E-Paper

ভোল বদলাচ্ছে ক্যানসার, লড়ে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা

কেউ লড়ে চলেছেন গবেষণাগারে। রোগীকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনার অদম্য জেদ দেখাচ্ছেন কেউ। কেউ প্রিয়জনের হাতে হাত রেখে ভরসা জোগাচ্ছেন। আজ ‘ক্যানসার কেয়ারগিভার ডে’।

সায়ন্তনী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০২৩ ০৭:৪৬
An image of Cancer

—প্রতীকী চিত্র।

ক্যানসার। শব্দটা শুনলে তার পরেই যা মাথায় আসে, তা হল মৃত্যু। এই মৃত্যুকেই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে গবেষণা চলছে বিশ্ব জুড়ে। হাজার হাজার কোটি ডলার ব্যয় করে সন্ধান চলছে ওষুধের। যদিও পরিসংখ্যান বলছে, ‘ক্লিনিক্যাল ড্রাগ ডেভেলপমেন্ট’ বা ওষুধ তৈরি ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ। ল্যাবের পরীক্ষায় পাশ করলেও শেষমেশ মানবদেহে সে ওষুধ সাফল্যের মুখ দেখে না। বাকি ১০ শতাংশ পাশের হারেও যা রয়েছে, তা শুধুমাত্র ক্যানসারকে যুঝতে সাহায্যকারী ওষুধ বা চিকিৎসা ব্যবস্থা। এ অবস্থায় ভুলের মধ্যে থেকে ঠিক পথের সন্ধানী গবেষকেরা। তৈরি হচ্ছে নয়া গবেষণা ও চিকিৎসা-প্রযুক্তি ‘অর্গানয়েড’, ‘হিউম্যানয়েড মাউস’, ‘টার্গেটেড থেরাপি’। গবেষকেরা বলছেন, এই লড়াই শেষ হওয়ার নয়, তবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির হাত ধরে ক্যানসার গবেষণা-চিকিৎসা এগোচ্ছে।

ক্যানসারের ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, ডাইনোসরের জীবাশ্মেও ক্যানসারের চিহ্ন মিলেছে। ১৫০০ থেকে ১৬০০ খ্রিষ্টপূর্ব, মিশরের প্যাপিরাসে ক্যানসারের উল্লেখ পাওয়া যায়। মানবদেহে ক্যানসারের কথা প্রথম নথিভুক্ত হয়েছিল ২৭০০ বছর আগে। হাজার হাজার বছরেও এই রহস্যের সমাধান হয়নি। তবে গত দশ বছরে অন্ধকারে কিছুটা হলেও আলোর দেখা মিলেছে।

‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োমেডিক্যাল জিনোমিক্স’ (এনআইবিএমজি)-এর ক্যানসার বিশেষজ্ঞ নিধান বিশ্বাস বলছেন, ‘‘দশ বছর আগে হলেও ক্যানসার-প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর ছিল না আমাদের কাছে। কিন্তু ২০১০ সালের পর থেকে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে।’’ বিষয়টা এ রকম, ২০১০-এর আগে জিন সিকোয়েন্সিং করা হত না। নিধান বলেন, ‘‘ডায়াবিটিস ও চোখের অসুখের মধ্যে যতটা পার্থক্য, লিভার ক্যানসার ও স্তন ক্যানসারের মধ্যে পার্থক্য ততটাই। আবার একই ক্যানসারের বিভিন্ন সাবটাইপ রয়েছে। যেমন স্তন ক্যানসার। ট্রিপল নেগেটিভ স্তন ক্যানসার সবচেয়ে বেশি আগ্রাসী।’’ তিনি জানিয়েছেন, প্রতিটি ক্যানসারের জন্য দায়ী আলাদা আলাদা জিন পরিবর্তন। রোগীর শরীরে কোনও জিন খামখেয়ালি ব্যবহার করছে, সেটা জিন সিকোয়েন্সিং মারফত জানা জরুরি। তা হলেই রোগকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। কারণ প্রতিটি ক্যানসারের চিকিৎসা আলাদা।

একই কথা বলছেন ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যানসার গবেষক দেবাঞ্জন ভট্টাচার্য। তিনি জানান, ফুসফুসের ক্যানসারের জন্য দায়ী ইজিএফআর (প্রোটিন)। প্যানক্রিয়েটিক ক্যানসারে দায়ী কে-র‌্যাস (জিন)। স্তনের ক্যানসারে ব্রাকা-১, ব্রাকা-২ জিন। কার শরীরে কোন জিন কারসাজি করেছে না জানলে ঠিক চিকিৎসা অসম্ভব।

একই সঙ্গে প্রয়োজন দ্রুত পদক্ষেপ। নিধান বলেন, ‘‘ভারতে মুখের ক্যানসারে আক্রান্তের সংখ্যা খুব বেশি। কোনও রোগী যদি এখন মুখে একটা ছোট্ট ঘা নিয়ে আসেন, গোড়াতেই জিন পরীক্ষা করে বলে দেওয়া সম্ভব, ওই ঘা ভবিষ্যতে ক্যানসারের আকার নেবে কি না। ভারতে সেই প্রযুক্তি এসে গিয়েছে। সে ক্ষেত্রে ক্যানসার ছড়ানোর আগেই তার প্রতিকার সম্ভব।’’ তিনি জানিয়েছেন, এই জিন-পরীক্ষার খরচ আগে লাখ খানেক টাকার ধাক্কা ছিল। এখন অনেকটাই কমেছে। ১৫ হাজার টাকাতেই সম্ভব।

দেবাঞ্জন জানান, কোলন ক্যানসার, প্যানক্রিয়াসের ক্যানসার— এগুলি খুব দেরিতে ধরা পড়ে। আমেরিকায় এখন কোলন ক্যানসার ধরার কিট পাওয়া যায়। কোনও ব্যক্তি নিজেই বাড়িতে এই কিটের সাহায্যে পরীক্ষা করতে পারেন। আমেরিকায় ক্যানসার আক্রান্তের সংখ্যা ঊর্ধ্বমুখী। নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে নিজের শরীরে উপর নজর রাখতে সেখানে এই পরামর্শই দিচ্ছেন চিকিৎসকেরা।

চিকিৎসার পাশাপাশি গবেষণা ক্ষেত্রেও বদল ঘটেছে। যেমন হিউম্যানয়েড মাউস বা জেনেটিক্যালি ইঞ্জিনিয়ারড মাউস। আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী অরিন্দম বসু জানান, আগে ইঁদুরের শরীরে ক্যানসার কোষ ঢুকিয়ে পরীক্ষা করা হত। এখন এমন ভাবে জেনেটিক্যালি ইঞ্জিনিয়ারড ইঁদুর তৈরি করা হচ্ছে, যার শরীরে জন্ম থেকেই ক্যানসার। ফলে গবেষণা আরও বাস্তবসম্মত হচ্ছে। এ ছাড়া অর্গানয়েডের সাহায্যে পরীক্ষা। অরিন্দম নিজেই ক্যানসার অর্গানয়েড নিয়ে পরীক্ষা করছেন। রোগীর শরীর থেকে ক্যানসার কোষ নিয়ে তা ত্রিমাত্রিক ভাবে বড় করে একটি ‘মানব অঙ্গের’ রূপ দেওয়া হয়। এবং তাতে গবেষণা করা হয়।

তবে ক্যানসারে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা ‘মিউটেশন’। অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে ক্যানসারও ভোলবদল করে চলেছে। ফলে যে ওষুধ আগে কাজ দিত, পরে আর তা কাজ করছে না। অরিন্দম বসুর কথায়, ‘‘ক্যানসারের জন্য দায়ী জিন
মিউটেশন ঘটিয়ে নির্দিষ্ট ওষুধের কাজ করার ক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে। ড্রাগ
রেজ়িসট্যান্স তৈরি হচ্ছে।’’ ঠিক এই কারণেই প্রাথমিক ভাবে সুস্থ হয়ে ওঠা কোনও রোগীর শরীরে
ক্যানসার ফিরে আসার নজির অসংখ্য। তা ছাড়া, মানব দেহের ভিতরে কী ঘটছে, তা বাইরে থেকে অদৃশ্য। ফলে
টেলিকমিউনিকেশন বা অন্য যে কোনও ক্ষেত্রে যে গতিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এগোচ্ছে, তা
ক্যানসারের ক্ষেত্রে অন্তত খাটে না। অরিন্দমের কথায়, ‘‘সময়ও একটা বড় বাধা। এক-একটা গবেষণায় ১০ থেকে ১৫ বছর লেগে যায়। একটি ওষুধ তৈরিতে ১০০ থেকে ২০০ কোটি ডলার ব্যয় হয়ে যায়। ব্যর্থ হলে ফের নতুন করে শুরু। অর্থও নষ্ট। এই কারণে ক্যানসারের ওষুধের দাম এত বেশি। তবে লড়াই চলবে।’’

(চলবে)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Cancer Scientists

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy