সোশ্যাল মিডিয়ায় এই ছবি ঘিরে উঠেছিল বিতর্কের ঝড় (বাঁ দিকে)। ছুতমার্গ কাটাতে শহরে চলেছিল এমন প্রচার।
শহর যেন প্রাপ্তমনস্ক ও সহিষ্ণু হয়ে ওঠে, তার রব উঠছে বারবার। সেই রবে সাড়া দিতে চলছে নানা প্রয়াস। তাতেই যোগ হয়েছে আরও একটি পদক্ষেপ। নতুন বছরে এ শহরেরই একটি সংস্থায় মহিলা কর্মীদের উপহার দেওয়া হচ্ছে বারোটি ‘পিরিয়ড লিভ’। ঋতুকালীন শারীরিক ও মানসিক কোনও অসুবিধার ক্ষেত্রে সেই ছুটি তাঁরা নিতে পারবেন। দেশের অন্যত্র কিছু সংস্থায় ইতিমধ্যে এমন ভাবনা দেখা গেলেও এ শহরে তা বিশেষ চোখে পড়েনি। ফলে নতুন বছর যে এমন একটি সুখবার্তা নিয়ে আসতে চলেছে, তাতে খুশি অনেকেই। তবে তার সঙ্গেই যোগ হয়েছে সংশয়। মেয়েদের বেশি ছুটি মানে কাজের ক্ষেত্রে কম গুরুত্ব নয় তো? গুরুত্ব কী ভাবে সমান হবে, যদি এক দল কর্মী বেশি ছুটি পান? এ কি মেয়েদের এগিয়ে দেওয়া নাকি আবার পিছিয়েই দেওয়া? তৈরি হয়েছে বিতর্ক।
বেশি ছুটির কথা শুনে যেমন শঙ্কিত শহরের একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মী মোনালিসা সামন্ত। সন্তানের অসুস্থতা বা সংসারের প্রয়োজনে কখনও বেশি ছুটি চাইলেই যেখানে পুরুষ সহকর্মীদের টিপ্পনী শুনতে হয়, সেখানে ঋতুকালীন ছুটি তাঁর সংস্থায় ঘোষিত হলেও তা নেওয়া সম্মানের হবে কি? দক্ষিণ কলকাতার যে সংস্থায় এই ছুটি ঘোষিত হচ্ছে আগামী জানুয়ারি মাস থেকে, তার কর্ণধার সাম্য দত্ত অবশ্য অন্য কথাই বলছেন। সাম্যর কথায়, ‘‘এতে বরং কর্মীদের মধ্যে সহমর্মিতা বাড়বে।’’ তিনি জানান, তাঁর সংস্থায় ১৪ জন মহিলা এবং ১৩ জন পুরুষ কর্মী আছেন। একে-অপরের সুবিধে-অসুবিধের কথা বুঝেই তাঁদের কাজ করতে হয়। এ ক্ষেত্রেও তেমনটাই হবে। ঋতুস্রাব নিয়ে যে অহেতুক ছুতমার্গ আছে, এতে তা-ও কাটবে বলে মত সাম্যর। এই কথারই রেশ পাওয়া গেল একটি নামী সংস্থার মানবসম্পদ বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট অর্ণব বিশ্বাসের ভাবনায়। তিনি বলেন, ‘‘এই ক’দিনের ছুটি কর্মী ও কর্তৃপক্ষের মধ্যে সম্পর্ক মজবুত করে। যিনি সহিষ্ণু আচরণ পাবেন, তিনি তো কর্তব্যের প্রতি আরও একনিষ্ঠ হবেন।’’ শহরের আর একটি সংস্থার মানবসম্পদ বিভাগের শীর্ষ কর্তা জর্জ থমাস এই উদ্যোগকে আহ্বান জানাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘‘এই ধরনের ব্যবস্থা মেয়েদের এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে।’’ স্ত্রীরোগ চিকিৎসক সাত্যকি হালদার বলছিলেন, সব মহিলার এই সময়ে ছুটি প্রয়োজন না হলেও, অনেকেরই হয়। ফলে ঋতুকালীন ছুটি নেওয়ার ব্যবস্থাটুকু থাকা খুব জরুরি।
কিন্তু যে কর্মীরা পাবেন না এই ছুটির সুযোগ, তাঁদের আবার এটিকে ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতাকে উস্কানি দেওয়া মনে হবে না তো? প্রশ্ন তুললেন এক বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষক ঋতবান রক্ষিত। তিনি বলেন, ‘‘এই পদক্ষেপের প্রতি পূর্ণ সম্মান থাকলেও প্রশ্নটা চলেই আসে। আমার স্কুলে মহিলা কর্মীর সংখ্যাই বেশি। এই ছুটি যদি আমাদের স্কুলেও চালু হয় এবং সকলে তা নেন, তবে যে ক’জন পুরুষ শিক্ষক আছি, তাঁদের কাজের বোঝা অনেক বেড়ে যাবে। তখন সকলের আচরণ সংবেদনশীল থাকবে কি না, সত্যিই জানি না।’’ কর্মক্ষেত্রে এমনই ভেদাভেদ বাড়ার আশঙ্কা ভাবাচ্ছে নারী আন্দোলনের কর্মী শাশ্বতী ঘোষকেও। তিনি বলছিলেন, ‘‘এমন উদ্যোগ খুবই ভাল। অনেক মহিলারই সুবিধে হয় এতে। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে বিভাজন যেন বেড়ে না যায়।’’ তাঁর চিন্তা, যে মহিলা এবং পুরুষেরা এই সুবিধার আওতায় পড়েন না, তাঁদের এই ব্যবস্থা ভাল না লাগলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তবে তিনি এটা মানেন যে, ঋতুস্রাব সংক্রান্ত ছুতমার্গ কিছুটা হলেও কাটতে পারে এতে।
এই ভাবনাকেই আরও এগিয়ে নিয়ে গেলেন সোনারপুরের একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা অলকানন্দা ঘোষ। তাঁর বক্তব্য, ‘পিরিয়ড লিভ’ দেওয়া মানে নারীত্বকে সম্মান জানানো। তবে এ কথাও ভুলে যাওয়ার নয় যে, মেয়েরা এই ছুটি ছাড়াও অনেক কাজ সামলে ফেলতে পারেন। ঘরে-বাইরে সব কাজ দক্ষতার সঙ্গে করেন। তিনি বলেন, ‘‘ছুতমার্গ কাটানোর জন্য সামাজিক মেলামেশার ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তনও খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেই কাজগুলোও করতে হবে।’’ যেমন তাঁরই স্কুলে ভেন্ডিং মেশিন থেকে স্যানিটারি ন্যাপকিন নিলে টাকা জমা রাখতে হয় এক পুরুষ কর্মীর হাতে। ওই ব্যক্তি প্রথমে অস্বস্তির কথা জানিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে বোঝানো হয়েছে, তিনি বিষয়টি নিয়ে সহজ হলে স্কুলের ছাত্রীরাও সহজ হতে শিখবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy