৪১ বছর আগের এক এপ্রিলের সন্ধ্যা। ভারতীয় সময় ৬টা ৮ মিনিট ৪৫ সেকেন্ডে তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ার বৈকানুর মহাকাশ কেন্দ্র থেকে উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল সয়ুজ টি-১১ মহাকাশযানকে। সেই অভিযানেই প্রথম মহাশূন্যে পাড়ি দিয়েছিলেন কোনও ভারতীয়। বায়ুসেনার তৎকালীন স্কোয়াড্রন লিডার রাকেশ শর্মা। ভারতীয় মহাকাশচর্চার ইতিহাসের যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে থাকা এক চরিত্র।
যুগসন্ধিক্ষণই বটে। এক দিকে ডানা মেলছে ১৫ বছরের ‘কিশোর’ ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ইসরো)। অন্য দিকে, দাঁত-নখ বার করেছে পঞ্জাবের খলিস্তানি আন্দোলন। নিত্যদিনই হত্যার খবর মিলছে। বিজ্ঞানের অগ্রগতি এবং বিচ্ছিন্নতাবাদ—দেশের এই বিপ্রতীপ পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর পদে ইন্দিরা গান্ধী। জরুরি অবস্থা মানুষের মন থেকে ফিকে না হলেও ফের সিংহাসনে ফিরেছেন তিনি। দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে এসেছেন ছোট ছেলে রাজীব। কলকাতা তখন ডিসি (পোর্ট) বিনোদ মেহতার হত্যাকাণ্ড নিয়ে তোলপাড়। কে জানত এর পরেই ঘটবে অপারেশন ব্লু স্টার, ইন্দিরা হত্যা, রাজীবের প্রধানমন্ত্রিত্ব।
দেশের এই টালমাটাল পরিস্থিতিতে সোভিয়েতের সঙ্গে যৌথ ভাবে মহাকাশে পাড়ি দেওয়া রাকেশের। সেই অভিযানে আরও একজন ছিলেন। রাকেশের সতীর্থ, বায়ুসেনার স্কোয়াড্রন লিডার রবীশ মলহোত্র। দু’জনের প্রশিক্ষণ নিলেও শেষমেশ রুশ মহাকাশ গবেষণা সংস্থা রসকসমস বেছে নেয় রাকেশকেই। মিশন কন্ট্রোল রুমে সোভিয়েতে তৎকালীন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত সৈয়দ নুরুল হাসানের পাশে বসে সতীর্থের অভিযান দেখেছিলেন রবীশ।
বলা হয়, রাকেশ শুধু একা মহাকাশে যাননি। গোটা দেশই যেন তাঁর সঙ্গে মহাকাশে গিয়েছিল। উদ্দীপনা এতই ছিল যে খবরের কাগজের পাতায়, আকাশবাণী, দূরদর্শনের খবরে রাকেশই ছিলেন আলোচনার বিষয়। মহাকাশে বসে থাকা রাকেশের সঙ্গে কথা বলতে দিল্লিতে আকাশবাণীর সদর দফতরে গিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। সেই কথোপকথন তো ইতিহাস! ইন্দিরা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, মহাকাশ থেকে ভারতকে কেমন দেখাচ্ছে? (উপর সে ভারত ক্যায়সা দিখতা হ্যায় আপকো?)
রাকেশ শর্মার মহাকাশযাত্রার খবর ১৯৮৪-র ৪ এপ্রিলের আনন্দবাজারে।
মহাকাশকেন্দ্রে বসে থাকা রাকেশ জবাব দিয়েছিলেন, ‘‘...সারে জঁহা সে আচ্ছা।’’ মাটিতে থাকা দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মহাকাশে থাকা দেশের প্রথম নভশ্চরের কথোপকথন চলেছিল। রাকেশের শরীর কেমন আছে, দেশের মানুষকে কিছু বলতে চান কি না ইত্যাদি জানতে চেয়েছিলেন ইন্দিরা। রাকেশের মহাকাশে যাওয়াকে কংগ্রেস ভোটে ব্যবহার করবে কি না, তা নিয়ে টিপ্পনীও চলেছিল। খবরের কাগজে ব্যঙ্গচিত্র বেরিয়েছিল যে কংগ্রেসের ভোটে ‘তুরুপের তাস’ হতে পারেন রাকেশ। শেষমেশ তেমন হয়নি। পরবর্তী সময়ে কংগ্রেসের ভোটের পালে হাওয়া নয়, ঝড় বয়েছিল ইন্দিরা আবেগে।
মহাকাশ থেকে দেওয়া রাকেশের জবাব থেকে উঠে এসেছিল নানা ‘অজানা’ তথ্যও। মহাশূন্যে স্যালিউট মহাকাশ কেন্দ্রের সঙ্গে গিয়ে জুড়ে গিয়েছিল সয়ুজ টি-১১। রাকেশ জানিয়েছিলেন, সেখানে থাকা নভশ্চরেরা রাকেশদের জন্য খাবার তৈরি করে টেবিলে রেখেছিলেন। রাখা ছিল প্লাস্টিকের ফুল।
দেশের প্রথম নভশ্চরের মহাশূন্যে দিনযাপনের খুঁটিনাটিও ছিল সে সময় সংবাদের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তা থেকেই জানা যায়, রাকেশ-সহ তিন মহাকাশচারীর জন্য মাংস, পরিজ, পনির, রুটি, ফলের রস, স্যুপ-সহ ১০৩ রকমের খাবার পাঠানো হয়েছিল। প্রতি দিনের খাদ্য তালিকাও ছিল আলাদা। মহাকাশে গিয়ে প্রাণায়াম ছাড়াও পদহস্তাসন, ত্রিকোণাসন, উষ্ট্রাসনের মতো যোগব্যায়ামও করেছিলেন। সাত দিন মহাকাশে কাটিয়ে, উৎকণ্ঠার অবসানে পৃথিবীতে ফিরেছিলেন রাকেশ। অশোক চক্র, সোভিয়েতের ‘হিরো অব দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন’ পুরস্কার পেয়েছিলেন।
পরবর্তী সময়ে রাকেশ অবশ্য অনেকটাই অন্তরালে চলে গিয়েছিলেন। শুধু বইয়ের পাতায় এবং আশির দশকে বড় হয়ে ওঠা মানুষদের স্মৃতিতেই ছিলেন তিনি। কিন্তু ইসরো মহাকাশে নাগরিক পাঠানোর প্রকল্প ‘গগনযান’ ঘোষণার পরেই ফিরে এসেছেন তিনি। কখনও সখনও সংবাদ, সমাজমাধ্যমেও দেখা যায় প্রচারবিমুখ রাকেশকে। বুধবারও ভেসে উঠেছেন তিনি। ‘উত্তরসূরি’ শুভাংশু শুক্লকে বলেছেন, ‘‘...যত পারবে জানলা দিয়ে বাইরে দেখো। আনন্দে কাটিয়ো..।’’
মহাকাশে দেশের হয়ে চোখ মেলেছিলেন রাকেশ। শুভাংশুর চোখে ধরা দেবে আরও বড় আকাশ।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)