সকাল থেকেই শরীর ভাল ছিল না সম্পূর্ণার। কিন্তু জরুরি মিটিং রয়েছে। তাই বাধ্য হয়েছিল অফিসে আসতে। পুরুষ বসকে সমস্যা বোঝানোর অস্বস্তি চাপতে গিয়ে প্রায় সংজ্ঞাহীন অবস্থা হয় মেয়েটির। জানাজানি হয়ে যায় এন্ডোমেট্রিওসিসের শিকার সম্পূর্ণা। যদিও এতে বিশেষ লাভ হয়নি। সফল মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ রনিতাকেও দীর্ঘদিন এই একই সমস্যায় নাজেহাল হতে হয়েছে। অবশেষে চাকরি ছেড়ে দিয়ে মিলেছে নিস্তার।
হিসেব বলছে, ভারতে বেড়েই চলেছে এন্ডোমেট্রিওসিস-অ্যাডিনোমায়োসিসে আক্রান্তের সংখ্যা। স্ত্রীরোগ চিকিৎসকদের একাংশের দাবি, তাঁদের কাছে আসা প্রতি দশ জন রোগীর তিন জনই এর শিকার। ক্রমেই বাড়ছে ফাইব্রয়েড ইউটেরাসের সংখ্যাও। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, অনেকের ক্ষেত্রে পিরিয়ডের প্রথম দিনে সামান্য নড়াচড়াও ঝুঁকির হতে পারে।
চাকুরিরতাদের পরিস্থিতি আরও কঠিন। যেমন বেহালার রনিতা সেনের আক্ষেপ, ‘‘প্রতি মাসে নির্দিষ্ট সময়ে ছুটি চাইলে বিদ্রুপ শুনতে হতো।’’ এ বার সেই ছবিটা বদলের আশা জোগাচ্ছে সাম্প্রতিক একটি ঘোষণা। মুম্বইয়ের দু’টি সংস্থা প্রতি মাসে ঋতুমতী হওয়ার প্রথম দিনে মহিলা কর্মীদের জন্য সবেতন ছুটি ঘোষণা করেছে। সেই দু’টির একটি সংস্থা আবার নিজেদের কর্মীদের পাশাপাশি ভাবছে বৃহত্তর সমাজের কথাও। তাই এই সমস্যা তুলে ধরতে তারা একটি ভিডিও ছেড়েছে ফেসবুকে। যা ইতিমধ্যেই ভাইরাল হয়েছে। এ দেশের মহিলাদের জন্য চেঞ্জ ডট ওআরজি-র মাধ্যমে অনলাইন পিটিশন করছে তারা। পরবর্তী লক্ষ্য নারী ও শিশু কল্যাণমন্ত্রী মানেকা গাঁধীর দরবারে তাদের সেই আবেদন পৌঁছে দেওয়া।
ওই সংস্থার মানবসম্পদ দফতরের পক্ষে দেবলীনা এস মজুমদার বলেন, ‘‘ওই বিশেষ সময়ে সব মেয়ের সমস্যা হয় না। যাঁদের হয়, তাঁরা পিরিয়ডের প্রথম দিনে ছুটি (এফওপি) নেবেন। এর জন্য চিকিৎসার কোনও কাগজও পেশ করতে হবে না।’’ কিন্তু এই সংস্থার সিদ্ধান্ত লিঙ্গ বৈষম্যের প্রশ্ন তুলবে না তো?
দেবলীনার সোজাসাপ্টা জবাব, ‘‘সংস্থার পুরুষেরা বরং এটি সমর্থন করছেন। যদিও বাইরে থেকে এমন প্রশ্ন আসছে। কিন্তু বায়োলজিক্যাল পার্থক্যটা কি নস্যাৎ করতে পারি? মেয়েরাই তো সন্তান ধারণ করেন। মাতৃত্বকালীন ছুটি প্রয়োজন তাঁদেরই। এটিও তেমনই।’’
এ সময়ের যন্ত্রণার কথা মানছেন স্ত্রীরোগ চিকিৎসক অভিনিবেশ চট্টোপাধ্যায়। তাঁর মতে, ‘‘ক্যানসার সমতুল যন্ত্রণা হয় এন্ডোমেট্রিওসিসে। এ ক্ষেত্রে ঋতুস্রাব নিয়ম মেনে শরীরের বাইরে না এসে কিছুটা ফ্যালোপিয়ান টিউবের মাধ্যমে ডিম্বাশয়ে জমে সিস্ট তৈরি করে। এর সঙ্গে জরায়ু যখন বড় হয়ে যায়, তখন তাকে অ্যাডিনোমায়োসিস বলে। জরায়ুর ভিতরে ছোট ফাইব্রয়েড থাকলেও যন্ত্রণা এবং অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের সমস্যা হয়।’’
এমন ছুটি পেয়ে কর্মক্ষেত্রে আবার পিছিয়ে পড়বেন না তো মহিলারা? হিসেব বলছে, আরও বহু দেশেও আছে এই ছুটি। ভারতের স্বাধীনতার বছর থেকেই জাপান তাদের চাকুরিরতাদের জন্য বরাদ্দ করে চলেছে এই ছুটি। পরে ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া-সহ দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশেও আইনসিদ্ধ হয় এই ছুটি। ঋতুকালীন ছুটি আইনসম্মত ইতালিতেও।
যদিও কলকাতার এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার ডিরেক্টর অনুরাধা কপূরের মতে, ‘‘আইন তৈরি করার আগেও প্রয়োজন সর্বস্তরে সচেতনতা তৈরি করা। যে দেশে এত মহিলা কর্মরতা, সেখানে কেন প্রয়োজনে নিজের শারীরিক সমস্যার কথা বলা যাবে না? আগে সেই ট্যাবু ভাঙতে হবে সকলকে। না হলে আইন করেও কোনও লাভ নেই।’’
‘ট্যাবু’ বিতর্ক অবশ্য উঠে এসেছে বারবার। স্যানিটারি ন্যাপকিনে কেন ১২% জিএসটি বসানো হয়েছে, সম্প্রতি তা নিয়েও দেশজুড়ে মহিলা মহলে উঠেছে প্রতিবাদের ঝড়। প্রশাসনের যুক্তি, আগের চেয়ে এক শতাংশের একটু বেশি কমেছে ন্যাপকিনের দাম। কিন্তু নিরোধে যদি কর না থাকে, তবে কি স্যানিটারি প্যাড তার আগে করহীন হওয়া উচিত নয়? এই প্রশ্নে সরব হয়েছেন অনেকেই।
ভারতীয় মহিলাদের সামাজিক অবস্থান নিয়েই প্রশ্ন তুললেন সদ্য মেয়াদ পেরোনো রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায়। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আইন তৈরির চেষ্টা তো করাই উচিত। কিন্তু আইন থাকলেই যদি সবটা হতো, তা হলে তো অনেক কিছুই সহজ হয়ে যেত। যে দেশে ট্রামে-বাসে মহিলাদের নাগালের মধ্যে হাতল থাকে না, সে দেশে এত বড় পদক্ষেপ কি করা যাবে?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy