Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Shibnath Dey Sarkar

রেকর্ড গড়ে এশিয়াডে সোনা জেতাও যথেষ্ট নয়, অর্জুন থেকে বঞ্চিতই থাকলেন দুই বাঙালি ‘তাসুড়ে’ 

ব্রিজের ভবিষ্যৎ না-হয় উজ্জ্বল, প্রণব বর্ধন ও শিবনাথ দে সরকারের বর্তমান কি এমনই অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকবে? মিলবে না প্রাপ্য স্বীকৃতি?

প্রণব বর্ধন ও শিবনাথ দে সরকার। এশিয়ান গেমসে ব্রিজে সোনা জেতার পর। —ফাইল চিত্র।

প্রণব বর্ধন ও শিবনাথ দে সরকার। এশিয়ান গেমসে ব্রিজে সোনা জেতার পর। —ফাইল চিত্র।

সৌরাংশু দেবনাথ
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০২০ ০৯:৩৫
Share: Save:

এশিয়ান গেমসে সোনাও অর্জুনের জন্য যথেষ্ট নয়!

অন্তত প্রণব বর্ধন ও শিবনাথ দে সরকারের তেমনই মনে হচ্ছে। আর তা মনে হওয়ারই কথা। ক্যাটকেটে রুক্ষ বাস্তব তো এটাই।

ব্রিজে বছর দু’য়েক আগে এশিয়ান গেমসে সোনা জিতেছিলেন জুটিতে। যা ছিল প্রতিযোগিতায় ভারতের ১৫ তম সোনা। ৫১ বছর পর এই প্রতিযোগিতায় এসেছিল ১৫ সোনা। স্বাভাবিক ভাবেই বাড়তি তাৎপর্য ছিল সেই সোনার। অন্য গুরুত্বও ছিল। এশিয়াডের সোনা আঘাত হেনেছিল তাস সম্পর্কে প্রচলিত সর্বনাশা ‌ধারণার গোড়ায়। কিন্তু, মনের মধ্যে গেঁথে থাকা সংস্কার উপড়ে ফেলার চেষ্টা করলেও সরকারি স্বীকৃতির সিলমোহর তাতে পড়ল না। বরং, বঞ্চনা, উপেক্ষা, অবিচারের মতো শব্দগুলোই শনিবাসরীয় ক্রীড়াদিবসে যন্ত্রণার হুল হয়ে ফুটল!

ফলে, অভিমান জন্ম নিচ্ছেই। দক্ষিণ কলকাতার সন্তোষপুর নিবাসী প্রণব বর্ধন আনন্দবাজার ডিজিটালকে বললেন, “আমরা খেলোয়াড়। খেলাটা আমাদের ধর্ম। আমি আমার কাজটা করেছি। এশিয়ান গেমসে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছি, স্বর্ণ পদক জিতেছি, আমার দেশের পতাকা সবার উপরে তুলেছি, দেশকে গর্বিত করেছি, নিজে গর্ববোধ করেছি। এটা আমার দিক। এ বার আমাকে কতটা সম্মান দেবেন, কী ভাবে দেবেন, সেটা আমার দেখার কথা নয়। সেটা আমি দেখব কেন? আমার দিক থেকে যা যা করার ছিল, আমি করেছি। আর আমার জানাও নেই যে অর্জুনের জন্য কোনও তদ্বির করতে হয় কি না। সত্যি বলতে, আমরা এটা নিয়ে ভাবিইনি। আমাদের যা যা রেজাল্ট তা জানতে চাওয়ার পর পাঠিয়ে দিয়েছি। তার পর সিদ্ধান্ত ওখানে থাকা বিচারকরা নিয়েছেন। তাঁদের বিচারে আমরা এ বছর অর্জুন পাচ্ছি না। এটা নিয়ে আমার কিছু বলা শোভা পায় না। ওখানে থাকা বিচারকরা নিশ্চয়ই অনেক অভিজ্ঞ। আর অর্জুন প্রতি বছর দেওয়া হয়। ফলে, ওঁরা অবশ্যই জানেন এটা কাদের প্রাপ্য।”

আরও পড়ুন: দেশের হয়ে অলিম্পিক পদক জিততে চাই, এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারে বললেন সানিয়া মির্জা

অথচ, মাপকাঠির বিচারে পিছিয়ে ছিলেন না দুই বর্ষীয়ান বাঙালি। ক্রীড়াবিদদের অর্জুন পুরস্কারের জন্য যে শর্তাবলী আছে, তাতে বিভিন্ন প্রতিযোগিতার জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া রয়েছে নম্বর। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ ও এশিয়ান গেমসে সোনার জন্য বরাদ্দ যথাক্রমে ৪০ ও ৩০ নম্বর। এই দুই প্রতিযোগিতায় রুপো ও ব্রোঞ্জের জন্যও রয়েছে নম্বর। আবার, দু’বছর বাদে-বাদে হওয়া এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ ও কমনওয়েলথ চ্যাম্পিয়নশিপের জন্যও রয়েছে আলাদা নম্বর। প্রণব-শিবনাথ জুটি এশিয়ান গেমসে সোনা ছাড়াও ২০১৬ সালে সিওলে এশিয়া প্যাসিফিক ব্রিজে জিতেছিলেন সোনা। ২০১৭ সালে গোয়ায় এশিয়া কাপে এসেছিল ব্রোঞ্জ।

পয়েন্ট সিস্টেম নিয়ে ধোঁয়াশা কাটছে না তাই। হাওড়া শালকিয়ার বাসিন্দা শিবনাথ দে সরকার বললেন, “অর্জুনের জন্য পয়েন্টের যে মাপকাঠি, তাতে কিন্তু আমাদের স্থান উপরের দিকেই থাকা উচিত। এশিয়া কাপে ব্রোঞ্জ জিতেছি, এশিয়া প্যাসিফিকে সোনা জিতেছি। এশিয়ান গেমসেও সোনা আছে। এগুলোর জন্য কত কত পয়েন্ট, তা সব আমাদের পাঠানো চিঠিতে রয়েছে। সেগুলো দেখে খারাপ লাগছে। আমরা হতাশ। মানসিক কষ্টে রয়েছি। এখানে একটা দিক মাথায় রাখতে হবে। দু’বছর আগের এশিয়ান গেমসে ভারতের হয়ে শেষ সোনা জিতেছিলাম আমরা। সেই সোনার জন্য আমাদের র‌্যাঙ্কিং ১২ থেকে উঠে আসে আটে। ৫১ বছর পর ভারত এশিয়াডে ১৫টা সোনা পেয়েছিল। আর সেটা এনেছিলাম আমরা। এটা বিশাল ব্যাপার।”

পরের এশিয়ান গেমসেও এমন মুহূর্ত উপহার দিতে চান প্রণব-শিবনাথ। —ফাইল চিত্র।

মজার হল, এ দিন যে ক্রীড়াবিদরা অর্জুন পুরস্কারে ভূষিত হলেন, তাঁদের মধ্যে কারও কারওর এশিয়ান গেমসে সোনা নেই। কেউ আবার আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য সাফল্য পাননি। বাস্কেটবলে বিশেষ ভৃগুবংশীর যেমন তেমন কোনও পারফরম্যান্স নেই। ইকুয়েস্ট্রিয়ানে অজয় সাওনকে নিয়েও উঠছে প্রশ্ন। খো-খো আবার এশিয়ান গেমসেরই অন্তর্ভুক্ত নয়। তবু সারিকা কালে পেলেন অর্জুন। তীরন্দাজিতে অর্জুন পাওয়া অতনু দাস আবার ২০১৩ সালে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ব্রোঞ্জ পেয়েছিলেন। এই নামগুলো রক্তক্ষরণ ঘটাচ্ছে হৃদয়ে। এশিয়ান গেমসের সোনার মূল্য কতটা, নিজের মধ্যেই জন্ম নিচ্ছে প্রশ্ন। কিন্তু উত্তর নেই।

এশিয়াডের সোনা যে মূল্যহীন, অন্তত অর্জুন পুরস্কারের ক্ষেত্রে এমন ভাবার যদিও কারণ নেই। ২০১৮ এশিয়ান গেমসে যাঁরা সোনা জিতেছিলেন, তাঁদের প্রত্যেকে এর মধ্যেই অর্জুন পুরস্কার পেয়েছেন। দুই বাঙালি শুধু পাননি। এবং এ বারও পেলেন না। শিবনাথবাবু বললেন, “এটাও কষ্টের জায়গা। সবাই অর্জুন পেয়ে গিয়েছে। আমরাই শুধু এখনও পাইনি। এটা কেন, বুঝতে পারছি না। অন্যদের প্রতি আমাদের মনে কোনও হিংসা নেই। তবে কম পারফরম্যান্স করেও কেউ কেউ অর্জুন পেলে নিজেকে আহতই লাগে, যন্ত্রণাই হয়।” একই সুরে প্রণববাবু বললেন, “অন্য কেউ পাচ্ছে বলে হিংসা করছি ব্যাপারটা, তা কিন্তু নয়। বিদ্বেষের কোনও মনোভাব নেই। আমি যে জায়গায় পৌঁছেছি, আমরা যা করেছি, সেটা কেউ কোনও দিন কেড়ে নিতে পারবে না। ওটা তো করেই ফেলেছি। আমার কতটা সম্মান প্রাপ্য, সেটা নিজের মুখে বলা অশোভন। আমি বরং আরও এক বার সোনা জেতার চেষ্টা করতে পারি।”

প্রণব বর্ধনের আবার একটা রেকর্ডও আছে। এশিয়াডে সবচেয়ে বেশি বয়সে সোনা জেতার রেকর্ড। ৬০ বছর বয়সে সোনা জিতেছিলেন তিনি। সঙ্গী শিবনাথের বয়স তখন ছিল ৫৬। প্রণববাবুর কথায়, “আমি যে বয়সে জিতেছি, তা কিন্তু এখনও রেকর্ড। ওপেন ফিল্ড বা মেন ইভেন্টে আমার বয়সে কেউ সোনা জেতেনি এশিয়াডে।” সোনা এবং রেকর্ড বা রেকর্ড গড়ে সোনা— যাই লেখা হোক, বাস্তব হল তার পরও অর্জুন অধরাই থাকল।

আরও পড়ুন: পঞ্জাবে নিহত কাকা, পারিবারিক বিপর্যয়ই কি সুরেশ রায়নার দেশে ফেরার কারণ​

তার পরও হতাশাকে দূরে রাখার চেষ্টা চলছে। কোভিড পরিস্থিতিতে এশিয়া-প্যাসিফিক প্রতিযোগিতা পিছিয়ে গিয়েছে। দু’বছর পর রয়েছে এশিয়ান গেমস। তাতে ফের তেরঙা তুলে ধরার স্বপ্ন দেখছেন দু’জনে। প্রণববাবুর কথায়, “আমরা গত বার একটা সোনা আর দুটো ব্রোঞ্জ পেয়েছিলাম। পরের বার যদি ভারত পাঁচটা সোনা পায়, তবে এই খেলাটার ভবিষ্যৎ আরও উজ্জ্বল।”

ব্রিজের ভবিষ্যৎ না-হয় উজ্জ্বল, তাঁদের বর্তমান কি এমনই অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকবে? মিলবে না প্রাপ্য স্বীকৃতি? আর এখানেই তীব্র প্রতিবাদের রাস্তা বেছে নিচ্ছেন ১৯৭৯ সালে কপিল দেবের সঙ্গে অর্জুন পাওয়া প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়। বর্তমানে হাওড়ার সাংসদ ও প্রাক্তন ফুটবলার সাফ বললেন, “অর্জুন পুরস্কারের তালিকা দেখে খুব দুঃখ পেয়েছি। তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি যে এটা নিয়ে প্রশ্ন তুলব ১৪ তারিখের জিরো আওয়ারে। জানি না পাশে কাকে পাব। কিন্তু আমি লড়ে যাব। ক্রীড়ামন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করব যে, আপনি এই খেলোয়াড়দের কাকে কাকে চেনেন? আর কারা আপনার অর্জুন বেছে নেওয়ার কমিটিতে রয়েছে? আমি বলব, ওঁরা বাংলার গর্বিত সন্তান। আমি চাই দুই বাঙালি সোনাজয়ীর হয়ে আমার প্রতিবাদ রেকর্ড থাক সংসদে। এটা জঘন্য রকমের অবহেলা।”

প্রণব-শিবনাথ অবশ্য এগিয়ে যেতে চান। রক্তাক্ত হৃদয়ে বসে থাকতে চান না। দু’জনেরই এক কথা, “আমরা এমন একটা খেলা নিয়ে লড়াই করেছি, যা নিয়ে লোকের মধ্যে ঘৃণার ভাবও ছিল। এটাকে বলা হত, সময় নষ্ট করা। কিন্তু এক লহমায় আমরা সেই মানসিকতা বদলে দিয়েছি। এখন ভারতে রেজিস্টার্ড প্লেয়ারের সংখ্যাও অনেক বেড়েছে। অনেক স্কুলেও এটা নিয়ে ভাবনা চলছে। কোর্স হিসেবে চালুও হয়েছে বাংলার বাইরে। সেই কারণেই আমরা ভেবেছিলাম অর্জুন পাব। সেটা ছিল আমাদের ভাবনা। ওঁরা কী ভেবেছেন, সেটা আমরা জানি না। তবে আমরা নিজেদের ধারণা নিয়েই এগিয়ে যেতে চাই। দেশকে গর্বিত করতে চাই।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE