পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ চাঁদকে নিয়ে মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। চাঁদে মহাকাশযান পাঠানো হয়েছে। মানুষ নিজেও সশরীরে পৌঁছে গিয়েছে। কিন্তু এখনও চাঁদের অন্দরে রয়ে গিয়েছে অনেক রহস্য। যার পর্দা উন্মোচন করতে নিরন্তর গবেষণা চলছে। তেমনই একটি গবেষণায় চাঁদের অন্তরঙ্গ সম্বন্ধে বিশদ কিছু তথ্য পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। যা ভবিষ্যৎ পর্যবেক্ষণে কাজে লাগতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
ফ্রেঞ্চ ন্যাশনাল সেন্টার ফর সায়েন্টিফিক রিসার্চের বিজ্ঞানী আর্থার ব্রিয়ডের নেতৃত্বাধীন দল চাঁদের অভ্যন্তরের পদার্থ নিয়ে গবেষণা করেছে। ‘নেচার’ পত্রিকায় সেই গবেষণার ফল প্রকাশিত হয়েছে। আর্থার বলেন, ‘‘চাঁদের চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের বিবর্তন নিয়ে প্রশ্ন তোলে আমাদের গবেষণা। সেখান থেকে চাঁদের অভ্যন্তরীণ কেন্দ্রের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়।’’ বস্তুত, সৌরজগতের যে কোনও বস্তুর অভ্যন্তরীণ পদার্থ সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে ভূকম্পীয় তরঙ্গ। ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট শব্দতরঙ্গ যে ভাবে কোনও গ্রহ বা উপগ্রহের অভ্যন্তরের বস্তুর মধ্যে দিয়ে যায় এবং তার উপর প্রতিফলিত হয়, তা ওই বস্তুর অভ্যন্তরের মানচিত্র তৈরি করতে বিজ্ঞানীদের সাহায্য করে। ফান্সের এই গবেষণার মূলেও ছিল ভূকম্পীয় তরঙ্গ।
আরও পড়ুন:
১৯৬১ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত চাঁদে ‘অ্যাপোলো অভিযান’ চালিয়েছিল মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা। এই অভিযানে একাধিক বার চাঁদে মানুষের পা পড়েছে। তখনই চাঁদের ভূমিকম্পের তরঙ্গ সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল। তা ঘেঁটে দেখেছেন ফ্রান্সের বিজ্ঞানীরা। কিন্তু অ্যাপোলো অভিযানের সেই তথ্যের মান খুব উচ্চ নয়। চাঁদের অভ্যন্তরীণ কেন্দ্র বা ‘কোর’ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা অ্যাপোলো দিতে পারেনি। চাঁদের বহিরঙ্গে তরলের আবরণ (ফ্লুইড আউটার কোর) রয়েছে। কিন্তু তার ভিতরে কী কী আছে, জানা যায়নি। অ্যাপোলোর তথ্য থেকে যা মিলেছে, তা থেকে কেন্দ্রে কঠিন বা তরল, দুই ধরনের পদার্থের অস্তিত্বই প্রমাণ করা যায়।
এই সংক্রান্ত ধন্দ দূর করতেই বিভিন্ন মহাকাশ অভিযান এবং চাঁদের লেজ়ার রেঞ্জিং পরীক্ষানিরীক্ষা থেকে আরও বিশদ তথ্য সংগ্রহ করেন ফ্রান্সের বিজ্ঞানীরা। চাঁদের বিবিধ বৈশিষ্ট্য খুঁটিয়ে পরীক্ষা করা হয়। পৃথিবীর সঙ্গে মহাকর্ষীয় মিথষ্ক্রিয়ার কারণে চাঁদের বিকৃতি, পৃথিবী থেকে এর দূরত্বের পার্থক্য এবং ঘনত্ব বিবেচনা করা হয়। গবেষণার মাধ্যমে চাঁদের নানা ধরনের অভ্যন্তরীণ কেন্দ্রের মডেল তৈরি করেন বিজ্ঞানীরা। তার পর আসল পর্যবেক্ষণের সঙ্গে সেই মডেল মিলিয়ে দেখা হয়।
আরও পড়ুন:
বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, চাঁদের ভিতরের দিকের পদার্থের ঘনত্ব বহিরঙ্গের পদার্থের ঘনত্বের চেয়ে বেশি। আসলে চাঁদের অভ্যন্তরীণ কেন্দ্রটির সঙ্গে পৃথিবীর কেন্দ্রের অনেক সাদৃশ্য রয়েছে। এর বাইরের দিকে তরল স্তর এবং অন্দরে কঠিন স্তর রয়েছে। বাইরের কোরের ব্যাসার্ধ প্রায় ৩৬২কিলোমিটার, ভিতরের কোরের ব্যাসার্ধ ২৫৮ কিলোমিটার। এটি সমগ্র চাঁদের ব্যাসার্ধের ১৫ শতাংশ। অভ্যন্তরীণ কেন্দ্রের ঘনত্ব প্রতি ঘনমিটারে প্রায় ৭,৮২২ কিলোগ্রাম। বিজ্ঞানীদের ধারণা, চাঁদের অভ্যন্তর তৈরি হয়েছে লোহার মতো কোনও পদার্থ দিয়ে। অভ্যন্তরের পদার্থের ঘনত্ব লোহার ঘনত্বের প্রায় সমান। তবে ওই পদার্থ লোহাই কি না, তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারেননি এখনও। ২০১১ সালে নাসার একটি দল চাঁদ নিয়ে গবেষণা করে যে তথ্য পেয়েছিল, তার সঙ্গে ফ্রান্সের এই নতুন গবেষণা অনেকাংশে মিলে গিয়েছে।
চাঁদের সৃষ্টির পরেই তার মধ্যে একটি শক্তিশালী চৌম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ৩০০ কোটি বছর আগে এর চৌম্বকশক্তি ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। এখন আর তার অস্তিত্ব নেই। বিজ্ঞানীদের ধারণা, চৌম্বকক্ষেত্রের এই অন্তর্ধানও চাঁদের অভ্যন্তরের পদার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত। তবে আগামী দিনে ভূকম্পীয় তরঙ্গের মাধ্যমে এই তথ্য আরও যাচাই করা প্রয়োজন।