E-Paper

ব্যাক্টিরিয়ার ‘বর্ম’ ভেদ, যক্ষ্মার নিরাময়ের সন্ধান বিজ্ঞানীদের

বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, যক্ষ্মার ব্যাক্টিরিয়া বিপদ বুঝলেই নিজস্ব ‘বর্ম’-এর আড়ালে চলে যেতে পারে। কোনও অ্যান্টিবায়োটিক কিছু করতে পারে না। শুধু তাই না, নিজেদের আণুবীক্ষনিক শরীরের বাইরের ওই ফ্যাট বা লিপিড কোষের পর্দা (মেমব্রেন) বারবার বদলে আত্মগোপন করে বেঁচে থাকতে পারে তারা।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৯:২৫

—প্রতীকী চিত্র।

এক শতক পেরিয়েও এক আতঙ্কের নাম যক্ষ্মা। অতি আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থাও কাবু করতে পারেনি এই অসুখের জন্য দায়ী এক অতি ক্ষুদ্র অনুজীবীকে। সেই ব্যাক্টিরিয়ার নাম ‘মাইকোব্যাকটিরিয়াম টিউবারকুলোসিস’। শুধু ২০২৩ সালেই ১ কোটি ৮ লক্ষ মানুষ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়েছেন। ১২ লক্ষ ৫০ হাজার মানুষ মারা গিয়েছেন। যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যায় সবচেয়ে এগিয়ে ভারত। ২০২৪ সালে এ দেশে ২৬ লক্ষ মানুষ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে নথিভুক্ত হয়েছে। কেন ধ্বংস করা যায়নি এই অতি ক্ষুদ্র ব্যাক্টিরিয়াকে, দীর্ঘ দিন ধরে তার উত্তর খুঁজছেন বিজ্ঞানীরা।

সম্প্রতি নিজেদের গবেষণায় এর কারণ ব্যাখ্যা করলেন আইআইটি বম্বের এক দল বিজ্ঞানী। নিরাময়ে দিশাও দেখালেন তাঁরা। গবেষণাপত্রটি ‘কেমিক্যাল সায়েন্স’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।

বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, যক্ষ্মার ব্যাক্টিরিয়া বিপদ বুঝলেই নিজস্ব ‘বর্ম’-এর আড়ালে চলে যেতে পারে। কোনও অ্যান্টিবায়োটিক কিছু করতে পারে না। শুধু তাই না, নিজেদের আণুবীক্ষনিক শরীরের বাইরের ওই ফ্যাট বা লিপিড কোষের পর্দা (মেমব্রেন) বারবার বদলে আত্মগোপন করে বেঁচে থাকতে পারে তারা।

বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, প্রাথমিক ভাবে সংক্রমণের পরেই তারা ‘সুপ্ত দশায়’ চলে যেতে পারে। এই দশায়, মাইকোব্যাকটিরিয়াম টিউবারকুলোসিস বেঁচে থাকে, কিন্তু নিষ্ক্রিয় থাকে। অনেক সময় কয়েক বছর তারা এ ভাবে কাটিয়ে দেয়। যে সব মানুষ এই ধরনের সুপ্ত যক্ষ্মায় আক্রান্ত হন, তাঁদের কোনও উপসর্গ থাকে না। তাঁদের থেকে অন্য কেউ সংক্রমিতও হন না। কিন্তু ওইব্যক্তির শরীরে ব্যাক্টিরিয়াটি থাকে। তাঁর শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হলেই ব্যাক্টিরিয়াটি সক্রিয় হয়ে ওঠে ও আক্রমণ করে। এ দিকে, ব্যাক্টিরিয়ার সুপ্ত দশায় অ্যান্টিবায়োটিক কোনও কাজ করে না। তা সক্রিয় হলে তব অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করে।

নতুন গবেষণাটির নেতৃত্বে রয়েছেন আইআইটি বম্বে-র রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক শোভনা কপূর এবং মনাশ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মারি-ইজ়াবেল অ্যাগুলার। গবেষণায় মূল যে প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিলেন তাঁরা, তা হল: কেন সুপ্ত দশায় ব্যাক্টিরিয়াটিকে কাবু করতে পারে না অ্যান্টিবায়োটিক? সেই সঙ্গে তাঁরা ব্যাক্টিরিয়ার লিপিডের পর্দাটির উপরে নজর দেন।

যক্ষ্মার ব্যাক্টিরিয়া নিয়ে কাজ করা খুব বিপজ্জনক। তাই তার সমগোত্রীয় ‘মাইকোব্যাকটিরিয়াম স্মেগম্যাটিস’ ব্যবহার করেছেন শোভনারা।এটির চরিত্র একই, শুধু ক্ষতিকরনয়। তারা ব্যাক্টিরিয়ার সক্রিয়এবং নিষ্ক্রিয়, দু’টি দশার উপরেই পরীক্ষা চালান। যক্ষ্মার চারটি ওষুধ প্রয়োগ করে তাঁরা দেখেন, প্রাথমিক পর্যায়ে সক্রিয় ব্যাক্টিরিয়াকে মারতে ভাল কাজ করলেও দীর্ঘদিন সুপ্ত দশায় থাকার পরে সক্রিয় ব্যাক্টিরিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে নাজেহাল দশা ওষুধের। এর কারণ খুঁজতে শুরু করেন বিজ্ঞানীরা। তাঁরা ব্যাক্টিরিয়ার পর্দায় ২৭০টি পৃথক লিপিড অণুর সন্ধান পান।

প্রধান গবেষক অঞ্জনা মেনন জানান, ব্যাক্টিরিয়ার সক্রিয় এবং নিষ্ক্রিয় দশায় পর্দার লিপিড প্রোফাইলের তফাত ধরা পড়ে পরীক্ষায়। সক্রিয় ব্যাক্টিরিয়ার পর্দায় রয়েছে গ্লিসেরোফসফোলিপিডস ও গ্লাইকোলিপিডিস। নিষ্ক্রিয় ব্যাক্টিরিয়ার পর্দায় রয়েছে ফ্যাটি অ্যাসাইল। গঠনগত এই পার্থক্যের ফলে সক্রিয় ব্যাক্টিরিয়ার পর্দা পাতলা ও তরলীকৃত। নিষ্ক্রিয় ব্যাক্টিরিয়ার পর্দা দৃঢ়, অনমনীয় ও আঁটসাঁট। বিজ্ঞানীরা আরও খতিয়ে দেখেছেন যে, ‘কার্ডিয়োলিপিন’ নামে একটি লিপিড সক্রিয় ব্যাক্টিরিয়ার পর্দাকে পাতলা রাখে। নিষ্ক্রিয় ব্যাক্টিরিয়ার পর্দায় কার্ডিয়োলিপিন একেবারেকম থাকে।

শোভনা জানান, নিষ্ক্রিয় ব্যাক্টিরিয়াকে কাবু করতে গিয়ে অ্যান্টিবায়োটিক যে নাজেহাল হয়, তার কারণ ওর শক্ত, আঁটোসাঁটো পর্দা। ওই পর্দাটি অ্যান্টিবায়োটিকের রাস্তা বন্ধ করে দেয়। যদি ওই পর্দাটিকে পাতলা করে দেওয়া যায়, ওষুধ ভাল কাজ করতে পারে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। শোভনা জানান, গবেষণার পরবর্তী ধাপে এই নিয়েই কাজ চলছে। অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল পেপটাইড ব্যাক্টিরিয়ার পর্দাকে কিছুটা পাতলা, ছিদ্রময় করে দেয়। এই পেপটাইডের সাহায্যে নিষ্ক্রিয় ব্যাক্টিরিয়ার পর্দার চরিত্র বদলে অ্যান্টিবায়োটিককে কার্যকর করা সম্ভব হবে বলেতাঁদের বিশ্বাস।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

TB Medical Science

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy