Advertisement
E-Paper

উড়ছে ছাই, ধিকধিক করে জ্বলছে আগুন

তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ছাইয়ে ঢেকেছে এলাকা। এক দিকে হাঁপানি, অন্য দিকে ফসল নষ্ট। ছাই-গাড়ির দাপটে ভেঙে যাচ্ছে রাস্তা। ব্যাহত হচ্ছে জীবনযাপন। খোঁজ নিল আনন্দবাজার।বহুবার বিক্ষোভ-অবরোধ হয়েছে। প্রশাসনের কাছে বহু আবেদন-নিবেদন করা হয়েছে। সুরাহা হয়নি। এখন ছাই-দূষণ সঙ্গে নিয়ে বেঁচে থাকাটাই ভবিতব্য বলে মেনে নিয়েছেন বাঁকুড়ার গঙ্গাজলঘাটি ব্লকের এক বিস্তীর্ণ এলাকার বাসিন্দারা। তাঁদের অভিযোগের তির, ওই ব্লকের লটিয়াবনি এলাকায় থাকা ডিভিসি-র মেজিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র কর্তৃপক্ষের (এমটিপিএস) দিকে।

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:৫৯
এ ভাবেই ভরা বাজারের ভিতর দিয়ে ত্রিপলে ঢাকা ছাই নিয়ে ডাম্পার যাতায়াত করে। মেজিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র লাগোয়া এলাকায় ছবিটি তুলেছেন অভিজিৎ সিংহ।

এ ভাবেই ভরা বাজারের ভিতর দিয়ে ত্রিপলে ঢাকা ছাই নিয়ে ডাম্পার যাতায়াত করে। মেজিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র লাগোয়া এলাকায় ছবিটি তুলেছেন অভিজিৎ সিংহ।

বহুবার বিক্ষোভ-অবরোধ হয়েছে। প্রশাসনের কাছে বহু আবেদন-নিবেদন করা হয়েছে। সুরাহা হয়নি। এখন ছাই-দূষণ সঙ্গে নিয়ে বেঁচে থাকাটাই ভবিতব্য বলে মেনে নিয়েছেন বাঁকুড়ার গঙ্গাজলঘাটি ব্লকের এক বিস্তীর্ণ এলাকার বাসিন্দারা। তাঁদের অভিযোগের তির, ওই ব্লকের লটিয়াবনি এলাকায় থাকা ডিভিসি-র মেজিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র কর্তৃপক্ষের (এমটিপিএস) দিকে। বিধিনিষেধের তোয়াক্কা না করে নাম কে ওয়াস্তে ত্রিপল দিয়ে ট্রাক-ডাম্পারের চারপাশ ঢেকে ওই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে মাত্রাতিরিক্ত ছাই পরিবহণের জন্যই তাঁদের নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়, এমনটাই অভিযোগ স্থানীয় মানুষের।

অথচ ঘটনা হল, ছাইবহনকারী গাড়িগুলি থেকে কোনও ভাবেই ছাই ওড়া চলবে না বলে নির্দেশ রয়েছে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের। দূষণ ঠেকাতে টিনের পাত দিয়ে গাড়ির চারপাশ ঘিরে দেওয়া এবং গাড়ির মালধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী ছাই পরিবহণ করার বিষয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষকে সচেতনও করা হয়েছে দফতরের তরফে। কিন্তু, সেই সব পরামর্শ ও নির্দেশ মানা হয় না বলেই অভিযোগ এলাকাবাসীর। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের দুর্গাপুর আঞ্চলিক অফিসের অ্যাসিস্ট্যান্ট এনভায়রনমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার শিশির মণ্ডল বলেন, “ছাই পরিবহণকারী গাড়িগুলি থেকে ঝাঁকুনিতে যাতে ছাই উড়ে না পড়ে, তার জন্য গাড়ির পিছনে চারপাশ টিনের পাত দিয়ে ঘিরে তার উপর ত্রিপল দিয়ে ঢাকা দেওয়া নিয়ম। সেই সঙ্গে গাড়ির মালধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী মাল পরিবহণ করার নির্দেশ আমরা এমটিপিএসকে দিয়েছি।” বাস্তবে সেই নির্দেশ মানা হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন শিশিরবাবুই। তাঁর বক্তব্য, “টিনের পাতের বদলে শুধু ত্রিপলে ঢেকেই ছাই পরিবহণ করা হচ্ছে। যার ফলে রাস্তার ঝাঁকুনিতে গাড়ি থেকে ছাই উড়ে রাস্তায় পড়ছে। এই বিষয়টির দিকে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের নজরদারি রয়েছে।”

স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিজ্ঞতাও তাই। তাঁরা জানান, অতিরিক্ত ছাই নিয়ে যাওয়ায় ওই ডাম্পার বা ট্রাকের মাথা উঁচু হয়ে থাকছে। ত্রিপল দিয়ে ঢাকার চেষ্টা করলেও গাড়ি চললেই হাওয়ায় ছাই উড়ছে। আবার পথের গর্তে চাকা পড়ে ঝাঁকুনিতেও ছাই উড়ছে। স্থানীয় লাগাপাড়ার বাসিন্দা তরুণ বাজপেয়ী বলেন, “ছাই-দূষণ কমানোর জন্য অতিরিক্ত ছাই পরিবহণ যাতে বন্ধ করা হয়, সে জন্য জেলার পুলিশ ও প্রশাসনকে বার বার দাবি জানিয়ে আমরা ক্লান্ত হয়ে গিয়েছি। কাজের কাজ হয়নি।” নন্দনপুরের বাসিন্দা রামবন্ধু কর্মকারের কথায়, “বাইরে জামাকাপড় শুকোতে দিলে ছাইয়ের গুঁড়োয় কালো হয়ে যাচ্ছে। ঘরের মেঝে, দেওয়াল, ছাদ সব জায়গায় ছাইয়ের গুঁড়ো। পা ফেলার পর্যন্ত জায়গা নেই!” মাছবাঁধার রামেশ্বর লায়েক বললেন, “রাস্তায় বের হলেই উড়ন্ত ছাই গায়ে এসে পড়ে, মুখে ঢুকে যায়। শরীর চুলকোতে থাকে।”

গঙ্গাজলঘাটির ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক শুভদীপ বটব্যাল বলেন, “বাতাসে ভাসমান ডিভিসির ছাইয়ের সিলিকা কণা নিশ্বাসের মাধ্যমে মানুষের শ্বাসনালিতে ঢুকছে। এর ফলে শ্বাস কষ্ট জনিত নানা রোগ এলাকার মানুষের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস, সর্দি-কাশি, ত্বকে চুলকুনি বিভিন্ন ধরনের অ্যালার্জিতে ভোগা রোগীর সংখ্যা ক্রমশ এলাকায় বাড়ছে।” তিনি জানান, শুধু তাপবিদ্যু কেন্দ্র সংলগ্ন এলাকাতেই এই সব রোগ সীমাবদ্ধ নয়, গোটা গঙ্গাজলঘাটি ব্লকেই বাতাসের মাধ্যমে ছাই ছড়িয়ে পড়ছে। তাতে এই ধরনের অসুস্থতাও ছড়াচ্ছে। তাঁর মতে, দীর্ঘদিন ধরে কোনও মানুষের শরীরে যদি ছাই ঢুকতে থাকে তাহলে প্রাণ সংশয় পর্যন্ত হতে পারে। এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসা অসুস্থদের মধ্যে প্রতি তিনজনে মধ্যে দু’জন ছাই দুষণের নানা সংক্রমণের শিকার।

শুধু স্বাস্থ্যক্ষেত্রই নয়, কৃষি ক্ষেত্রেও ছাই দুষণের কুপ্রভাব দেখা যাচ্ছে। চাষজমিতে ছাই পড়ে জমির উর্বরা শক্তি হ্রাস পাচ্ছে বলে জানাচ্ছেন গঙ্গাজলঘাটি ব্লক কৃষি আধিকারিক শঙ্কর দাস। তিনি বলেন, “রাস্তা দিয়ে ছাই পরিবহণ করার সময় গাড়ি থেকে ছাই উড়ে রাস্তা সংলগ্ন কৃষি জমিতে পড়ছে। যার ফলে জমির উপকারি জীবাণু যা কৃষিতে সহায়ক তা মারা যাচ্ছে। আবার গাছের পাতার পত্ররন্ধ্রে ছাই পড়ছে। যার ফলে সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়াও বাধা পাচ্ছে। ফলন কমছে।” তিনি জানান, গঙ্গাজলঘাটি ব্লকের প্রায় ৫০০ হেক্টর জমি ছাই দুষণের কবলে পড়েছে।

ডিভিসি-র মেজিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ডেপুটি চিফ ইঞ্জিনিয়ার অশোককুমার ভার্মার দাবি, “দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের নিয়ম মেনেই ছাইবহনকারী ঠিকা সংস্থা টিনের পাত এবং তার উপরে ত্রিপল বিছিয়ে ছাই নিয়ে যাচ্ছে। গাড়ি থেকে ছাই পড়ে যাওয়ার অভিযোগ ঠিক নয়।” একই দাবি করেছেন, ডিভিসি-র ছাই পরিবহণকারী ঠিকা সংস্থার অন্যতম এক কর্তা বিশ্বদীপ দে। তিনি বলেন, “ছাই পরিবহণ করার ক্ষেত্রে ডিভিসি আমাদের যে পদ্ধতি অনুসরণ করতে বলেছে আমরা পুরোপুরি তা মেনে চলছি।”

অতিরিক্ত মালবহনে ভাঙছে রাস্তাও। এ নিয়ে আবার জেলা প্রশাসন ও ডিভিসি-র চাপানউতোর শুরু হয়েছে।

mejia thermal power station pollution rajdeep
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy