প্রায় আড়াই কোটি আলোকবর্ষ দূরে একটি তারার মৃত্যু! এমন আলোর ঝলকানি স্মরণাতীত কালে দেখেছেন বলে মনে করতে পারছেন না বিজ্ঞানীরা।
কোনও তারা বা নক্ষত্রের মৃত্যুর সময় যে ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ হয়, তাকে বলে সুপারনোভা। সুপারনোভার সময় তীব্র আলোর ছটা দেখা যায় মহাকাশে। কিন্তু সেই ছটার ঔজ্জ্বল্য বেশি দিন থাকে না। অল্প সময়েই তা ফিকে হতে শুরু করে। তার পর তা হারিয়ে যায়। এ ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। কয়েক ঘণ্টার এ দিক-ও দিক হলেই বড় সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যেত চিনা জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের।
২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে এই সুপারনোভা চাক্ষুস করেন বিজ্ঞানীরা। এটির নাম রাখা হয়েছে ‘এসএন২০২৪জিজিআই’। এ নিয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে ‘সায়েন্স অ্যাডভান্সেস’ জার্নালে। গবেষণাপত্রের লেখক সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানী ই ইয়াং বলেন, ‘‘সুপারনোভার একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ের দৃশ্য দেখেছি আমরা। যদি কোনও ভাবে একটা দিন পরে এই দৃশ্য চোখে পড়ত, তা হলে অনেক বড় সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যেত। অনেক তথ্য আমরা পেতামই না। এমন দৃশ্য এই প্রথম বার দেখতে পাওয়া গেল। এই ফলাফল ভবিষ্যতে সুপারনোভা সংক্রান্ত গবেষণা কাজে লাগবে।’’
ঘটনাচক্রে, আজ থেকে মোটামুটি ৩০০ বছর আগে, ১৬৮৭ খ্রিস্টাব্দে চিনেরই এক জ্যোতির্বিজ্ঞানী খালি চোখেই সন্ধ্যার আকাশে শুধু জ্বলজ্বলে তারা দেখছিলেন— তাদের গতিবিধি, ঔজ্জ্বল্যের তারতম্য ইত্যাদি। ঝলমলে তারাকে হঠাৎ ম্লান করে দিয়ে একটা বিস্ফোরণ ঘটল, সারা আকাশ সেই আলোর ছটায় সন্ধ্যাকে যেন ভোর বানিয়ে দিল! এই বিস্ফোরণের কী কারণ, তা আবিষ্কার হল বিংশ শতাব্দীর মাঝের দিকে— অ্যাটমিক নিউক্লিয়াস আবিষ্কারের পরে এবং নিউক্লিয়াসের মধ্যে প্রোটন, নিউট্রনের চালচলন ভাল করে বুঝে ওঠার পর। এই বিস্ফোরণের নামকরণ হল সুপারনোভা। ওই সুপারনোভার ভয়ঙ্কর শোভাই চিন দেশের বিজ্ঞানীরা লক্ষ করেছিলেন।
আরও পড়ুন:
২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৭। আবার সেই খালি চোখেই সুপারনোভার বিস্ফোরণ দেখা গেল। নীল রঙের এক বিরাট তারা (সূর্যের ওজনের তুলনায় ১০ থেকে ২৫ গুণ ভারী) যার নাম ‘স্যানডুলিক-৬৯২০২’। আমাদেরই লার্জ ম্যাগলেনিক ক্লাউড-এ তার বাসস্থান। তার মাধ্যাকর্ষণ প্রচণ্ড। নিজেরই মাধ্যাকর্ষণকে আটকে রেখেছে বহু যুগ ধরে। পারমাণবিক শক্তিই মাধ্যাকর্ষণের প্রচণ্ড আকর্ষণকে খিল দিয়ে রেখেছে, যেমন ঘরে খিল দেওয়া থাকলে বাইরে থেকে কেউ ঘরে ঢুকতে পারে না। কিন্তু পারমাণবিক শক্তি যদি শেষ হয়ে যায়, খিলটা বাইরের মাধ্যাকর্ষণের চাপে খুলে যায়।
তা-ই ঘটেছিল। ১৯৮৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি দৈত্য তারার পারমাণবিক চুল্লি বন্ধই হয়ে গিয়েছিল। পরে বিজ্ঞানীরা অঙ্ক কষে বুঝেছেন যে, সেটাই হওয়া উচিত। অর্থাৎ এক কোটি বছর পর পারমাণবিক চুল্লি আপনা থেকেই প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে বন্ধ হবে। আমাদের সূর্যেরও এই দশাই হবে, আজ থেকে বহু কোটি বছর পরে। তখনই মাধ্যাকর্ষণের প্রবল আকর্ষণে দৈত্য তারা নিষ্পেষণের পথে যায়, আদি তারাটি মাধ্যাকর্ষণের অভাবনীয় চাপে সঙ্কুচিত হতে থাকে।
এই দৈত্য তারার নাম দেওয়া হল এসএন১৯৮৭এ। অনেকেরই ধারণা যে, আদি দৈত্য তারাটির ওই মাধ্যাকর্ষণের প্রচণ্ড চাপে নিউট্রন তারায় রূপান্তরিত হওয়া উচিত। মার্টিন রাইলে এবং টোনি হিউইস নামে এই দুই বিজ্ঞানী ১৯৬০-এর শেষের দিকে এই নিউট্রন তারা আবিষ্কার করেছিলেন। নিউট্রন তারা একটি অকল্পনীয় ভারী তারা। কিন্তু নিউট্রন তারাটি ১৯৮৭ সালের এসএন১৯৮৭এ থেকে কিছুতেই খুঁজে পাওয়া গেল না। এসএন১৯৮৭এ থেকে আলো পৃথিবীতে পৌঁছোনোর আগেই পৃথিবীর বুকে পৌঁছল নিউট্রিনো নামে একটি মৌলিক কণা, আলোর গতিতে যাত্রা করেছিল দৈত্য তারা থেকে। ওই এসএন১৯৮৭এ যখন মাধ্যাকর্ষণের নিষ্পেষণে সঙ্কুচিত হচ্ছে, তখন পারমাণবিক প্রক্রিয়ার ফলে নিউট্রিনোগুলো ধেয়ে আসে বিশ্বের আকাশে। জাপানের বিখ্যাত ক্যামিয়োকান্তে ডিটেক্টরে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে, আলোর রেশটুকু পৌঁছোনোর আগেই। নিউট্রিনো এবং তাদের বিপরীত কণা অ্যান্টি নিউট্রিনো ওই জাপানি ডিটেক্টরে রাতদুপুরে তাদের পৌঁছে যাওয়ার খবর জাহির করে টেলিভিশন স্ক্রিনে। মুহূর্তে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হয়। কিন্তু নিউট্রন তারার কোনও হদিসই পাওয়া গেল না।
তার অনেক পর জানা গেল, যখন দৈত্য তারা নিষ্পেষণের পথে ছোটে এবং নিষ্পেষিত হয়, তখন মহাজাগতিক ধুলো নিউট্রন তারাকে এমন ভাবে ঢেকে রেখেছিল যে, কোনও রকমেরই আলো বেরোতে পারছিল না। ধুলোর ঝড় যেমন দিনকে সন্ধ্যা বানিয়ে দেয়, সে ভাবেই এই মহাজাগতিক ঘোমটা নিউট্রন তারাটিকে পুরো ঢেকে রেখেছিল। দীর্ঘ ৩৪ বছর লাগল ধুলোর ঘোমটা খুলতে। হয়তো চোখে দেখা আলোর কাছে নয়। কিন্তু এক্স-রে, বা অন্য কোনও বিকিরণের ক্যামেরায়। পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম নিউট্রন তারার বিলম্বিত জন্মক্ষণ মহাজাগতিক পর্দায় চলচ্চিত্রের মতো ফুটে ওঠে। তার পর থেকেই সুপারনোভা নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই বিজ্ঞানী মহলে।