মৃতদেহের উপর বনবন করে ঘোরে ওরা! নীলচে সবুজ রঙের মাছি। কিন্তু ওরাই যেন প্রকৃতির নিজের হাতে তৈরি করা এক এক জন ‘ব্যোমকেশ’, ‘ফেলুদা’। মৃত্যুরহস্য উন্মোচনে ওদের জুড়ি মেলা ভার। দেখতে নীলচে সবুজ রঙের। কোনও প্রাণীর কখন মৃত্যু হয়েছে, তা নির্ভুল ভাবে ধরিয়ে দেবে এমনই মাছিদের জিন। প্রাণীদেহের ময়নাতদন্তকে যা আরও সহজ করে তুলবে। সম্প্রতি এক গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণা হয়েছে এই পশ্চিমবঙ্গেই।
দেহের ময়নাতদন্তের ক্ষেত্রে ‘ব্লো ফ্লাই’-এর গুরুত্ব আগেও ছিল। কারণ, কোনও প্রাণীর মৃতদেহ পড়ে পড়ে পচতে শুরু করলে তাতে প্রথম বাসা বাঁধে এই মাছি। ওই পচন ধরা দেহে ডিম পাড়ে তারা। আগে প্রাণীদের মৃত্যুর সময় জানতে এই ধরনের মাছির প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হত। ফলে ময়নাতদন্তের প্রক্রিয়াতেও কিছুটা সময় লেগে যেত। এ বার সেই সমস্যা দূর করবে মাছির ডিএনএ বিশ্লেষণ। ‘ব্লো ফ্লাই’-এর ডিএনএ বারকোডিং (প্রজাতি শনাক্ত করার জন্য ডিএনএ বিশ্লেষণের এক বিশেষ প্রক্রিয়া) করে জানা যাবে কোনও প্রাণীর কখন মৃত্যু হয়েছে। যদিও মানবদেহের ময়নাতদন্তের ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়া এখনও পরীক্ষিত নয়।
কলকাতায় অবস্থিত ভারতীয় প্রাণী সর্বেক্ষণ (জ়্যুলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া)-এর গবেষকেরা সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ২৯৭৭টি ‘ব্লো ফ্লাই’ সংগ্রহ করেন। ভৌগোলিক এবং জলবায়ুগত দিক থেকে রাজ্যকে মোট চারটি ভাগে ভাগ করেন তাঁরা। দার্জিলিং-কালিম্পঙের পার্বত্য অঞ্চল, বাঁকুড়া-বীরভূম-পুরুলিয়ার রাঢ় অঞ্চল, হাওড়া-হুগলি-নদিয়া-মুর্শিদাবাদের গাঙ্গেয় সমভূমি এবং পূর্ব মেদিনীপুর-দক্ষিণ ২৪ পরগনার উপকূলীয় অঞ্চল— এই চারটি পৃথক অঞ্চল থেকে মাছির নমুনা সংগ্রহ করেন তাঁরা।
ব্লো ফ্লাই। ছবি: ভারতীয় প্রাণী সর্বেক্ষণ থেকে নেওয়া।
প্রাথমিক ভাবে মাছ, ইঁদুর, মুরগি— এই সব প্রাণীর দেহ নিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে। গবেষকেরা রাজ্যের চারটি অঞ্চলেই বিভিন্ন জায়গায় মৃত মাছ, ইঁদুর, মুরগি ফেলে রেখেছিলেন। পড়ে থাকতে থাকতে ওই দেহগুলি পচতে শুরু করে। গবেষকেরাও টানা নজর রাখতে থাকেন ওই মৃত প্রাণীর উপর। এ ভাবে ১০-১৫ দিন ধরে তাঁরা নজর রাখেন, মৃতদেহের উপর কোন সময় কোন মাছি আসছে। তার পরে সেই মাছিগুলিকে সংগ্রহ করে গবেষণাগারে নিয়ে আসা হয়। সেখানে মাছিদের ডিএনএ বিশ্লেষণ করা হয়। তাতে চারটি পৃথক গণের ১৭টি প্রজাতির ‘ব্লো ফ্লাই’ চিহ্নিত করেন গবেষকেরা। যে প্রাণীর মৃতদেহে গিয়ে মাছিটি বসেছিল, সেটি কত ক্ষণ আগে মারা গিয়েছে, তা-ও জানা যায় মাছির ডিএনএ বিশ্লেষণ করে।
আরও পড়ুন:
অবৈধ প্রাণীহত্যার তদন্তে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। কারণ, এত দিন পর্যন্ত প্রাপ্তবয়স্ক মাছি না মিললে ময়নাতদন্তে বেশ সমস্যায় পড়তে হত। বিশেষ করে জঙ্গলে বেশ কয়েক দিন ধরে পড়ে থাকা কোনও প্রাণীর দেহের ময়নাতদন্তের ক্ষেত্রে, অনেক সময়েই নির্ভুল তথ্য পেতে সমস্যা হত। তবে ওই দেহ থেকে মাছি সংগ্রহ করে তার ডিএনএ বিশ্লেষণ করতে পারলে, এই তথ্য অনেক বেশি নির্ভুল হবে। সময়ও কম লাগবে। গবেষণা বলছে, এই প্রযুক্তিতে ডিম, লার্ভা বা প্রাপ্তবয়স্ক— যে কোনও পর্যায়ের ‘ব্লো ফ্লাই’ থেকেই দ্রুত এবং নির্ভুল ভাবে তথ্য সংগ্রহ করা যায়। ফলে এক দিকে যেমন ফরেন্সিক তদন্তের সময় বাঁচে, তেমনই অপরাধের (প্রাণীহত্যা সংক্রান্ত) তদন্তেও গতি আসে। ‘ব্লো ফ্লাই’-এর ডিএনএ-ই হয়ে উঠতে পারে প্রাণীহত্যা সংক্রান্ত অপরাধের ফরেন্সিক তদন্তে এক গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র। সম্প্রতি, আন্তর্জাতিক জার্নাল ‘প্লস ওয়ান’-এ এই গবেষণাটি প্রকাশিতও হয়েছে।
আরও পড়ুন:
তবে এই গবেষণালব্ধ ফল বন্যপ্রাণীর দেহের ময়নাতদন্তের ক্ষেত্রেই সুবিধা দেবে বলে মনে করছেন ভারতীয় প্রাণী সর্বেক্ষণের গবেষকেরা। মানবদেহের ময়নাতদন্তের ক্ষেত্রে এটি এখনও পরীক্ষিত নয়। ভারতীয় প্রাণী সর্বেক্ষণের গবেষক অতনু নস্করের কথায়, “মানবদেহের গঠনতন্ত্র অনেকটাই আলাদা। মৃতদেহের উপর মাছিগুলি কখন এসে বসছে, তার ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয় প্রাণীটি কখন মারা গিয়েছে। এটিকে বলা হয় ‘পোস্টমর্টেম ইন্টারভ্যাল’ (পিএমআই)। এই পিএমআই মানবদেহের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ আলাদা।” তিনি আরও জানান, মানবদেহ নিয়ে গবেষণা করার ছাড়পত্র সংস্থার কাছে নেই। তা ছাড়া এই গবেষণার ফল মানবদেহের ময়নাতদন্তের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায় না বলেই মত অতনুর। তবে ভবিষ্যতে কোনও সংস্থা মানবদেহের ময়নাতদন্তের জন্য গবেষণা চালালে, প্রাণী সর্বেক্ষণের গবেষণালব্ধ ফল থেকে অনেকটা সাহায্য মিলবে বলে আশাবাদী অতনু।
ভারতীয় প্রাণী সর্বেক্ষণের অধিকর্তা ধৃতি বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “ফরেন্সিক বিজ্ঞান এতদিন শুধু মানুষের দেহ পরীক্ষা করে সত্য খোঁজার চেষ্টা করত। কিন্তু আমরা দেখালাম—প্রকৃতি নিজেই সাক্ষী রেখে দেয়। মাছির ডিএনএ এমন এক ভাষা, যা আমরা এখন বুঝতে শিখেছি। এটা শুধু ভারত নয়, বিশ্বব্যাপী ফরেন্সিকে নতুন দিশা দেখাবে। ডিএনএ বারকোডিং-এ যে ভাবে স্পষ্ট পার্থক্য ধরা পড়েছে, তাতে মৃত্যুর সময় নির্ধারণে এই পদ্ধতি একেবারে নির্ভুল প্রমাণ হতে পারে।”