Advertisement
E-Paper

লজ্জা নয়, সচেতনতা জরুরি

ঋতুস্রাবের সময়ে নানা সমস্যা হতে পারে। লজ্জা কাটিয়ে একটু সচেতন হলে এগুলো এড়িয়ে চলা যায়। জানাচ্ছেন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ রবীন্দ্রনাথ মণ্ডল এই লক্ষণ দেখা দিলে আচমকাই শারীরিক পরিবর্তন হলেও মানসিক পরিবর্তন না হওয়ায় আক্রান্ত শিশুটি নানা সামাজিক সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। টিউমারের কারণে এ রকম হতে পারে।

শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০১৮ ০২:০৪
প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

প্রশ্ন: মহিলাদের ক্ষেত্রে ঋতুস্রাব শুরুর উপযুক্ত বয়স কত?
উত্তর: সাধারণত পারিপার্শ্বিক সামাজিক পরিস্থিতি ও ভৌগোলিক অবস্থানের উপরে ঋতুস্রাব শুরুর সময় নির্ধারিত হয়। তবে জীবনযাত্রার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ঋতুস্রাব শুরুর সময়ও ক্রমেই এগিয়ে আসছে। আগে যা ১০ থেকে ১৬ বছর বয়সে শুরু হতো, এখন তাই শুরু হচ্ছে ৭-৮ বছর বয়স থেকেই। তবে ব্যতিক্রম রয়েছে একটি ক্ষেত্রে। পাঁচ বছর বয়সে কোনও শিশুর ঋতুস্রাব শুরু হলে তাকে ‘প্রিকসিয়াস পিউবার্টি’ বা অকাল যৌবন বলা হয়। এই লক্ষণ দেখা দিলে আচমকাই শারীরিক পরিবর্তন হলেও মানসিক পরিবর্তন না হওয়ায় আক্রান্ত শিশুটি নানা সামাজিক সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। টিউমারের কারণে এ রকম হতে পারে। তবে এর চিকিৎসা সম্ভব।

প্রশ্ন: নিয়মিত ঋতুস্রাব বলতে কী বোঝায়?
উত্তর: প্রতি ২৮ দিন অন্তর (সাত দিন আগে বা পরে) অর্থাৎ ২১ দিন থেকে ৩৫ দিনের মধ্যে রক্তপাত হলে তা স্বাভাবিক বলেই ধরা হয়। এর কম বা বেশি হলে তা অস্বাভাবিক। দুই মাসের সম্ভাব্য তারিখের মধ্যে এক ফোঁটা রক্তপাত হলেও তা অস্বাভাবিক। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

প্রশ্ন: ঋতুস্রাবের ক্ষেত্রে কী কী অনিয়মিয়তা দেখা দিতে পারে?
উত্তর: দু’ধরনের সমস্যা হতে পারে— ১) অত্যধিক মাত্রায় রক্তক্ষরণ হলে তাকে বলে ‘পিউবার্টি মেনোরোজিয়া’। সাধারণত ১৫ থেকে ২০ দিন ধরে রক্তপাত বন্ধ না হলে এই রোগ হয়েছে মনে করা হয়। এ ক্ষেত্রে প্রোজেস্টেরন হরমোনজাত ওষুধ, ট্রানেক্সেমিক অ্যাসিড দিতে হয় রোগীকে। প্রয়োজনে রক্ত দিতে হতেও পারে। এ রকম সমস্যা দেখা দিলে ব্লিডিং টাইম ও ক্লটিং টাইম দেখে থাইরয়েড পরীক্ষা করার পরামর্শ দেওয়া হয়। ২) সাধারণত প্রতি মাসে ২০-৮০ মিলিলিটার রক্তপাত হলে তা স্বাভাবিক ধরা হয়। ৫০ মিলিলিটারের থেকে কম রক্তপাত হলে তার ‘পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম’ হয়েছে ধরা হয়। আধুনিক শহুরে জীবনযাত্রায় মহিলাদের এটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন ও হাই ক্যালোরি ডায়েট নিলে ওজন বেড়ে যায়। এর থেকে এই সমস্যা হতে পারে। বয়সের সঙ্গে ওজন ও উচ্চতায় সামঞ্জস্য রাখতে হবে। অর্থাৎ বিএমআই (বডি মাস ইনডেক্স) নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। সেন্টিমিটারে উচ্চতা মেপে তা থেকে ১০০ বাদ দিতে হবে। অর্থাৎ ৫ ফুট উচ্চতার কোনও মেয়ের ওজন থাকতে হবে ৫০ কেজির মধ্যে। তা হলে ঋতুস্রাব নিয়মিত হবে।

প্রশ্ন: অনেকের কালো বা গাঢ় খয়েরি রঙের রক্তপাত হয়। জমাট বাঁধা রক্তও বেরোয়। সমাধান কী?
উত্তর: ‘পিউবার্টি মেনোরোজিয়া’ অর্থাৎ বেশি রক্তপাত হলে অনেক সময়ে রক্ত তরল অবস্থায় না বেরিয়ে জমাট বেঁধে বেরোয়। অধিক মাত্রায় রক্তক্ষরণের জন্য এমন হতে পারে। তবে রক্তের রঙ কালো বা গাঢ় খয়েরি হলে বোঝা যায়, তলপেটে কোনও সমস্যার জন্যই তা হচ্ছে। এগুলিকে ‘পেলভিক ইনফ্ল্যামেটরি ডিজিজ’ বলা হয়। যোনিদ্বার ও ফ্যালোপিয়ান টিউবে সংক্রমণ হলেও এমন হয়। সাধারণত পুকুর বা ডোবার নোংরা জলে স্নান করলে বা অন্তর্বাস ওই নোংরা জলে কাচলে তা থেকে সংক্রমণ ছড়াতে পারে। এমনকী প্রস্রাবেও সমস্যা হতে পারে। পুরুষদের মূত্রনালী যেখানে ২৮ সেন্টিমিটার লম্বা, মহিলাদের ক্ষেত্রে তা মাত্র চার সেন্টিমিটার। পরিষ্কার জলে স্নান, কাপড় কাচলে এ সব সংক্রমণ এড়ানো সম্ভব হয়।

প্রশ্ন: এ সময়ে অনেকের তলপেটে অসহ্য যন্ত্রণা করে। এমনকী পা, হাঁটু অবশ হয়ে গিয়ে চলতে ফিরতে অসুবিধা হয়। এমন কেন হয়?
উত্তর: ঋতুস্রাবের সময়ে যন্ত্রণাকে ‘ডিসমেনোরিয়া’ বলে। দু’ধরনের ডিসমেনোরিয়া হতে পারে। ঋতুস্রাবের প্রথম দিনে তলপেটে বেশি ব্যথা করলে তাকে ‘প্রাইমারি ডিসমেনোরিয়া’ বলে হয়। অবিবাহিতদের মধ্যেই এটা বেশি হয়। রক্তপাতের প্রতি ভীতি থেকেই এই সমস্যা হতে পারে। অনেকের পরিবারে মা, বোন বা পিসির এ রকম ব্যথা হতে দেখলে মেয়েটির মনেও ভয় ধরে যায় যে তারও ব্যথা হতে পারে। অন্য দিকে, তলপেটে সংক্রমণ (এন্ডোমেট্রিয়োসিস) হলে তাকে ‘সেকেন্ডারি ডিসমেনোরিয়া’ বলে। এ ক্ষেত্রে ঋতুস্রাব শুরুর ২-৩ দিন আগে থেকে তলপেটে, পায়ে যন্ত্রণা শুরু হয়। রক্তপাত কমতে থাকলে তিন দিনের পরে ব্যথা কমে যায়।

প্রশ্ন: ব্যথা উপশমের উপায় কী?
উত্তর: প্রথমত মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। ব্যথা ভাবলেই যে ব্যথা আরও বাড়ে। খুব বেশি ব্যথা হলে গরম জলে গামছা বা রুমাল ডুবিয়ে তা দিয়ে সেঁক নিতে হবে। ‘প্রাইমারি ডিসমেনোরিয়া’র ক্ষেত্রে ‘অ্যান্টি স্পাসমোডিক’ ওষুধ দিতে হয়। তবে ব্যথা কমানোর জন্য বাজারচলতি পেনকিলার না খাওয়াই ভাল। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে আল্টাসোনোগ্রাফি করে দেখা দরকার তলপেটে অন্য কোনও সমস্যা আছে কি না।

প্রশ্ন: ঋতুস্রাবের সময় কী ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা উচিত?
উত্তর: পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সুতির অন্তর্বাস পরতে হবে। প্রতি দিন সেগুলি পরিষ্কার সাবান-জলে ধুতে হবে। প্রয়োজনে ধোয়ার পরে জীবাণুরোধক লাগানো যেতে পারে। কাপড় ব্যবহার করলেও তা নিয়মিত কেচে চড়া রোদে শুকিয়ে ফের ব্যবহার করতে হবে। তবে ন্যাপকিন ব্যবহারই বেশি স্বাস্থ্যসম্মত। এতে সংক্রমণের আশঙ্কা কম থাকে।

প্রশ্ন: কাপড় ব্যবহারে সমস্যা কী?
উত্তর: কাপড় পরিষ্কার না থাকলে যোনিতে সংক্রমণ হতে পারে। ফুলে গিয়ে চাকা চাকা দাগ, এমনকী ঘা হয়ে দুর্গন্ধও ছড়াতে পারে। ঋতুস্রাবের সময়ে রোজ পরিষ্কার জলে স্নান করতে হবে। অনেকে দুর্গন্ধ রোধের জন্য বাজারচলতি পাউডার বা সুগন্ধি ব্যবহার করেন। গোপনাঙ্গে কখনই এ ধরনের প্রসাধনী ব্যবহার করা উচিত নয়।

প্রশ্ন: বাজারচলতি নাইলনের ন্যাপকিন পরিবেশবান্ধব নয়। তাই এখন সুতির ন্যাপকিনের চল বাড়ছে। এগুলি কি ব্যবহার করা যেতে পারে?
উত্তর: হ্যাঁ রোজ কেচে শুকিয়ে নিলেই তা ব্যবহার করা যেতে পারে। শুকিয়ে যাওয়া রক্ত লেগে থাকলে তা থেকে সংক্রমণ হতে পারে।

প্রশ্ন: মেনস্ট্রুয়াল ক্যাপ কী? এগুলির ব্যবহার কি স্বাস্থ্যসম্মত?
উত্তর: এর ব্যবহার এই রাজ্যে এখনও সে ভাবে শুরু হয়নি। সাধারণত ২৪ থেকে ২৮ মিলিলিটার রক্ত ধরে এতে। সিলিকন অথবা রবার দিয়ে তৈরি এই ক্যাপের সুবিধা হল টানা ১০ বছর এগুলি ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রতি দিনের ঋতুস্রাবের শেষে গরম জলে কাপ ধুয়ে ফেলতে হবে। রাতে ঘুমের সময় এই কাপ ব্যবহার করা যেতে পারে। চার থেকে আট ঘণ্টা এক টানা ক্যাপ পরে থাকা যায়। বেশি রক্তপাত হলে তখন ন্যাপকিন নিতেই হবে।

প্রশ্ন: অনিয়মিত ঋতুস্রাব কি সন্তানধারণের ক্ষেত্রে কোনও রকম প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে?
উত্তর: না, একেবারেই না। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন। স্থূলত্ব দেখা দিলে রক্তপাত কম হয়। বেশি স্থূল হলে সন্তানধারণে সমস্যা হতে পারে।

প্রশ্ন: মেনোপজের সময় কখন? লক্ষণই বা কী?
উত্তর: ৪০ বছরের পর থেকেই মহিলাদের ঋতুস্রাব অনিয়মিত হতে শুরু করে। আমাদের দেশে মেনোপজের সময় ধরা হয় ৫২ বছর বয়সকে। এ সময়ে চামড়া শুকিয়ে যায়, চোখ-মুখে আচমকাই গরম অনুভব হয়, কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বেরনোর অনুভবও হয়। খিটখিটে ভাব বাড়ে। সহবাসেও অনিচ্ছা তৈরি হয়।

প্রশ্ন: গর্ভনিরোধক ওষুধ খেলে ঋতুস্রাবে কি তার কোনও প্রভাব পড়ে?
উত্তর: যখন-তখন গর্ভনিরোধক ওষুধ খেলে ঋতুস্রাব অনিয়মিত হয়। সহবাসের পরে নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গর্ভনিরোধক খেলে জরায়ুর বাইরে ভ্রুণ তৈরি হতে পারে। একে ‘এক্টোপিক প্রেগনেন্সি’ বলে। এতে জীবনহানিও ঘটতে পারে।

প্রশ্ন: মেনোপজের পরে রক্তপাত কি ক্ষতিকর?
উত্তর: এ সময়ে এক ফোঁটা রক্ত বেরোলেও তা ক্ষতিকর। ইস্ট্রোজেন কম বেরোনোয় এ সময়ে প্রস্রাব নিয়ন্ত্রণে থাকে না। হৃদরোগের আশঙ্কাও থাকে। মেনোপজের পরে ‘প্যাপ স্মিয়ার’ পরীক্ষা ও বায়োপসি করলে ক্যানসার আছে কি না তা জানা যায়।

সাক্ষাৎকার: সুচন্দ্রা দে

Menstruation ঋতুস্রাব
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy