Advertisement
E-Paper

তাকিয়ে না-দেখলে আকাশে চাঁদটাও নেই!

ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণার রাজ্যে যা ঠিক, সেই কোয়ান্টাম বড়সড় বস্তুর বেলায় সত্যি হলে তো তাকিয়ে না-দেখলে (দেখা মানে শনাক্ত করা) চাঁদটাও আকাশে নেই।

পথিক গুহ

শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০১৮ ০২:৫৮
আলবার্ট আইনস্টাইন

আলবার্ট আইনস্টাইন

প্রশ্নটা বিখ্যাত। তুলেছিলেন স্বয়ং আলবার্ট আইনস্টাইন। তাঁর বিখ্যাত জীবনীগ্রন্থের (‘সাটল ইজ দ্য লর্ড’) শুরুতেই লেখক আব্রাহাম পায়াস জানিয়েছেন ঘটনাটা। সাল ১৯৫০। মহাবিজ্ঞানী তখন প্রিন্সটনের ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডি-তে গবেষণারত। এক দিন ইনস্টিটিউট থেকে হেঁটে ফিরছেন আইনস্টাইন ও পায়াস। হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন আইনস্টাইন। পায়াসকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘তুমিও কি বিশ্বাস কর যে, তাকিয়ে না-দেখলে আকাশে চাঁদটা নেই?’’ প্রশ্ন শুনে পায়াস থ।

কথা হচ্ছিল বিজ্ঞানের অদ্ভুতুড়ে তত্ত্ব কোয়ান্টাম থিয়োরি নিয়ে। যে তত্ত্বের দাবি: শনাক্ত না-হলে কোনও একটা কণার অস্তিত্ব নেই। এ হেন তত্ত্ব কি মানা যায়? নাহ্, তা মানেন না আইনস্টাইন। তাঁর (এবং আমাদের মতো সাধারণ মানুষের ধারণা): কণাটা নিজে থেকে আছে। শনাক্ত হলে আছে, না-হলেও আছে।

হায়, অবিশ্বাস্য হলেও কোয়ান্টামের দাবি কিন্তু ঠিক। গত শতাব্দীর গোড়ায় আবিষ্কারের পর থেকে একের পর এক পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে, কোয়ান্টাম অভ্রান্ত। তাই নবীন গবেষকেরা মেতে উঠেছিলেন তত্ত্বটা নিয়ে। বিষয়টাকে বলাও হত ‘বয়েজ ফিজিক্স’। আর আইনস্টাইন? কোয়ান্টামের বিরোধিতা করে প্রবীণ এই বিজ্ঞানী হয়ে গিয়েছিলেন প্রায় একঘরে। পায়াস বয়সে নবীন এবং কোয়ান্টামের সমর্থক, তাই তাঁর উদ্দেশে আইনস্টাইনের ওই চোখা প্রশ্ন। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণার রাজ্যে যা ঠিক, সেই কোয়ান্টাম বড়সড় বস্তুর বেলায় সত্যি হলে তো তাকিয়ে না-দেখলে (দেখা মানে শনাক্ত করা) চাঁদটাও আকাশে নেই।

আরও পড়ুন: মানুষ এড়াতে বদলে যাচ্ছে বন্য জীবন!

আইনস্টাইনের ওই প্রশ্ন থেকে জন্ম নিয়েছে আধুনিক বিজ্ঞানের এক বড় ধাঁধা। অণু-পরমাণুর রাজ্যের নিয়ম কোয়ান্টাম কি বড় আকারের বস্তুর বেলাতেও খাটে? অথবা, বস্তুর আকার কত বড় হওয়া পর্যন্ত সে অদ্ভুতুড়ে নিয়ম চালু থাকে?

প্রশ্নগুলোর হেস্তনেস্ত করার পথ বাতলে সাড়া ফেলে দিয়েছেন তিন বাঙালি বিজ্ঞানী। কলকাতায় বসু বিজ্ঞান মন্দিরের দীপঙ্কর হোম, সত্যেন্দ্রনাথ বোস ন্যাশনাল সেন্টার ফর বেসিক সায়েন্সেস-এর শিলাদিত্য মাল এবং লন্ডনে ইউনিভার্সিটি কলেজের সৌগত বসু। বিখ্যাত জার্নাল ‘ফিজিক্যাল রিভিউ লেটারস’-এ এক পেপার লিখে ওই ত্রয়ী পরিকল্পনা করেছেন এক সূক্ষ্ম পরীক্ষার। ল্যাবরেটরিতে যা করলে জানা যাবে, বড় বস্তুও কোয়ান্টামের অদ্ভুতুড়ে নিয়ম মানে কি না। তা মানলে বা না-মানলে কী কী হতে পারে, সেটা ১৯৮৫ সালে বলেছিলেন নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী অ্যান্টনি জেমস লেগেট এবং তাঁর ভারতীয় ছাত্র অনুপম গর্গ। ওই সব সম্ভাবনার কোনটা ঠিক, তা জানতে কেমন পরীক্ষা করতে হবে, তা বলেছেন দীপঙ্কর, শিলাদিত্য এবং সৌগত।

কেমন পরীক্ষা? হাইড্রোজেন পরমাণুর চেয়ে কয়েক লক্ষ বা কয়েকশো কোটি গুণ বেশি ভারী সিলিকা কণা (বিজ্ঞানের বিচারে বড় বস্তু) পেন্ডুলামের মতো দুলবে। যাবে ডান দিক-বাঁ দিক। কখন তা কোন দিকে, সেটা জানা হবে আলো ফেলে। সিলিকা কণার গায়ে আলো পড়লে তা থেকে আলো ঠিকরে বেরোবে। জানা যাবে কণাটা কখন কোন দিকে আছে। আসলে, কণাটা কোন দিকে নেই, সেটা জানাই হবে গবেষকদের উদ্দেশ্য।

এ বার ধরা যাক, আলো ফেলা হল ডান দিকে। আলো ঠিকরোল না। মানে, নিশ্চিত হওয়া গেল, কণা রয়েছে বাঁ দিকে। এর এক সেকেন্ডের দশ লক্ষ ভাগের এক ভাগ সময় পরে বাঁ দিকে আলো ফেলে প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা হবে। এ ভাবে মুহুর্মুহু বারবার পরীক্ষা। যদি সিলিকা কণা আমাদের চারপাশের বড়সড় বস্তুর (চেয়ার-টেবিল, গাছপালা) নিয়ম মানে, তা হলে তা ডান দিকে না থাকলে বাঁ দিকে থাকবেই। তাকে না দেখেও আমরা এই সিদ্ধান্ত নিতে পারি। আর যদি সে কণা কোয়ান্টামের নিয়ম মানে? তা হলে আজব ব্যাপার! তখন সিলিকা কণা কোনও একটা নির্দিষ্ট দিকে না-থাকলেও সে দিক থেকে আলো ঠিকরোবে। যে দিকে আলো ফেলা (দেখা) হবে, মনে হবে কণা সে দিকেই রয়েছে। তখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আলো ফেললে কণা আছে, না-ফেললে নেই।

দীপঙ্কর বললেন, ‘‘কোয়ান্টামের আর এক দাবি, যাকে মানতে না-পেরে আইনস্টাইন বলতেন, ‘দূর থেকে ভুতুড়ে যোগাযোগ’, তা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা ষাটের দশক থেকে। আর পরীক্ষা-নিরীক্ষা আশির দশক থেকে। কিন্তু ওই ‘দেখলে আছে, না দেখলে নেই’ ব্যাপারটা নিয়ে পরীক্ষা
হালফিল হচ্ছে। সে সব পরীক্ষার মধ্যে এগিয়ে থাকবে আমাদের প্ল্যান।’’ দীপঙ্করের মতে, প্রযুক্তি যা এগিয়েছে, তাতে তাঁদের প্রস্তাবিত পরীক্ষাটা সব চেয়ে সহজও।

দীপঙ্করের দাবি মানছেন সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী হেনড্রিক উলব্রিখ্‌ট। তাঁর মন্তব্য, ‘‘এ ব্যাপারে অন্য পরীক্ষার তুলনায় এটা কম জটিল। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে আমরা ওই পরীক্ষায় নামব।’’

যদি দেখা যায় বড়সড় বস্তুও কোয়ান্টাম মানছে, তা হলে কী লাভ? উত্তরে সৌগত বললেন, ‘‘মহাকর্ষ বল হিসেবে দুর্বল। বড় বস্তুর মহাকর্ষ থাকলেও, তা পরিমাণে কম। বড় বস্তু যদি কোয়ান্টামের নিয়ম মানে, তবে অতি-সংবেদনশীল যন্ত্র বানিয়ে মহাকর্ষের প্রভাব শনাক্ত করা যাবে।’’

quantum theory Albert Einstein কোয়ান্টাম তত্ত্ব আলবার্ট আইনস্টাইন
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy