অস্তিত্ব যে আছে, সে ব্যাপারে সকলেই নিশ্চিত। কিন্তু কখনওই তার দেখা মেলেনি। ব্রহ্মাণ্ডের সেই অদৃশ্য ভূতুড়ে পদার্থের সন্ধানে একদা ‘ঘর-বাড়ি’ও ছেড়েছিলেন সার্নের বিজ্ঞানীরা। কিন্তু সে ধরা দেয়নি। রহস্য রহস্যই থেকে গিয়েছে! সেই ডার্ক ম্যাটারেরই নতুন করে খোঁজ শুরু হল আবার।
এ বার বিজ্ঞানীরা চাইছেন বৃহস্পতির আকারের ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বরের হদিস পেতে। আমেরিকার ক্যালিফর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল গবেষকের অনুমান, হাজার হাজার সূর্যের সমান বিশাল ব্ল্যাক হোল নয়, বরং তুলনায় অনেক ছোট, গ্রহাকৃতির ব্ল্যাক হোলের জঠরে যাবতীয় আঁধার কণার রহস্য লুকিয়ে রয়েছে।
আমাদের চারপাশে গাছপালা, নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, গ্রহ-উপগ্রহ, ছায়াপথ-সহ যে সমস্ত দৃশ্যমান জড় পদার্থগুলি দেখা যায়, তারা এই মহাবিশ্বের মোট ভরশক্তির ৫ শতাংশ মাত্র। বাকি ৯৫ শতাংশ সম্পূর্ণ অদৃশ্য। অজানা। রহস্যময় এক অন্ধকার জগৎ। তার মধ্যে ৭০ শতাংশই হল অদৃশ্য শক্তি (জ্যোতির্বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে ডার্ক এনার্জি)। আর ২৫ শতাংশ ডার্ক ম্যাটার।
এই ডার্ক ম্যাটারের শুধু অস্তিত্বটুকুই বিজ্ঞানীদের জানা। কিন্তু তার উৎস কী, কী দিয়ে তৈরি, তা এখনও সম্পূর্ণ অজানা। তবে এটা স্পষ্ট যে, আলোর সঙ্গে এই সব ভূতুড়ে পদার্থের কিছু একটা শত্রুতা রয়েছে। সে আলো শোষণ করে না। আলো প্রতিফলন, প্রতিসরণ বা বিচ্ছুরণ কিছুই করে না। ফলে একে দেখাও যায় না। মহাবিশ্বের এখানে-ওখানে সর্বত্র ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা সত্ত্বেও ডার্ক ম্যাটার দেখা যায় না কারণ, কোনও যন্ত্র বা ডিটেক্টর দিয়ে একে শনাক্ত করা যায় না। অন্য কোনও পদার্থের সঙ্গে কোনও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াও হয় না।
তাই এ বার ভিন্ন পথে হাঁটলেন ক্যালিফর্নিয়ার গবেষকেরা। তাঁরা একটি নতুন তত্ত্বের কথা বললেন। তার নাম— ‘সুপারহেভি নন-অ্যানাহিলেটিং ডার্ক ম্যাটার মডেল’। এই গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে ‘ফিজ়িক্যাল রিভিউ ডি’ জার্নালে।
ডার্ক ম্যাটার আমাদের পরিচিত ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন কণা দিয়ে তৈরি নয়। বিজ্ঞানীদের অনুমান, কোয়ান্টাম ফিজ়িক্স-এ ‘এক্সিয়ন’ নামে এক ধরনের পারমাণবিক কণার কথা বলা হয়, যার বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে ডার্ক ম্যাটারের কিছু মিল রয়েছে। হতে পারে ডার্ক ম্যাটার ‘এক্সিয়ন’ দিয়ে তৈরি। আবার না-ও হতে পারে। তবে সেই আঁধার কণা যা-ই হোক না, তার ভর অত্যন্ত বেশি। এখানেই ক্যালিফর্নিয়ার গবেষকদের মত, বিশাল ভরের এই কণাগুলি কখনওই একে অপরকে ধ্বংস করে না। বরং, সেগুলি কোটি কোটি বছর ধরে একে অপরের কাছাকাছি এসে ক্ষুদ্র ব্ল্যাক হোলের জন্ম দেয়।
কিন্তু প্রশ্ন হল, এরা একে অপরের কাছাকাছি আসবে কী ভাবে? গবেষণাপত্রের লেখকেরা জানাচ্ছেন, আমাদের সৌরজগতের বাইরে আরও অন্তত পাঁচ হাজার গ্রহের হদিস মিলেছে এখনও পর্যন্ত। তাদের অধিকাংশেরই আকৃতি বৃহস্পতির মতো। তাদের মধ্যে দিয়ে বিচরণ করার সময় অভিকর্ষ বলের টানে কিছু আঁধার কণা গ্রহের গর্ভে জমা হয়। অনুমান, দীর্ঘকাল ধরে এই প্রক্রিয়া চলার ফলে যে ব্ল্যাক হোল তৈরি হয়, ভবিষ্যতে তা-ই আড়েবহরে বাড়তে বাড়তে গোটা গ্রহকেই গিলে খেয়ে ফেলতে পারে। ফলে ব্ল্যাক হোলটির আকৃতিও সেই গ্রহটির মতোই হবে। তাই সে রকম ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্ব মিললে ‘সুপারহেভি নন-অ্যানাহিলেটিং ডার্ক ম্যাটার মডেল’ তত্ত্বের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে মনে করছেন ক্যালিফর্নিয়ার গবেষকেরা।
আঁধার কণাদের খোঁজে সার্নও জোর চেষ্টা চালিয়েছে। ভিটেমাটি ছাড়ার মতোই প্রচলিত ধারণার বাইরে বেরিয়ে ডার্ক ম্যাটারের চরিত্র বোঝার চেষ্টা করেছে তারা। সেই সূত্রেই ‘মাল্টি ডাইমেনশন’ তত্ত্বের অবতারণা ঘটেছিল।
‘স্ট্যান্ডার্ড মডেল’ অনুযায়ী, এই ব্রহ্মাণ্ডে মোট চার ধরনের বলের অস্তিত্বের কথা বলা হয়েছে । তা হল— তড়িৎ-চুম্বকীয় বল, দুর্বল বল (পরমাণুর কক্ষপথে ইলেকট্রনের ওপর কেন্দ্রে থাকা নিউক্লিয়াসের টান), শক্তিশালী বল (নিউক্লিয়াসে প্রোটন ও নিউট্রনকে যে বল বেঁধে রাখে) এবং অভিকর্ষ বল। কিন্তু এই চারটি বলের মধ্যে কেন অভিকর্ষ বলই সবচেয়ে দুর্বল, তার ব্যাখ্যা দিতে পারেনি ‘স্ট্যান্ডার্ড মডেল’। পরবর্তী কালে কোনও কোনও তত্ত্বে বলা হয়, ব্রহ্মাণ্ডের আরও অনেক তল বা ‘ডাইমেনশন’ রয়েছে। ব্রহ্মাণ্ড ‘মাল্টি-ডাইমেনশনাল’। অভিকর্ষ বল ছড়িয়ে রয়েছে সব ক’টি তলেই। যে তলটিকে আমরা দেখতে পারছি, সেই তলে তা অন্য বলগুলির মধ্যে দুর্বলতম।
তবে ব্রহ্মাণ্ডের ওই বহু তলের অস্তিত্বের প্রমাণ এখনও পায়নি সার্ন। কোনও কোনও তত্ত্ব বলছে, ব্রহ্মাণ্ডের সেই তলগুলি লুকিয়ে রয়েছে। একটা খবরের কাগজকে পাকিয়ে চোঙা বানিয়ে ফেললে যেমন তার একটি তল হারিয়ে যায়, ঠিক তেমনই। সম্ভবত সেই সব তলেই লুকিয়ে রয়েছে বিপুল পরিমাণ কণা। অজানা। অচেনা। অধরা।
কিন্তু সবটাই অনুমানের পর্যায়ে। কোনও কিছুরই প্রমাণ মেলেনি। নয়া তত্ত্বেও ব্ল্যাক ম্যাটারের অস্তিত্বের প্রমাণ কতটা মিলবে, তা নিয়ে সন্দিহান অনেকে। তাঁদের মত, আঁধার কণারা একে অপরের কাছাকাছি এসে যে ব্ল্যাক হোল তৈরি, তা-ই তো এখনও স্পষ্ট নয়। আর যদি তা হয়েও থাকে, সে ক্ষেত্রে তেমন ব্ল্যাক হোলের হদিস পাওয়া জরুরি। তা না হলে এই তত্ত্ব ধরে একধাপও এগোনো যাবে না।