Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

ইডেন দেখল রাসেল তাণ্ডব, হায়দরাবাদকে হারিয়ে দুর্দান্ত জয় নাইটদের

টিম হোটেলে ফিরে শাহরুখ খান যদি তাঁকে রাতভর পার্টি করার জন্য ডাকেন, তা হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এ তো পার্টি করারই রাত।

রাসেলের ব্যাটে জয় এল সহজেই। ছবি: পিটিআই

রাসেলের ব্যাটে জয় এল সহজেই। ছবি: পিটিআই

কৌশিক দাশ
শেষ আপডেট: ২৫ মার্চ ২০১৯ ০৪:০২
Share: Save:

টিম হোটেলে ফিরে শাহরুখ খান যদি তাঁকে রাতভর পার্টি করার জন্য ডাকেন, তা হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এ তো পার্টি করারই রাত।

শেষ তিন ওভারে প্রয়োজন ৫৩ রান। যা এর আগে আইপিএলের কোনও দল রান তাড়া করার সময় করতে পারেনি। জমে যাওয়া ব্যাটসম্যান নীতীশ রানা আলো বিভ্রাটের ঠিক পরের বলেই আউট হয়ে গিয়েছেন। এই অবস্থায় দু’বল বাকি থাকতে, ছ’উইকেটে কলকাতা নাইট রাইডার্স যে ভাবে সানরাইজার্স হায়দরাবাদকে হারিয়ে দিল, তা তো সাধারণত বলিউড স্ক্রিপ্টেই লেখা থাকে।

কিন্তু ১৯ বলে অপরাজিত ৪৯ করে যে ক্যারিবিয়ান যুবক ইডেনে হাজির শাহরুখের মুখে হাসি ফোটালেন, তিনি কি পার্টিতে যেতে রাজি হবেন? আন্দ্রে রাসেল অবশ্যই পার্টি করতে পছন্দ করেন, কিন্তু গভীর রাতে আরও একটা জিনিস করতেও তিনি ভালবাসেন। রাসেলের রাসেল হয়ে ওঠার পিছনে রয়েছে এই গভীর রাতের ‘সাধনা’। কে জানে, হয়তো হোটেলে ফিরে সেই ‘সাধনা’তেই ডুবে যাবেন এই নাইট।

রাসেলের এ রকম অতিমানবীয় ব্যাটিংয়ের রহস্যটা কী? তিনটি কারণ বাছতে বললে সেগুলো হবে— শক্তি, শক্তি এবং শক্তি! এমসিসি কোচিং ম্যানুয়ালের রচয়িতারা রাসেলের ব্যাটিং দেখলে বিষম খেতে পারেন, কিন্তু তাতে কার কী এসে গেল!

আরও পড়ুন: হায়দরাবাদকে হারিয়ে ইডেনে নাইট রাইডার্সের রুদ্ধশ্বাস জয় এল এই সব কারণে

ঠিক যেন কোনও শিল্পীর পাথর কুঁদে তৈরি করা শরীর। পেশিতে পেশিতে শক্তির বিচ্ছুরণ। আর এই শক্তির উৎস ওই গভীর রাতের ‘সাধনা’। যে সময় কেউ যখন ঘুমের কোলে, কেউ নাইট ক্লাবে, রাসেল তখন ডুবে যান গভীর রাতের শারীরচর্চায়। কখনও সুইমিং পুলে সাঁতার, কখনও কার্ডিয়ো, কখনও ওয়েট ট্রেনিং আবার কখনও বা পাঞ্চিং ব্যাগ ঝুলিয়ে কিক বক্সিংয়ের অনুশীলন। দিনের পর দিন, থুরি রাতের পর রাত। রাসেলের ওই সুঠাম শরীর আর শক্তির যা উৎস। রাসেল ঘনিষ্ঠদের যে খবর একেবারেই অজানা নয়। রাসেল-শক্তির ছোট্ট একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। এই ক্যারিবিয়ান অলরাউন্ডারের স্টান্সটা সামান্য একটু অনসাইড ঘেঁষা। গার্ড নেওয়ার সময় বাঁ পাটা একটু লেগ সাইডের দিকে সরে থাকে। যে কারণে মিড অন, মিড উইকেট অঞ্চল দিয়ে অনায়সে বল উড়িয়ে দিতে পারেন। যে কারণে ডেথ ওভার বিশেষজ্ঞ ভুবনেশ্বর কুমার অফস্টাম্পের বাইরের লাইনে আক্রমণ করতে চেয়েছিলেন। ১৯তম ওভারের পঞ্চম বলটাও দিয়েছিলেন অফস্টাম্পের অনেক বাইরে। ওয়াইড মার্কারের প্রায় উপরে। রাসেল প্রথমে অন সাইডের দিকে সামান্য সরে জায়গা বানাতে চেয়েছিলেন। বলটা পাচ্ছেন না দেখে হাঁটু মুড়ে বসে ব্যাটটা চালিয়ে দিলেন। নীচের দিকে লাগল, টিভি রিপ্লে দেখলে বোঝা যাবে মিসহিট। কিন্তু ভুবনেশ্বরের চোখ গগনে তুলে দিয়ে এক্সট্রা কভারের ওপর দিয়ে বলটা ইডেনের গ্যালারিতে অবতরণ করল। আর কোনও শটের ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই, বাকি তিনটে ছয় কোথা দিয়ে গিয়েছে, না ভাবলেও চলবে। ওই একটা শটই বুঝিয়ে দিয়ে গেল আন্দ্রে রাসেল কী বস্তু!

শেষ তিন ওভারে প্রায় ১৮ করে আস্কিং রেট। তখন মনে হচ্ছিল, রবিবারের ইডেনটা এক জন বাঁ হাতিরই হয়ে থাকবে। ঠিক এক বছর আগে, এই ২৪ মার্চেই, কেপ টাউনে বল বিকৃতি কাণ্ড ঘটিয়ে ক্রিকেটের অন্যতম ধিক্কৃত চরিত্র হয়ে উঠেছিলেন তিনি। এক বছর বাদে, আইপিএল মঞ্চে ফিরে ডেভিড ওয়ার্নার বুঝিয়ে দিলেন, তিনি কতটা ক্ষুধার্ত। ব্যাট করতে নেমে প্রায় একার হাতে সানরাইজার্স হায়দরাবাদ ইনিংসকে টানলেন। ৫৩ বলে ৮৫ রান করে গেলেন। ন’টি চার, তিনটি ছয়ও পাওয়া গেল তাঁর ব্যাট থেকে। পাশাপাশি আরও একটা জিনিস বুঝিয়ে দিলেন ওয়ার্নার। বুঝিয়ে দিলেন, কুলদীপ যাদবের চায়নাম্যান-গুগলি হোক, কী সুনীল নারাইনের বিস্ময় ডেলিভারি, সব কিছুই গ্রিপ দেখে বুঝে নিতে পারছেন। যে কারণে প্রত্যাবর্তনের ওয়ার্নারের সামনে নাইটদের স্পিন শক্তি কোনও সমস্যাই তৈরি করতে পারল না। প্রথম দুই ওভার করার পরে নারাইন এবং কুলদীপের বোলিং হিসেবটা একই রকম দাঁড়াল: ২-০-১৮-০। নারাইনকে তাও একটা ওভার পরে দিয়েছিলেন দীনেশ কার্তিক। কুলদীপকে আর আনেননি। অস্ট্রেলিয়ার কোচ জাস্টিন ল্যাঙ্গার যদি এই ম্যাচটা দেখে থাকেন, তবে একটা ব্যাপারে আশ্বস্ত হবেন। তিনি এমন এক জন ব্যাটসম্যানকে বিশ্বকাপে পাচ্ছেন, যিনি হাত দেখে স্পিনারদের বল বুঝে নিচ্ছেন।

ফিল্ডিং করতে গিয়ে নারাইনের আঙুলে চোট লাগায় এ দিন ওপেন করতে পারেননি। তাঁর জায়গায় ওপেন করতে নামা নীতীশ আইপিএল কেরিয়ারের অন্যতম সেরা ইনিংসটা খেলছিলেন। গত মাসেই বিয়ে করেছেন। স্ত্রী ভাগ্যে সোনা ফলছে, এ রকমটা ভাবনা যখন দানা বাঁধছে, তখন হঠাৎ করে লোডশেডিং! মানে, পুরো ইডেন জুড়ে নয়, হাইকোর্ট প্রান্তের বাতিস্তম্ভে। খেলা প্রায় মিনিট ১৪ বন্ধ থাকল। এবং শুরু হওয়ার পরে প্রথম বলেই নীতীশ আউট! কেকেআর হারলে ফ্লাডলাইট বিতর্ক তুঙ্গে হতে পারত। কিন্তু রাসেল এ যাত্রা সিএবি-কেও বাঁচিয়ে দিয়ে গেলেন। ১৮তম ওভারে সিদ্ধার্থ কল দিলেন ১৯ রান। পরের ওভারে ভুবনেশ্বর ২১, শেষ ওভারে শাকিব আল হাসান ১৪। ‘বার্থডে বয়’ শাকিবকে দু’টো ছয় মেরে খেলা শেষ করে দিলেন শুভমন গিল। সানরাইজার্সের ১৮২ রানের লক্ষ্য ১৯.৪ ওভারে ১৮৩-৪ তুলে পৌঁছে যায় কেকেআর।

শাহরুখের বলিউডি ছবিতে যে ধরনের মশলা থাকে, তার সবই প্রায় ছিল ইডেনে মরসুমের প্রথম আইপিএল ম্যাচে। প্রত্যাবর্তন, দীর্ঘশ্বাস, হতাশা, পাল্টা লড়াই, মহানাটকীয় মোচড় এবং সব শেষে সিনেমা হিট করতে গেলে যা সব চেয়ে বেশি দরকার— ক্লাইম্যাক্স ও হ্যাপি এন্ডিং। শাহরুখ নিজে পরিচালক হলেও বোধ হয় এত ভাল একটা ‘শেষ’ উপহার দিতে পারতেন না ইডেনের দর্শকদের। ম্যাচ জেতানোর পাশাপাশি রাসেল এ দিন সার্থক করে দিলেন নাইটদের এই মরসুমের স্লোগানও— কেকেআর হ্যায় তৈয়ার, আখরি দম তক, আখরি রান তক!

সত্যিই, রাসেল যে দলে আছেন, সে দলের তো শেষ রান পর্যন্ত লড়াই করার রসদ থাকবেই। রবিবাসরীয় ইডেনে শাহরুখের ফিল্ম যে হিট করিয়ে দিয়ে গেলেন ওই এক জনই— আন্দ্রে রাসেল!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE