Advertisement
E-Paper

ঋতুস্রাব অপবিত্র, আজও লজ্জায় পড়ছে ভারতীয় মেয়েরা, কী বলছে সমীক্ষা

সরকারি সমীক্ষাই বলছে, ভারতের ৭০ শতাংশ মায়েরা নিজের মেয়েকে ঋতুস্রাব সংক্রান্ত বিষয়ে নীরব থাকতে বা প্রশ্ন না করতেই শিখিয়ে থাকেন।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০১৭ ১২:৩৯
দেশের মাত্র ৫৫ শতাংশ মেয়ে মনে করে পিরিয়ড স্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়া।

দেশের মাত্র ৫৫ শতাংশ মেয়ে মনে করে পিরিয়ড স্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়া।

ভারতের অধিকাংশ মেয়েদের কাছে মেনস্ট্রুয়েশন আজও লজ্জার ঘটনা। অত্যন্ত স্বাভাবিক এই শারীরিক প্রক্রিয়া নাকি অপবিত্র, অসম্মানজনক তা শিখিয়েই বড় করে তোলা হয় আমাদের দেশের মেয়েদের। সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বাধা পেরিয়ে ভারতের যত সংখ্যক মেয়ে ঋতুস্রাবের সময় যথাযথ সুরক্ষা নিতে পারে তার সংখ্যা সত্যিই ভয়াবহ। সরকারি সমীক্ষাই বলছে, ভারতের ৭০ শতাংশ মায়েরা নিজের মেয়েকে ঋতুস্রাব সংক্রান্ত বিষয়ে নীরব থাকতে বা প্রশ্ন না করতেই শিখিয়ে থাকেন। ৪৫ শতাংশ মেয়ের কাছে ঋতুস্রাব আজও অস্বাভাবিক। ফলে ভারতের গ্রাম ও শহরাঞ্চলে ঋতুকালীন সুরক্ষার বিষয় আজও সম্পূর্ণ অবেহলিতই বলা চলে। যা সংক্রমণ, নারী-শিশু স্বাস্থ্যের অবনতি নিয়ে গিয়েছে ভয়াবহ পর্যায়।

ঋতুস্রাব অস্বাভাবিক

ভারতীয় পরিবারে মেয়েদের আজও শেখানো হয় পিরিয়ড লজ্জার, অপবিত্র। মেয়ে রজঃস্বলা হলেই যেখানে তাকে কোথাও বন্ধ করে রাখা হচ্ছে গোয়ালঘরে, কোথাও বা নিরামিষ খাবারেই তাকে এই কয়েকটা দিন গুজরান করতে হচ্ছে। হুগলির সরসা গ্রামের বাসিন্দা শিপ্রা পাল(নাম অপরিবর্তিত) বলেন, ‘‘ছোট থেকেই তো শুনে এসেছি এই সময় ঠাকুর ঘরে ঢোকা পাপ।এই সময় বাবা, দাদাদের ধারে কাছে যেতে মানা করতেন মা। যে ন্যাকড়া ব্যবহার করতাম সেগুলোও যাতে বাবা, দাদা না দেখতে পায় সে ভাবে শুকিয়ে নিতে হয়। শুনেছি এ ভাবে রোদে না শুকিয়ে ব্যবহার করলে নাকি পরে ওগুলো থেকে শরীর খারাপ হয়। শ্বশুরবাড়িতে তো এই সময় রান্নাঘরেও ঢোকা বারণ। ভাসুর, দেওর চা করে আনতে বললেও রান্নাঘরে যেতে পারি না। সত্যি বলতে কি ওদের সামনে ধরা পড়ে গিয়ে খুব লজ্জা করে।’’ এই চিত্র শুধু গ্রাম নয়। শহরাঞ্চলের শিক্ষিত মেয়েরাও মুখ বুজে মেনে চলেন এই বিধান। সুরক্ষার সুবিধা থাকার কারণে তারা হয়তো বাড়ি থেকে বেরোচ্ছে ঠিকই, কিন্তু মাছ, ডিম না ছোঁয়া, রান্নাঘর-ঠাকুর ঘরে না ঢোকা, ঝাল-টক থেকে দূরে থাকার বিধান মেনে চলেছে নীরবেই। অসাবধানতাবশত পোশাকে রক্তের দাগ লেগে গেলে লজ্জার সীমা নেই। দোকান থেকে স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনতে হলেও তা খবরের কাগজে মুড়ে ভরে দেওয়া হবে কালো প্যাকেটে। পুরো ব্যাপারটাই যেখানে লজ্জার, অপবিত্র সেখানে সুরক্ষা সম্পর্কে সচতনতা গড়ে তোলাও হয়ে দাঁড়ায় ততটাই কঠিন। সমাজকর্মী সোমা গুহ বলেন, ‘‘কুসংস্কার এতটাই গভীরে যে তা কাটিয়ে তোলা এক দিনে সম্ভব না। গ্রামাঞ্চলে স্বাস্থ্যকর্মীরাও মাসিকের রক্তকে ‘বদরক্ত’ বলে থাকেন। কিশোরী মেয়েদের মায়েদের বোঝানো সম্ভব হলে বাড়িতে অনেক সময়ই আরও বয়ঃজেষ্ঠ্য ঠাকুমা, দিদিমাদের কাছে তারাও অনেক মেনে নিতে বাধ্য হন। এই সময় যে মাছ খেলে মাসিকের রক্তের গন্ধ আরও আঁশটে হয়ে যায় না, পুষ্টিকর খাবার খাওয়া উচিত তা তিনিই বা শাশুড়ি, মা স্থানীয়দের কী ভাবে বোঝাবেন? শুধু গ্রামে না। কলকাতাতেই এমন অঞ্চল রয়েছে যেখানে মেয়েরা মনে করে পিরিয়ডের সময়ে রক্তভেজা ন্যাকড়া পুকুরের জলে ধোওয়া উচিত।’’

স্যানিটারি প্যাড যখন সামর্থের বাইরে

২০১৫-১৬ সালে প্রকাশিত চতুর্থ জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার (এনএফএইচএস-৪) তথ্য বলছে, ভারতের ৮৯ শতাংশ মেয়েই কাপড় ব্যবহার করে, ২ শতাংশ ব্যবহার করে তুলো, ৭ শতাংশ মেয়ের উন্নত মানের স্যানিটারি ন্যাপকিন কেনার সামর্থ রয়েছে, এমনকী ২ শতাংশ ছাই দিয়েই কোনও মতে রক্তক্ষরণ সামলানোর কাজ করতে বাধ্য হন। যারা কাপড় ব্যবহার করেন তার মধ্যে আবার মাত্র ৬০ শতাংশ দিনে তা একবারের বেশি বদলানোর সুযোগ পান না। কুসংস্কারের থেকেও বেশি অর্থনীতিকেই এর প্রাধন কারণ মনে করছেন রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখার্জি। তিনি বলেন, ‘‘প্রত্যন্ত গ্রামের কোনও কোনও মেয়ে এই সময় সারা দিন নারকেল পাতার খোলের মধ্যে বসে থাকে, বা মাটির গোলা তৈরি করে ভিতরে ঢুকিয়ে রাখে। যাতে রক্তটা শুষে নিতে পারে। কিছুক্ষণ পর পর পুকুরে নেমে ধুয়ে আসে। ন্যাকড়া ব্যবহার করলেও তা পরিষ্কার করে কেচে জীবাণুমুক্ত করার জন্য যে সাবান, ডেটল প্রয়োজন তা কেনার সামর্থ্য কোথায় তার? এরপর রোদে শুকোতে হবে। সেটাও তো একটা লজ্জার ব্যাপার! পুরুষ দেখে ফেলবে। কোনও মতে গোয়াল ঘরের কোনায়, ঘুপচিতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশেই কাপড় শোকাতে হবে। ফলে সংক্রমণের মাত্রা কোন পর্যায়ে যেতে পারে তা কল্পনাও করা যায় না।’’

সমীক্ষা বলছে, ঋতুস্রাব নিয়ে লজ্জার কারণে গ্রামীণ ভারতের ২৩ শতাংশ মেয়ে আজও বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছনো মাত্রই স্কুল ছাড়তে বাধ্য হয়। ভারতের মেয়েদের যৌন ও মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা সংস্থা রুটগারসের সমীক্ষা বলছে, এই মেয়েদের ২৮ শতাংশই পিরিয়ডের সময় যথাযথ সুরক্ষার অভাবে স্কুলে যেতে অসুবিধার কারণে মাঝপথে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। এ রাজ্যে এখন মেয়েরা বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছনোর পর পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে বাধ্য না হলেও পশ্চিমবঙ্গের গ্রামগুলোতে ৫০ শতাংশেরও কম মেয়ে যথাযথ সুরক্ষা নেওয়ার সুযোগ পায়। সোমা জানালেন, এই পাঁচ দিন গ্রামে মেয়েরা স্কুলে যায় না। এর পিছনে কুসংস্কার যেমন রয়েছে তেমনই সুরক্ষার অভাব, অসুবিধাও বড় কারণ। বাড়ি থেকে এই সময় স্কুলে যেতে বারণ করা হয়। তার উপর রয়েছে সুরক্ষার অসুবিধা। কোথায় বদলাবে ন্যাকড়া, শৌচাগারে ব্যবহৃত ন্যাকড়া ফেলার অসুবিধা, ধোওয়ার অসুবিধা। সচেতনতা গড়ে তোলার জন্য গ্রামের স্কুলগুলোর কাছে লাফস্টাইল, হেলথ সচেতনতার ক্লাস চালু করার প্রস্তবা রাখা হয়েছিল। স্কুলের শিক্ষিকারা রাজি হলেও অধিকাংস ক্ষেত্রেই তা মানসিক ট্যাবুর কারণে অভিভাবকরাই বাধা দিয়েছেন।

অটোম্যাটিক ভেন্ডিং মেশিন

এখানেও রয়েছে সমস্যা। সোমা বলেন, ‘‘অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্কুলগুলোর থেকে সহযোগিতা পায় যাচ্ছে না। স্যানিটারি ন্যাপকিন শেষ হয়ে গেলে সঠিক সময় স্বেচ্ছাসেবী বা সরকারি সংস্থাগুলোকে জানানো হচ্ছে না। ফলে মেশিন থাকলেও জরুরি সময় তা ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে না ছাত্রীরা।’’

আরও পড়ুন: এই ৫ কারণেই প্রেগন্যান্সিতে বেশি খিদে পায়

অন্য দিকে এখানেও সেই অর্থনীতিকেই প্রধান কারণ মনে করছেন সুনন্দা মুখার্জি। তিনি বলেন, ‘‘ভেন্ডিং মেশিন বসাতেও যে সচেতনতা লাগে রাজ্যের শহরগুলোতেই এখনও তা গ়ড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। গ্রামাঞ্চলে তো দূরের কথা। কিন্তু ভেন্ডিং মেশিন বসালেই কি সমস্যার সমাধান হবে? এই সব মেশিন থেকে ১০ টাকার বিনিময় তিনটি করে স্যানিটারি ন্যাপকিন পাওয়া যায়। একজন কিশোরী মেয়ের এক দিনেই তার বেশি ন্যাপকিনের প্রয়োজন। ফলে টানা ৫ দিনে অন্তত ৫০-৬০ টাকা খরচ করার মতো সামর্থ্য থাকলে তবেই সে স্যানিটারি ন্যাপকিন নিতে পারবে। দারিদ্রসীমার নীচে থাকা মেয়েদের কাছে এই টাকা থাকলে তা দিয়ে সে চাল, আনাজ কিনবে। এ ভাবে খরচ করার কথা ভাবতেও পারবে না। বাড়ির মেয়ের স্বাস্থ্যের পিছনে এই অযথা খরচ করতে কোনও পরিবারও রাজি হবে না।’’

Menstruation Hygiene India
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy