Advertisement
E-Paper

যে রোগী সেবা করে গেলেন ডাক্তারের, এবং মানুষেরও

লিখছেন বুলা ঝা ভট্টাচার্য। (লেখিকা ইলিনয়ের শিকাগোয় নর্থ-ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অফ নিউরোলজির অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর। বিশিষ্ট নিউরো-সায়েন্টিস্ট।) ভাগ্যিস! সেই লোকটার মাথাটা মিলেছিল। আর তা না হলে তো স্মৃতির ‘অন্য রুটে’র হদিশই পাওয়া যেত না! লিখছেন ইলিনয়ের শিকাগোয় নর্থ-ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অফ নিউরোলজির অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ও বিশিষ্ট নিউরো-সায়েন্টিস্ট বুলা ঝা ভট্টাচার্য।

শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০১৬ ০০:০০

নার্সিংহোমে হাতে একগোছা ফুল নিয়ে যিনি দেখা করতে এসেছিলেন তাঁর ৫৫ বছরের চেনা বন্ধু ও স্বামীর সঙ্গে, তিনি আর কেউ নন, বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাশালী মহিলা, মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি সান্ড্রা ও কোনার। এই অতি কাছের মানুষটিকে দেখাশোনা করার জন্য তাঁর অত্যন্ত দায়িত্বের কাজ থেকে ছুটি নিয়েছেন। কিন্তু যাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন তিনি নার্সিংহোমে, সেই মানুষটি সে দিন তাঁকে আর চিনতে পারেননি। কারণ, গুরুতর স্মৃতিভ্রংশ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন তাঁর স্বামী। স্ত্রী, ভালবাসা, সংসার আর সন্তান- সব কিছুই তিনি ভুলে গিয়েছেন। আর নার্সিংহোমেই থাকা স্মৃতিভ্রংশ রোগের শিকার এক মহিলাকে তিনি মন দিয়ে ফেলেছেন!

কিন্তু এ সবের জন্য কি তাঁর স্ত্রী দুঃখিত হয়েছিলেন? ঈর্ষান্বিত হয়েছিলেন?

আদৌ না। স্ত্রী সান্ড্রা আজ অনেকটাই নিশ্চিন্ত এই দেখে, যে ভয়ানক রোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর স্বামী ধীরে ধীরে একেবারেই অজানা, অচেনা একটি মানুষ হয়ে গিয়েছিলেন, হয়ে পড়েছিলেন হতাশাছন্ন আর ভীষণ রকমের অন্তর্মুখী, সেই মানুষটি এখন তার থেকে দৃশ্যতই যেন মুক্তি পেয়েছেন একটি নতুন ভালবাসা পেয়ে। কিন্তু কোথায় হারিয়ে গেল সেই মানুষটির স্মৃতি? কোথায়ই-বা সেই স্মৃতি জমা ছিল? তারা কী ভাবে তৈরি হয়েছিল?

সেই সব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের খানিকটা উত্তর পাওয়া গিয়েছে গত কয়েক দশকে। যার থেকে আমরা স্মৃতির রহস্যের জট কিছুটা খুলতে পেরেছি। ছোটবেলা থেকে আমাদের মনের গাঁথুনিটা তৈরি হয় নানা রঙের স্মৃতি দিয়ে। আমরা ‘আমি’কে চিনতে শুরু করি। যে ভাবে আমরা নিজেকে মনে রাখি আর পাঁচটি ইন্দ্রিয় দিয়ে আমরা যা যা উপলব্ধি করি, শিখি- তারই ভিত্তিতে। স্মৃতি সব শিক্ষারই একটি অপরিহার্য অঙ্গ। স্মৃতিই আমাদের শেখা তথ্যকে পুনরুদ্ধার করতে সাহায্য করে। এক কথায় স্মৃতি একটি টেপ রেকর্ডার, যা আমরা বার বার বাজিয়ে স্মৃতির মণিকোঠায় যত্ন করে ধরে রাখি। আর সেই মণিকোঠাটিই হল আমাদের মস্তিস্ক। যেখানে আমাদের চেনা-জানার জগৎটাকে আমরা স্মৃতির জালে বেঁধে রেখেছি।


স্মৃতির সরণি ধরে...!!!

পঞ্চাশের দশকে বিশিষ্ট চিকিৎসক উইলিয়াম স্কুভিলি একটি সাধারণ ‘hand-crank’ আর করাত দিয়ে একটি যুবকের মস্তিক খুলে ফেলে তার মধ্যে থাকা নাসপাতির মতো দেখতে একটি অত্যাবশ্যক এলাকাকে টিউব দিয়ে টেনে বের করে দিলেন। স্কুভিলি সে কালের এক জন নামকরা শল্য চিকিৎসক। আর তাঁর রোগীটি ছিলেন হেনরি মোলায়েসন। যিনি ‘HM’ নামে বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিলেন। যাঁর ওপর কাজ করে বিজ্ঞানীরা সেই প্রথম স্মৃতি সম্পর্কে অনেক অজানা ও বিস্ময়কর তথ্য জানতে পেরেছিলেন। খুব ছেলেবেলায় একটি দুর্ঘটনায় মাথায় চোট পাওয়ার পর থেকে তিনি প্রায়ই মৃগি রোগীর মত তড়কায় ভুগতেন আর অজ্ঞান হয়ে যেতেন। দীর্ঘ দিন সেই রোগে ভোগার পর এক দিন নিরুপায় হয়েই তিনি চিকিৎসক স্কুভিলির শরণাপন্ন হন। এর আগে, যেহেতু স্কুভিলি মানসিক রোগীদের চিকিৎসা করতে গিয়ে দেখেছিলেন, প্রত্যেকটি মানসিক ক্রিয়ার জন্য মস্তিষ্কে এক একটি অংশ বিশেষ ভাবে জড়িত বা দায়ী। তাঁর সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি HM-এর মস্তিষ্ক থেকে নাসপাতির মতো দেখতে ‘হিপোক্যাম্পাস’টিকে (যা কি না মস্তিষ্কের ‘Limbic System’-এর অংশ হিসেবে পরিচিত আর তা মানুষের আবেগের সঙ্গে জড়িত বলে ভাবা হোত, কিন্তু তার সঠিক কাজটি কী, তা জানা ছিল না), রীতিমতো সাহসে ভর দিয়েই বাদ দিয়ে দিলেন। আপাত দৃষ্টিতে ওই সার্জারিটা ‘সফল’ হয়েছে বলেই মনে করা হয়েছিল। কারণ, তার ফলে, HM-এর তড়কা লাগাটা বন্ধ হল। তাঁর ব্যক্তিত্বেরও তেমন হেরফের হল না। কিন্তু তার সঙ্গে এটাও দেখা গেল, HM-এর পুরনো স্মৃতিটি কী ভাবে যেন খোওয়া গিয়েছে, একেবারেই। HM-এর এই অবস্থা দেখে স্কুভিলি আশ্চর্য হয়ে তার ওই কেসটিকে এক জন পিএইচডি-র ছাত্রী ব্রেন্ডা মিলনারের হাতে দিলেন, বাড়িতে গিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য। মিলনার দেখলেন, যদিও HM বার বারই ভুলে যাচ্ছেন আজ কী বার, এক কথা বার বার বলছেন, কিন্তু সদ্য সদ্য শেখানো কাজটি কোনও রকমে করে উঠতে পারছেন!

স্মৃতির বিভিন্ন প্রকার আর তার বিভিন্ন ধাপ।

এর মানেটা হল, HM নতুন নতুন স্মৃতি তৈরি করতে পারছেন না। কিন্তু নতুন তথ্যকে অন্তত কিছু ক্ষণের জন্য হলেও, ধরে রাখতে পারছেন। যেমন, HM-কে একটি সংখ্যা দেখানো হলে তিনি সংখ্যাটিকে অল্প কিছু সময়ের জন্য মনে রাখতে পারছেন। কিন্ত কখন তাকে সংখ্যাটিকে দেখানো হয়েছিল, সেটি কিছুতেই মনে রাখতে পারছেন না।

আরও পড়ুন-
এডস রোখার হাতিয়ার আসছে? মশাল এক বাঙালির হাতেই!

এটা একটা অদ্ভূত ঘটনা। কারণ, এর আগে ভাবা হোত, সব রকমের স্মৃতিই মস্তিষ্কে কোনও একটি জায়গায় একই ভাবে সঞ্চিত (স্টোরড্‌) হয়। কিন্তু HM-এর ওপর মিলনারের ওই কাজগুলির ফলে বোঝা গেল, স্মৃতিকে শুধুই স্বল্প মেয়াদি (Short Term) আর দীর্ঘ মেয়াদি (Long Term) বলে যে আলাদা করা যায়, সেটুকুই নয়। মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশে এরা সঞ্চিত হয় বিভিন্ন ভাবে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার।


দীর্ঘ মেয়াদি স্মৃতির বিভিন্ন ধাপ।

নার্ভ সেলের ভূমিকাটা ঠিক কী রকম?

তার আগে জানা যাক, মস্তিষ্কের ‘Building Block’ বা নার্ভ সেলের এই ক্ষেত্রে ভূমিকাটা ঠিক কী রকম?

আমাদের মস্তিষ্কে একশো কোটি নার্ভ সেল রয়েছে। ওই সেলগুলি একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করে বৈদ্যুতিক তরঙ্গ বা রাসায়নিক সিগনালের সাহায্যে। আর সেই ভাবেই তারা তাদের নেটওয়ার্ক তৈরি করে। আমাদের হিপোক্যাম্পাসে তাদের ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি বলে লক্ষ্য করা যায়।

একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ধরুন, আপনি একটি কুকুর দেখলেন। সেই দেখাটিকে নার্ভ সেলগুলি একে অপরকে বৈদ্যুতিক বা রাসায়ানিক ভাবে যোগাযোগ করে ‘ট্রান্সফেকশান’ পদ্ধতিতে সিগনালে বদলে দিল। আর, তাকে একটি ‘কোডে’ বদলে ফেলে মস্তিষ্কের ‘সুপার কম্পিউটার’- হিপোক্যাম্পাসকে জমা দিল। ওই ‘কোড’টির বিশেষত্ব হল- তা শুধুই কুকুরটিকে শনাক্ত করতে পারে। এই ভাবে আলাদা আলাদা সিগনালের আলাদা আলাদা অভিজ্ঞতার ‘কোড’ মস্তিষ্কে জমা হতে থাকে। আরও তলিয়ে দেখলে জানা যায়, এই ‘কোড’গুলি তৈরি হওয়ারও অনেকগুলি ধাপ রয়েছে। সেই ‘কোড’ প্রথমে যায় মস্তিষ্কের ‘কর্টেক্স’ এলাকায় (যেটা হিপোক্যাম্পাসের ওপরে থাকে আর সেখানে থাকে সাময়িক ভাবে। তার পরে হিপোক্যাম্পাসে যায়।) এখানে বিশেষ এক ধরনের প্রোটিনের সাহায্যে সেই ‘কোড’টি স্মৃতি হিসেবে আরও জোরালো, জোরদার হয়ে ওঠে।

যদি সেই সময় সেই সদ্য জন্মানো স্মৃতিটি শক্তিশালী হয় বা, আমরা বারে বারে সেই ‘স্মৃতি’কে মনে করার চেষ্টা করি, তখন হিপোক্যাম্পাস বোঝে সেই স্মৃতিটুকুকে স্থায়ী ভাবে সঞ্চয় (স্টোর) করতে হবে। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। স্থায়ী ভাবে সঞ্চয় করার জন্য হিপোক্যাম্পাস স্মৃতির ওই অংশটিকে আবার ‘কর্টেক্সে’ পাঠিয়ে দেয়।

তা হলে HM-এর ক্ষেত্রে কী ঘটেছিল?

তাঁর স্মৃতি প্রাথমিক ভাবে তৈরি হলেও, হিপোক্যাম্পাস এলাকাটি বাদ চলে যাওয়ার ফলে তাঁর স্মৃতিটি জোরালো হতে পারছিল না। তাই তাঁর স্মৃতি স্বল্প মেয়াদি হয়েই ‘সীমিত’ হয়ে থাকছিল। পরে জানা গেল, দীর্ঘ মেয়াদি স্মৃতিকেও দু’ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমটি হল-‘Declarative Memory’। যার সাহায্যে আমরা নাম, তারিখ ও বিভিন্ন তথ্য মনে রাখি। আর দ্বিতীয়টি হল- ‘Procedural Memory’। যার জন্য আমরা নিজের নাম লেখা, সাঁতার কাটা ও সাইকেলে চালানোর ‘অভিজ্ঞতা’ কখনওই ভুলে যাই না। এই ‘Procedural Memory’ সঞ্চিত হয় মস্তিষ্কের দু’টি ভিন্ন অংশে- ‘Basal Ganglia’ আর ‘Cerebellum’-এ।


স্মৃতির সরণিতে যারা ধারক ও বাহক! অণুবীক্ষণের তলায়।

স্মৃতি নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণ কী কী?

এই সব কাজ থেকে আমরা এখন জানতে পেরেছি, কী কী কারণে স্মৃতি নষ্ট হয়।

তা বয়সের জন্য হতে পারে। হতে পারে অ্যালজাইমার্স বা ডেমেনশিয়ার মতো স্মৃতিভ্রংশ রোগের জন্য বা তা স্ট্রোক, পার্কিনসন্‌স ডিজিজ, ভ্যাসক্যুলার ডেমেনশিয়া অথবা ভিটামিন বি-টুয়েলভ ডেফিসিয়েন্সির মতো অন্য কোনও রোগের কারণেও হতে পারে। এও জানা গিয়েছে, তার ফলে মস্তিষ্কের কোন এলাকাটি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা কোন রাসায়নিকটির অভাবে ‘নার্ভ কমিউনি্কেশান’ ব্যাহত হয়।

শেষ কথা

ওই সব তথ্য চিকিৎসকদের কাজটাকে অনেকটাই সহজ করে দিয়েছে স্মৃতিভ্রংশ রোগের সঠিক কারণ নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে। বা, তার সঠিক চিকিৎসা করতে।

HM ৮৫ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচেছিলেন। আর, সেটাই শেষ কথা নয়। আরও অনেক স্নায়ুবিজ্ঞানীকে তাঁর মস্তিষ্ক নিয়ে কাজ করার, আরও নতুন নতুন তথ্য সংগ্রহ করার অনুমতি দিয়েছিলেন।

আধুনিক স্মৃতিবিজ্ঞানের গবেষণায় তাঁর ‘অবদানে’র জন্য এই স্মৃতিভ্রংশ মানুষটিকে শুধু আজকের প্রজন্ম নয়, ভবিষ্যত প্রজন্মও চিরকাল মনে রাখবে।

তাই শুধু একটাই প্রার্থনা, স্মৃতিটুকু থাক...!!!

recent research in neuro-science hippcampus functions
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy