Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
ভারতীয় বোলিং নিয়ে একান্ত সাক্ষাৎকারে অস্ট্রেলীয় পেস-কিংবদন্তি গ্লেন ম্যাকগ্রা

‘সারা বছর ধরেই অক্লান্ত, বুমরাকে উন্নতি দেখে আমি মুগ্ধ’

নিউ সাউথ ওয়েলসের প্রত্যন্ত এলাকা ডাব্বো। সেখান থেকে সমসাময়িক বিশ্বের সেরা ফাস্ট বোলার হিসেবে তাঁর উঠে আসাটাই রূপকথার কাহিনি। বলা হত, বাইশ গজে একটা মুদ্রা ফেলে রাখলে তার উপরে টানা বল ফেলে যেতে পারেন তিনি। অফস্টাম্প লাইন ধরে অক্লান্ত ভাবে আক্রমণ করে যাবেন ব্যাটসম্যানকে। তাঁর মতো নিখুঁত ফাস্ট বোলার আর দেখা যায়নি। ১২৪ টেস্টে ৫৬৩ উইকেট। টেস্টে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারির তালিকায় ফাস্ট বোলারদের মধ্যে এত কাল এক নম্বরে ছিলেন। সম্প্রতি জেমস অ্যান্ডারসন তাঁকে টপকেছেন। কিন্তু সর্বকালের সেরা ফাস্ট বোলারদের তালিকায় তিনি থেকেই যাবেন। স্বর্ণযুগের অস্ট্রেলিয়া টিমের সেরা বোলিং অস্ত্র এখন ভারতে এমআরএফ পেস ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যুক্ত ডেনিস লিলির উত্তরসূরি কোচ হিসেবে। ভারতে পেস বোলিংয়ের বিপ্লব নিজে চোখে দেখছেন। যশপ্রীত বুমরার সঙ্গে কাজ করেছেন চেন্নাইয়ে। স্ত্রী জেন মারা যাওয়ার পরে তাঁর স্মৃতিতে ক্যানসার সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেন। পিঙ্ক ডে টেস্ট চালু করেন স্ত্রীর স্মৃতিতেই। ভারতের স্পিন থেকে পেস বোলিংয়ের দেশে পাল্টে যাওয়া, সচিন তেন্ডুলকর বনাম বিরাট কোহালি, পিঙ্ক ডে টেস্ট— সিডনিতে মিডিয়া সেন্টারে বসে সব কিছু নিয়ে আনন্দবাজারকে দীর্ঘ, একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন অস্ট্রেলিয়ার সর্বকালের অন্যতম সেরা পেস কিংবদন্তি গ্লেন ম্যাকগ্রা। আজ সেই সাক্ষাৎকারের প্রথম কিস্তি।      আনন্দবাজারকে দীর্ঘ, একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন অস্ট্রেলিয়ার সর্বকালের অন্যতম সেরা পেস কিংবদন্তি গ্লেন ম্যাকগ্রা। আজ সেই সাক্ষাৎকারের প্রথম কিস্তি।

নিজস্ব অ্যাকশন বুমরাকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করেছে। ছবি: রয়টার্স।

নিজস্ব অ্যাকশন বুমরাকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করেছে। ছবি: রয়টার্স।

সুমিত ঘোষ
সিডনি শেষ আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০১৯ ০৪:৩০
Share: Save:

প্রশ্ন: ভারত এখন স্পিনের দেশ থেকে গতির দেশ। আপনি তরুণ ফাস্ট বোলারদের সঙ্গে কাজ করছেন। এই পরিবর্তন নিয়ে কী বলবেন?

গ্লেন ম্যাকগ্রা: ছয় বছর হয়ে গেল আমি এমআরএফ পেস ফাউন্ডেশনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছি। এটা নিয়ে সপ্তম বছর। পঁচিশ বছর আগে ‘গ্রেট’ ডেনিস লিলি ফাউন্ডেশনটা তৈরি করেছিলেন। আমি ওঁর কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। খুবই উপভোগ করছি কাজটা। টেকনিক্যাল ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করা একটা দিক। কিন্তু আমি সব চেয়ে বেশি করে যে পরিবর্তনটা দেখেছি, তা হচ্ছে, ভারতে এখন পেস বোলিংয়ের উপর অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়। অতীতে ভারতে বেশির ভাগ জায়গাতেই টার্নিং উইকেট হত। স্পিনকেই প্রধানত বোলিংয়ের অস্ত্র হিসেবে দেখা হত। কিন্তু এটা নিয়ে কারও সন্দেহ ছিল না যে, বিশ্ব মঞ্চে যদি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়, যদি বিদেশে গিয়ে নিয়মিত ভাবে জিততে হয়, তা হলে দারুণ ফাস্ট বোলিং ইউনিট থাকতে হবে। আমার মনে হচ্ছে, ভারতে শুধু সেই উপলব্ধিটা এসেই যায়নি, দারুণ একটা ফাস্ট বোলিং বিভাগ তারা তৈরিও করে ফেলেছে।

প্র: আপনি ফাউন্ডেশনে কাজ করতে গিয়ে কী দেখতে পাচ্ছেন?

ম্যাকগ্রা: আমি খুবই উত্তেজিত ভারতের ফাস্ট বোলিং প্রতিভার গুণগত মান এবং সংখ্যা দেখে। আমি এটুকু বলতে পারি যে, ভারতের হয়ে যারা খেলছে, সেই পাঁচ-ছয় জনই শুধু নয়। আরও অনেকে তৈরি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে আলোকিত করার জন্য। ভারতের এখনকার স্কোয়াডের দিকে যদি তাকান, দারুণ একটা পেস বোলিং আক্রমণ রয়েছে। যারা বিশ্বের সেরাদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ক্ষমতা রাখে। আমার মতে, ভারতীয় ক্রিকেট একদম ঠিক দিকে যাচ্ছে।

প্র: আপনি নিজে কিংবদন্তি ফাস্ট বোলার। ভারতের সঙ্গে অনেক ম্যাচ খেলেছেন। এই ফাস্ট বোলিং আক্রমণটাই কি ভারতের সেরা?

ম্যাকগ্রা: আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই যে, এই পেস বোলিং আক্রমণ ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা। দারুণ সব বোলার রয়েছে। যশপ্রীত বুমরা দারুণ বল করছে। আমি ওকে দেখে মুগ্ধ। বুমরাকে আমি কয়েক বছর আগে অল্প সময়ের জন্য এমআরএফ পেস ফাউন্ডেশনে দেখেছিলাম। তখন একটু অন্য রকম ছিল। তবে ও এখন যে রকম বোলিং করছে, তার জন্য কোনও কৃতিত্ব আমি দাবি করতে পারি না, পুরোটাই বুমরার নিজের কৃতিত্ব। তার পর মহম্মদ শামি। লুকোনো গতি আছে। দেখে বোঝা যায় না, ও কত জোরে বল করতে পারে। দু’দিকে বল সুইং করাতে পারে। চিন্তা করতে পারে, স্মার্ট বোলার। ইশান্ত শর্মা অস্ট্রেলিয়ায় এসে অন্য রকম লেংথে বল করেছে। আরও ফুল-লেংথ বল করেছে। দারুণ সিদ্ধান্ত। এর ফলে গতিটা বাড়িয়ে নিতে পেরেছে ও। উমেশ যাদবও বেশ ফাস্ট। এই সিরিজে ও পার্‌থে খেলেছে। জানি না, পেস কমিয়ে ও সুইংয়ের দিকে বেশি নজর দিচ্ছিল কি না। ভারতের স্পিনাররা সব সময়ই ভাল। সবাই প্রত্যাশা করে, ওরা ভাল করবে। তাই সব মিলিয়ে অন্যতম সেরা বোলিং আক্রমণ।

আরও পড়ুন: সিডনিতে বিশ্বজয়ের পর শুরু নয়া তর্ক, এটাই কি ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বসেরা দিন?

বুমরার বোলিংয়ে মুগ্ধ ম্যাকগ্রা।

প্র: বুমরার সঙ্গে অ্যাকাডেমিতে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল? নির্দিষ্ট কিছু কি ওঁকে বলেছিলেন?

ম্যাকগ্রা: ফাস্ট বোলিং পুরোটাই স্ট্রেট লাইন নির্ভর। সোজা বোলিং ক্রিজের দিকে আসতে হবে, সোজা লাইন ধরে বল করে যেতে হবে। বুমরাকে যখন আমি দেখি এমআরএফ ফাউন্ডেশনে, তখন ওর স্ট্রেট লাইন থেকে সরে যাওয়ার একটা প্রবণতা ছিল। তখন একটা জাম্পও ছিল ওর। সেটার জন্যই আরও স্ট্রেট লাইন থেকে সরে যেত। তখনই ওর বলে বেশ ভাল গতি ছিল, দারুণ ইয়র্কার করতে পারত এবং অন্য রকম বোলিং অ্যাকশন ছিল। এই ধরনের বোলারকে খুব বেশি কিছু বলা উচিত নয় বলে আমি মনে করি। কারণ সেটা করতে গিয়ে তার সহজাত প্রতিভাকে নষ্ট করে ফেলতে পারে কোনও কোচ। ওই নিজস্ব অ্যাকশন বুমরাকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করেছে। তাই ওকে ওর মতো করে এগোতে দেওয়া দরকার ছিল। এমআরএফে আমি ওই জাম্পটা নিয়েই বেশি কথা বলেছিলাম। স্ট্রেট লাইনে থাকার ব্যাপারটা ধরিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। এখানে বুমরার সঙ্গে আমার কথা হচ্ছিল। বলল, হাঁটুতে সমস্যার পরে আর জাম্পটা দিতে পারে না। তাতে রান-আপ আর অ্যাকশনে কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। আমার মনে হয়, চোটটা ওর শাপে বর হয়েছে। আরও নিখুঁত হয়েছে ওর রান-আপ আর অ্যাকশন। ২০১৮-তে বিশ্বের অন্য যে কোনও ফাস্ট বোলারের চেয়ে ও বেশি বল করেছে। কিন্তু গতি পড়তে দেয়নি এবং ধারাবাহিক ভাবে ভাল বল করে গিয়েছে। ওর ধকল নিতে পারার ক্ষমতাটাও আমাকে মুগ্ধ করেছে। অনেক বৈচিত্রও এনেছে। আগে শুধু ইনসুইং, ইনকাটারই করত। অনেকের মনে হয়েছিল, ওই অ্যাকশনে হয়তো আউটসুইং করানো সম্ভব হবে না। কিন্তু একই অ্যাকশনে আউটসুইং যোগ করতে পারছে এখন। দুর্দান্ত একটা বছর গিয়েছে ওর। আমি বুমরার অগ্রগতিতে মুগ্ধ।

ঐতিহাসিক: অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে প্রথম টেস্ট সিরিজ জেতার পরে বর্ডার-গাওস্কর ট্রফি নিয়ে উল্লাস ভারতীয় দলের। সোমবার সিডনিতে। পঞ্চম দিনে খেলা হল না একটি বলও। ছবি: এএফপি।

প্র: আপনার কী মনে হচ্ছে, ভারতে কী পাল্টেছে? এই পেস বোলিং বিপ্লবের প্রধান কারণ কী? আপনি যখন খেলেছেন, তখনও ভারতের হাতে বেশির ভাগ ভাল বোলারই ছিলেন মিডিয়াম পেসার। ফাস্ট বা এক্সপ্রেস বোলার ততটা দেখা যায়নি, যা এখন দেখা যাচ্ছে।

ম্যাকগ্রা: ভারতে এখনও বেশ ভাল মিডিয়াম পেসার পাওয়া যাবে। এবং উপযুক্ত পরিবেশ পেলে সেই সব মিডিয়াম পেসার এখনও দারুণ বল করতে পারে। রঞ্জি ট্রফিতে কয়েকটা জায়গার উইকেটে এখন পেস বোলারদের জন্য বেশি প্রাণ থাকছে। আমার মনে হয়, ভারতীয় ক্রিকেটের অভ্যন্তরে প্রধান মস্তিষ্করা এটা নিয়ে আলোচনা করেছে যে, অস্ট্রেলিয়া বা দক্ষিণ আফ্রিকা বা ইংল্যান্ডের মতো জায়গায় গিয়ে ভাল করতে গেলে, বিদেশের মাটিতে টেস্ট জিততে গেলে আমাদেরও পেস বোলারদের ইউনিট তৈরি করতে হবে। তাদের উৎসাহ দিতে হবে। দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টেছে।

ভারতীয় বোলিংয়ের বৈচিত্র বাড়ছে।

আমার মনে হয়, আইপিএল এই চিন্তাভাবনায় সাহায্য করেছে। কারণ, নানা দেশের নানা ধরনের বোলার ভারতে খেলতে আসছে। সেটা ভারতীয় বোলিংয়েও বৈচিত্র বাড়াতে সাহায্য করেছে। তবে আমি প্রধান কারণ বলব, চিন্তাভাবনায় তফাতটা আসা যে, আমাদের দেশে তরুণ ফাস্ট বোলার আছে। সেই প্রতিভাদের আমরা চিহ্নিত করব এবং একটা পেস বোলিং ইউনিট গড়ে তুলব। সিস্টেমের মাধ্যমে সেটা হচ্ছে বলে ভারতের পেস বোলাররা এখন শারীরিক ভাবে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়েছে। মানসিক ভাবে ওরা অদম্য হয়ে উঠেছে। অস্ট্রেলিয়ায় এসে মন খুলে উড়ছে। বিদেশে খেলতে আসার সেই জড়তা দেখাই যাচ্ছে না। ভারতীয় ক্রিকেট এই বোলিং আক্রমণের কাছ থেকে বিদেশে আরও অনেক ম্যাজিক মুহূর্ত উপহার পাওয়ার আশা করতে পারে। আমার দারুণ লাগছে ভারতের এই পেস বোলিং আক্রমণকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE