Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪

চাঁদের পাতালে আমাদের ঘর-বাড়ি তৈরি শুরু!

একটু সবুর করুন। আর বড়জোর কুড়ি/পঁচিশটা বছর। আমাদের ‘নতুন বাড়ি’ হয়ে যাবে চাঁদে! আমি-আপনি পেয়ে যাব দু’বিঘা জমিনও! তখন কে বলবে, চাঁদ- ঝলসানো রুটি? একটা সভ্যতার জন্য যা যা লাগে, সেই কাস্তে আর হাতুড়ির ঠুকঠাক খুব শিগগিরই শুরু হয়ে যাবে চাঁদে।

চাঁদে কলোনি গড়ার তোড়জোড়! ছবি-নাসা।

চাঁদে কলোনি গড়ার তোড়জোড়! ছবি-নাসা।

সুজয় চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০১৫ ১৩:০৫
Share: Save:

একটু সবুর করুন। আর বড়জোর কুড়ি/পঁচিশটা বছর।

আমাদের ‘নতুন বাড়ি’ হয়ে যাবে চাঁদে! আমি-আপনি পেয়ে যাব দু’বিঘা জমিনও!

তখন কে বলবে, চাঁদ- ঝলসানো রুটি?

একটা সভ্যতার জন্য যা যা লাগে, সেই কাস্তে আর হাতুড়ির ঠুকঠাক খুব শিগগিরই শুরু হয়ে যাবে চাঁদে। জোর কদমে।


উপনিবেশ গড়ার প্রস্তুতি চাঁদে। ছবি সৌজন্যে- ‘রসকসমস’।

আমার-আপনার পাকাপাকি ভাবে থাকার জন্য চাঁদে জমি-জিরেত দেখতে যাচ্ছে চিন। যাচ্ছে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ইএসএ বা ‘এসা’) ও রাশিয়ান ফেডেরাল স্পেস এজেন্সি বা ‘রসকসমস’)-ও। আগামী বছরেই।

ঘটনাচক্রে আমাদের এই বাসযোগ্য গ্রহের একমাত্র চাঁদে মানবসভ্যতার দ্বিতীয় উপনিবেশ গড়ে তোলার স্বপ্নটা প্রথম দেখেছিলেন ভারতের প্রয়াত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বিজ্ঞানী এপিজে আব্দুল কালাম। তিনি চেয়েছিলেন, প্রাথমিক ভাবে অন্য অন্য গ্রহে যাওয়ার জন্য চাঁদকেই করে তোলা হোক ‘স্পেস ট্রান্সপোর্টেশান হাব’। চাঁদের পিঠে জমা শুকনো বরফ তুলে নিয়ে এসে বানানো হোক মহাকাশযান পাঠানোর রকেটের জ্বালানি (‘দ্য সায়েন্টিফিক ইন্ডিয়ান’, পৃঃ৩৫)।

প্রয়াত কালামের সেই স্বপ্ন হয়তো এ বার সত্যি হতে চলেছে।

তবে বাধাও কিছু কম নেই। মহাকাশবিজ্ঞানীদের যাবতীয় দুশ্চিন্তা চাঁদের পিঠের তাপমাত্রা, সৌর-বিকিরণ আর চাঁদের দীর্ঘমেয়াদি রাতের হাড়-জমানো ঠাণ্ডা নিয়ে।

দিনের ওই ঝলসে যাওয়া তাপ আর নিকষ কালো রাতের ওই কনকনে ঠাণ্ডার হাত থেকে কী ভাবে টিঁকিয়ে রাখা যাবে সভ্যতার দ্বিতীয় উপনিবেশকে?

মার্কিন মুলুকে মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাকাশ-প্রযুক্তিবিদ হিল্লোল গুপ্ত ও জার্মান অ্যারোস্পেস সেন্টার ডিএলআরের স্পেসক্র্যাফ্ট অপারেশনস ইঞ্জিনিয়ার সুদর্শন সুন্দরাজন ই-মেলে জানিয়েছেন, ‘‘চাঁদে সভ্যতার দ্বিতীয় উপনিবেশ গড়ে তোলার প্রস্তুতি-তোড়জোড় চলছে অনেক দিন ধরেই। ’৯৯ সালে শুরু হয়েছিল চাঁদকে ঘাঁটি বানিয়ে মহাকাশের বিভিন্ন রুটে চষে বেড়ানোর প্রস্তুতি। যার নাম- ‘মুনবেস-আলফা ইন স্পেস’। এখন চলছে চাঁদের মাটি খুঁড়ে তার অভ্যন্তরে সভ্যতার দ্বিতীয় উপনিবেশ গড়ে তোলার কাজ। ‘আন্ডারগ্রাউন্ড কলোনি’। এটা কোনও কল্প-বিজ্ঞান নয়। আর কুড়ি-পঁচিশ বছরের মধ্যেই তা অনেকটা সম্ভব হবে।’’

মানে, প্র্ত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর সভ্যতার হদিশ মিলেছিল যে ভাবে ভূ-পৃষ্ঠের অনেকটা নীচে, চাঁদে সভ্যতার দ্বিতীয় উপনিবেশকে গড়ে তোলা হবে তার ঠিক উল্টো ভাবে। মানে, সাব-ওয়ের মতো চাঁদে ‘আন্ডারগ্রাউন্ড কলোনি’ গড়ে তোলার প্রস্তুতি-তোড়জোড় চলছে জোর কদমে।

সভ্যতার দ্বিতীয় উপনিবেশ গড়ে তোলার জন্য কেন চাঁদকেই দেওয়া হচ্ছে অগ্রাধিকার?

কাটছি মাটি, দেখবি আয়...!!! চাঁদে। ছবি-ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি।

হিল্লোলবাবু জানাচ্ছেন, ‘‘প্রথম কারণ, চাঁদই আমাদের সবচেয়ে কাছের কোনও মহাজাগতিক বস্তু। পৃথিবী থেকে যার দূরত্ব মাত্র দু’লক্ষ আটত্রিশ হাজার মাইল বা তিন লক্ষ তিরাশি হাজার কিলোমিটার। একেবারে হাতের কাছে থাকার ফলে চাঁদে যাওয়া-আসাটা প্রায় রোজ ধর্মতলা ছুঁয়ে আসার মতো। আর ধর্মতলা থেকে দক্ষিণবঙ্গ ও উত্তরবঙ্গ যাওয়ার যে প্রচুর সুবিধা, তেমনই চাঁদকে ‘স্পেস ট্রান্সপোর্টেশান হাব’ বানানো হলে ভিন গ্রহের সন্ধানের কাজটা সহজতর হয়ে যায়। দ্বিতীয় কারণ, চাঁদে ‘হিলিয়াম-তিন’ গ্যাসের অভাব নেই। তাই সেখানে রাতেও একটা আস্ত ‘কলোনি’-কে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যে সুপ্রচুর বিদ্যুতের প্রয়োজন, তার চাহিদা মেটাতে ফিউশন রিঅ্যাক্টর চালাতে হলে ওই ‘হিলিয়াম-তিন’ গ্যাস তার জ্বালানির কাজ করবে।’’

তবে চাঁদে আমাদের দ্বিতীয় উপনিবেশ গড়ে তোলার প্রধান অন্তরায়টা হল তার দীর্ঘমেয়াদি রাত। চাঁদের এক-একটা রাত হয় ৩৫৪ ঘণ্টার। মানে, পৃথিবীর দু’ সপ্তাহের সামান্য বেশি। আর চাঁদের সেই রাত মানে হাড়-জমানো ঠাণ্ডা। শূন্যের নীচে ১৭৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। চাঁদের দিনটাও একেবারে ঝলসে যায় সূর্যের গনগনে আঁচে। চাঁদের বিষুবরেখা বা ইকোয়েটারে স্বাভাবিক অবস্থায় তাপমাত্রা থাকে ১১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ২৪০ ডিগ্রি ফারেনহাইট। মানে, আফ্রিকার প্রচণ্ড গরমের দেশগুলির চেয়েও দিনে চাঁদের পিঠ প্রায় চার/সাড়ে চার গুণ বেশি তেতে থাকে।

দেখুন অবাক করা গ্যালারি
দেখুন, কেমন হচ্ছে চাঁদের কলোনি

মানবসভ্যতার ‘সুখের শরীর’ এত তাত কী ভাবে সহ্য করে, বলুন তো?

তাই চিন, ‘এসা’ আর ‘রসকসমস’ প্রাথমিক ভাবে ঠিক করেছে, সভ্যতার দ্বিতীয় উপনিবেশটা গড়ে তোলার জন্য চাঁদের দুই মেরুই হবে ‘প্রায়োরিটি এরিয়া’।

কেন? তাতে কী লাভটা হবে চাঁদ-মুলুকে আমাদের দ্বিতীয় উপনিবেশের?

কাটছি মাটি, দেখবি আয়...চাঁদে। ছবি-‘রসকসমস’।

জার্মান অ্যারোস্পেস সেন্টার ডিএলআরের স্পেসক্র্যাফ্ট অপারেশনস ইঞ্জিনিয়ার সুদর্শন সুন্দরাজন ই-মেলে জানিয়েছেন, ‘‘চাঁদের মেরুতে রাতটা অতটা দীর্ঘমেয়াদী নয়। ফলে, ওই এলাকায় দ্বিতীয় উপনিবেশের জন্য জমি খোঁজাটাই বেশি জরুরি। কারণ, তাতে সভ্যতাকে হাড়-জমানো ঠাণ্ডায় জমে বরফ হয়ে যেতে হবে না। আবার মেরুতে রাতটা তুলনামূলক ভাবে কম সময়ের হবে বলে সেই রাতের প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য চাঁদ থেকে নেওয়া জ্বালানি ‘হিলিয়াম-তিন’ গ্যাস বেশি খরচও হবে না। এমনকী, চাঁদের মেরুতে দিনটাও অত তেতে থাকে না। কারণ, চাঁদের দুই মেরুতে সূর্যটা সব সময়েই থাকে তার দিগন্তে। তার চেয়ে বেশি ওপরে ওঠে না। মাথার ওপরে ওঠার তো কোনও কথাই নেই! চাঁদের মেরুতে দিনে সূর্যের খবরদারি ততটা থাকে না বলেই তা সভ্যতার দ্বিতীয় উপনিবেশের পক্ষে সহনীয় হবে। তবে সেখান থেকে সৌরশক্তি টানার জন্য ‘সোলার প্যানেল’গুলোকে চাঁদের দুই মেরুতে বসানো হবে কোণাকুণি ভাবে।’’

কিন্তু, চাঁদে সভ্যতার সেই ‘কলোনি’ কেন হবে আন্ডারগ্রাউন্ড’?

মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাকাশ-প্রযুক্তিবিদ হিল্লোল গুপ্তের ব্যাখ্যা, ‘‘তা না হলে সৌর-বিকিরণের ঝাপটায় নিকেশ হয় যাবে সভ্যতা। চাঁদে কোনও বায়ুমণ্ডল নেই বলে সূর্যের তাপে ঝলসে যাব আমরা। তাই হাইড্রোলিক এক্সক্যাভেটার বা ‘রোবট’ দিয়ে চাঁদের পিঠ খুঁড়ে তার নীচের স্তরে বা চাঁদের অভ্যন্তরেই বানাতে হবে সেই উপনিবেশ। যা সূর্যের গনগনে তাপ আর সৌর-বিকিরঁণের হাত থেকেও ওই উপনিবেশকে বাঁচাবে।’’

তাই আর কয়েকটা দিন পরে চাঁদে জমি, বাড়ি কেনার বিজ্ঞাপন ইন্টারনেটে দেওয়া হলে, প্লিজ, তাকে ‘টিজার’ ভাববেন না!!!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

second colony human civilization moon
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE