সঞ্চয় করে রাখতে সাহায্য করবে। বাড়াবে তাদের কর্মক্ষমতা। যাতে যে সমস্যাগুলির সমাধান এখনকার কম্পিউটারে করা যাচ্ছে না, সেগুলি কোয়ান্টাম কম্পিউটার দিয়ে করা যায়।

এটাই এখন বিশ্বের বিজ্ঞানীদের কাছে সবচেয়ে কাঙ্খিত বিষয়।

সহজেই মুশকিল আসান!

কোয়ান্টাম মেকানিক্সের হাতে এই অত্যন্ত শক্তিশালী অস্ত্র রয়েছে, এটা জানার পর বিজ্ঞানীদের উৎসাহ আরও বেড়ে গেল। তাঁরা এ বার আরও একটি জটিল প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে শুরু করলেন। তা হলে কি এ বার সুবিশাল কোনও পূর্ণ সংখ্যার (ইন্টিজার) মৌলিক গুণনীয়ক (প্রাইম ফ্যাক্টর) খুব সহজে জানিয়ে দিতে পারবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার? আমাদের সাধারণ কম্পিউটারে এখনও পর্যন্ত এই গাণিতিক সমস্যার সমাধান করা প্রায় অসম্ভবই।

আজ থেকে ২৫ বছর আগে বিজ্ঞানীদের সেই উদ্বেগও কমিয়ে দিলেন মার্কিন বিজ্ঞানী পিটার শোর। তিনি দেখিয়ে দিলেন ২৫০টি অঙ্কের (ডিজিট) একটি পূর্ণ সংখ্যার মৌলিক গুণনীয়ক কোয়ান্টাম কম্পিউটার বের করে ফেলতে পারে অনেক কম ও গ্রহণযোগ্য সময়েই। যা আমাদের এখনকার সবচেয়ে শক্তিশালী কম্পিউটারেরও কষে বের করতে সময় লাগত ততটাই, যতটা এই পৃথিবীর বয়স। ৪৫০ থেকে ৫০০ কোটি বছর! যা একেবারেই বাস্তবসম্মত হতে পারে না।

কিন্তু পিটার শোরই প্রথম দেখিয়েছিলেন, এই সমস্যার সমাধান কোয়ান্টাম কম্পিউটার করে ফেলতে পারে ন্যায়সঙ্গত সময়েই। যাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে, ‘পলিনোমিয়াল টাইম’। এই আবিষ্কার বিশ্বে সত্যি সত্যিই একটি বড় ধরনের আলোড়ন তুলে দিল।

আমূল বদলে যাবে যোগাযোগব্যবস্থা?

কোয়ান্টাম কম্পিউটারের প্রয়োজন আমাদের জীবনে কতটা, আর সেটা কত তাড়াতাড়ি আমাদের ব্যবহার্য হয়ে ওঠা দরকার, শোরের আবিষ্কার তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। তার প্রভাব পড়ল আমাদের যোগাযোগব্যবস্থার উপরেও।

আইবিএম-এর কোয়ান্টাম কম্পিউটার

কারণ, এই যোগাযোগব্যবস্থার সুরক্ষা সুনিশ্চিত হয় ওই গাণিতিক সমস্যার (বড় ডিজিটের সংখ্যার মৌলিক গুণনীয়ক নির্ণয়) জটিলতার উপর ভিত্তি করেই।

শোরে আবিষ্কার এখনকার যোগাযোগব্যবস্থাকে করে তুলল অসুরক্ষিত। কী ভাবে?

একটা উদাহরণ দিই। ধরুন, ‘এ’ আর ‘বি’, দু’জনের হাতে রয়েছে এখনকার সাধারণ কম্পিউটার। তাঁরা একে অন্যকে মেসেজ বা ই-মেল পাঠাচ্ছেন। যা ‘এ’ বা ‘বি’ ছাড়া আর কেউই দেখতে পাচ্ছেন না, তাঁদের কাছেও সাধারণ কম্পিউটার রয়েছে বলে। কিন্তু যদি সেখানে ‘সি’ থাকেন, যাঁর কাছে রয়েছে কোয়ান্টাম কম্পিউটার, তিনি পারবেন, এ’ আর ‘বি’-র মধ্যে কী কী মেসেজ বা ই-মেল চালাচালি হয়েছে, তা পড়ে ফেলতে!

ফলে, রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা থেকে ব্যাঙ্ক-সহ যাবতীয় ব্যবসায়িক লেনদেনকে করে তুলবে অসুরক্ষিত।

হিতে বিপরীত হবে না তো?

প্রশ্ন উঠল, তা হলে কি হিতে বিপরীত হবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার চালু হলে?

ঘটনা হল, তার উত্তর খোঁজার ভাবনাটা কিন্তু বিজ্ঞানীরা পিটার শোরের অনেক আগেই ভাবতে শুরু করেছিলেন। কাজও শুরু করেছিলেন সেই ভাবনার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে।

তিন বিজ্ঞানী চার্লস বেনেট, গিল্‌স ব্রাসার্ড ও আর্থার একার্ট ১৯৮৪ এবং ১৯৯১ সালেই প্রথম দেখালেন, কোয়ান্টাম মেকানিক্সই পারে আমাদের সেই উদ্বেগ থেকে পুরোপুরি মুক্ত করতে।

সমস্যা ফুঁয়ে ওড়াতে পারে কোয়ান্টাম মেকানিক্সই

ইন্টেল-এর ৪৯ কিউবিটের কোয়ান্টাম কম্পিউটার চিপ

তাঁরা দেখালেন, কোয়ান্টাম মেকানিক্স দিয়েই এমন একটি সংকেতলিপি (কোড) বানানো সম্ভব, যা কোয়ান্টাম কম্পিউটারও ভাঙতে পারবে না। ফলে, তথ্যের আদানপ্রদান বা যোগাযোগব্যবস্থার সুরক্ষাকে অনিশ্চয়তার মুখে পড়তে হবে না কোয়ান্টাম কম্পিউটারের জমানা এলেও। তার ফলে, এখন গোটা বিশ্বের বিজ্ঞানী ও কম্পিউটার প্রযুক্তিবিদদের দৃঢ় বিশ্বাস, কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাহায্যেই আমাদের এখনকার কম্পিউটার আর কম্পিউটার-কেন্দ্রিক আমাদের জীবনের অত্যাবশ্যকীয় জিনিসগুলিকে আরও অনেক বেশি দক্ষ করে তুলতে সাহায্য করবে। আর শুধু সেই বিশ্বাসই নয়, তাকে বাস্তবায়িত করতে ইতিমধ্যেই কোমর বেঁধে মাঠে নেমে পড়েছে গুগল, আইবিএম এবং ইন্টেল-এর মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বহুজাতিক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলি। তারই ফলশ্রুতিতে ছোট মাপের কোয়ান্টাম কম্পিউটারও বানিয়ে ফেলা হয়েছে।

চিন এগিয়েছে, আমরাও নেমে পড়েছি পথে...

শুধুই কম্পিউটারের গণ্ডিতে আটকে না থেকে দু’টি শহরের মধ্যে যোগাযোগব্যবস্থাকে আরও উন্নত ও সর্বাধুনিক করে তোলার কাজও শুরু হয়ে গিয়েছে কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে হাতিয়ার করে। ঘরের কাছেই রয়েছে সেই দৃষ্টান্ত। চিন দেখিয়েছে, এক হাজার কিলোমিটার দূরে থাকা দুই শহরের মধ্যে যোগাযোগব্যবস্থাকে কী ভাবে উন্নত করে ফেলা যায়, কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে ব্যবহার করে। এর জন্য তারা সাহায্য নিয়েছে কক্ষপথে থাকা উপগ্রহের।

এ বার এই পদ্ধতিকে চিন ও ইউরোপের দেশগুলির মধ্যে তথ্যের আদানপ্রদানের ক্ষেত্রেও কাজে লাগানোর উদ্যোগ শুরু হয়েছে। ভারতেও তার প্রস্তুতিতে নেমে পড়েছেন বিজ্ঞানী, গবেষক ও কম্পিউটার প্রযুক্তিবিদরা। সেই কর্মযজ্ঞ ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে কলকাতা, মুম্বই, চেন্নাই, দিল্লি, বেঙ্গালুরু, ভূবনেশ্বর, আমদাবাদ, ইলাহাবাদ (প্রয়াগরাজ)-সহ বিভিন্ন শহরে।

ইলাহাবাদে হরীশ চন্দ্র রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষকদল

গত ১০ বছর ধরে আমি যেখানে কাজ আর গবেষণা করে চলেছি, ইলাহাবাদের (অধুনা, প্রয়াগরাজ) সেই হরীশচন্দ্র রিসার্চ ইনস্টিটিউটে (এইচআরআই) অধ্যাপক উজ্জ্বল সেন ও অধ্যাপক অরুণ কুমার পতির নেতৃত্বে ২০ জনের একটি গবেষকদল এ ব্যাপারে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গবেষণা করেছে। যা আগামী দিনে আমাদের দেশে কোয়ান্টামভিত্তিক তথ্যপ্রযুক্তি নির্মাণের ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।

আমূল পরিবর্তন ঘটাতে পারে যাবতীয় যোগাযোগব্যবস্থারও। গত ডিসেম্বরে আমাদের ইনস্টিটিউটে (এইচআরআই) হয়েছিল একটি আন্তর্জাতিক কর্মশালা। যেখানে হাজির হয়েছিলেন জার্মানির বিশিষ্ট বিজ্ঞানী হ্যারল্ড ওয়েনফুর্টার। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মাধ্যমে যোগাযোগব্যবস্থাকে উন্নত করার ক্ষেত্রে যাঁর অবদান আন্তর্জাতিক মহলে স্বীকৃত। এসেছিলেন পাওয়েল হরোডেক্কি ও ক্যারোল হরোডেক্কির মতো এ ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক বিজ্ঞানীরা। কী দিয়ে সবচেয়ে উন্নত মানের কোয়ান্টাম কম্পিউটার বানানো যায়, সে ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য যিনি সর্বজনগ্রাহ্য, এসেছিলেন স্পেনের সেই বিজ্ঞানী ম্যাচেক লেভেনস্টাইনও। সঙ্গে ছিলেন কলকাতার এস এন বোস সেন্টারের অর্চণ মজুমদার ও সিঙ্গাপুরের মানস মুখোপাধ্যায় ও বেঙ্গালুরুর অনিল কুমারের মতো বিশিষ্ট বিজ্ঞানীরাও।

আমাদের দেশে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানই নিয়মিত ভাবে এই ধরনের কর্মশালা ও সম্মেলনের আয়োজন করে। যাতে নিত্য়নতুন গবেষণার ফলাফল নিয়ে আলোচনা হতে পারে। ছাত্রছাত্রীরা সেই সব জানতে পারেন। সংশ্লিষ্ট গবেষণার গতি বাড়াতে সম্প্রতি ভারত সরকার ও কয়েকটি বেসরকারি সংস্থাও বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। আগামী দিনে, তা আরও বাড়বে।

লেখিকা ইলাহাবাদের হরীশচন্দ্র রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এইচআরআই) অধ্যাপক

কৃতজ্ঞতা স্বীকার: অধ্যাপক অমিত কুমার পাল ও অধ্যাপক শিলাদিত্য মাল

Quantum Computer Aditi Sen De Quantum Bits Qbits কোয়ান্টাম কম্পিউটার অদিতি সেন দে কিউবিট্‌স
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy