জয়ী: অভিষেক ম্যাচে মন জিতলেন পৃথ্বী শ। ছবি: এএফপি।
ছোট্ট একটা জাম্প! হাতের মুঠোয় পৃথিবী শাসন করার প্রতিজ্ঞা। তার পরেই কী যেন ভুলে গিয়েছি হাবভাবে এক ঝটকায় হেলমেট খুলে ব্যাট হাতে বীরবিক্রমে গ্যালারির দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে ফেলল বছর আঠারোর বিস্ময় বালকটি। ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসে অভিষেক ম্যাচে শতরান ছোঁয়ার কনিষ্ঠতম নজির— পৃথ্বী শ।
ক্যারিবিয়ান বোলিংকে দুরমুশ করা ডান হাতের কব্জিটা তখনও আঁকড়ে ধরে আছেন ২৯৩ নম্বর ব্যাটটা। বৃহস্পতিবার সকালে ক্যাপ্টেন কোহালির হাত থেকে ব্যাটটা পাওয়ার পরেই তা নাড়িয়েচাড়িয়ে দেখে নিয়েছিলেন আঠারোর কিশোর।
মনে মনে কি কোচকে দেওয়া কথাই আউড়ে নিচ্ছিলেন তিনি? ‘‘স্যর কিছু ভাববেন না। আমি একদম তৈরি আছি।’’ ছেলেবেলার কোচ রাজু পাঠক সেই আশ্বাসবাণী পেয়েই কি আজ চোখ রেখেছিলেন ছাত্রের অধ্যবসায়ের দিকে?
আরও পড়ুন
এই বালককে কুর্নিশ ভারতীয় ক্রিকেটের
নিখুঁত ফুটওয়ার্কেই বাজিমাত পৃথ্বীর। ছবি: এএফপি।
আত্মবিশ্বাস ও অধ্যবসায়ের সেই নমুনাই বৃহস্পতিবার রাজকোটের মাঠে ১৫৪ বলে ১৩৪ রানের জবাবে এঁকে দিয়ে গেলেন পৃথ্বী। স্ট্রাইক রেট ৮৭-রও বেশি। বয়স যে সত্যিই একটা সংখ্যামাত্র তা ১৮ বছর ৩২৯ দিনের ব্যাটিং ঝড়ে বুঝিয়ে দিলেন। মাঠে ছিলেন এক টানা পাঁচ ঘণ্টার একটু বেশি। নিখুঁত ফুটওয়ার্ক, ব্যাকফুট পাঞ্চ, ফ্লিক, কভার ড্রাইভ মিলিয়ে দুরন্ত ইনিং। যে কোনও ক্রিকেটপ্রেমী মজে যাবেন অমন টাইমিং দেখলে। সব মিলিয়ে টেস্ট ক্রিকেটের সাদামাঠা গ্যালারিকে উত্তেজনায় মুড়ে দিলেন পৃথ্বী।
তিনি একশো ছুঁতেই গ্যালারিতে নিমেষে উৎসবের আবহ। এক দিকে উচ্ছ্বাসে ভেসে যাচ্ছে ভারতীয় ক্রিকেট দল। টিম ইন্ডিয়ার অধিনায়ক বিরাট কোহালির দাপুটে হাততালি ছোট্ট ছেলেটার বুকের খাঁচায় পুরে দিচ্ছে উৎসাহের অতিরিক্ত অক্সিজেন। তিনি হয়তো কোথাও আশ্বস্ত, পরের বিশ্বকাপে একজন পাকা ওপেনারের ছায়া দেখতে পেয়ে। গোটা গ্যালারি তখন ভারতীয় তেরঙা ও করতালিতে মুখর। গোটা ক্রিকেট সভ্যতাই যেন নেমে এসে কুর্নিশ ! টুইটার, ফেসবুক ছেয়ে গিয়েছে পৃথ্বী-বরণে। অভিনন্দনে মুড়ে দিয়েছেন পুরনো ও সিনিয়র ক্রিকেটাররা। ‘‘হোয়াট আ ডেবিউ’’ লিখে টুইট করল খোদ আইসিসি-ও।
আরও পড়ুন
অভিষেক টেস্টে ১৩৪ রান পৃথ্বীর, কনিষ্ঠতম ভারতীয় হিসাবে গড়লেন নজির
উল্টো দিকের ক্রিজের সহ খেলোয়াড় চেতেশ্বর পূজারাও নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না নিজের আবেগ। ক্রিকেট মাঠে বিপক্ষ দলের যোদ্ধার প্রতি উদার-কুর্নিশ রেখে যাওয়া এই খেলার অলিখিত পাঠ। জেন্টলমেন’ গেম অন্তত সে শিক্ষাই দেয়। সেই রেওয়াজকেই তখন মাঠে ঝালিয়ে নিচ্ছেন ক্যারিবিয়ান দলের খেলোয়াড়রা। যা দেখে পৃথ্বী শ-কে নিয়ে সচিন তেন্ডুলকরের ভবিষ্যদ্বাণীই মনে পড়ে যাচ্ছে। ‘‘এ ছেলে একদিন ভারতীয় ক্রিকেটের গর্ব হবে।’’ আজ পৃথ্বীর খেলা দেখতে দেখতেও টুইট করলেন তিনি। ‘‘প্রথম ইনিংসে তোমার এমন আক্রমণাত্মক খেলা দেখতে বড় ভাল লাগছে পৃথ্বী!’’
Lovely to see such an attacking knock in your first innings, @prithvishaw! Continue batting fearlessly. #INDvWI pic.twitter.com/IIM2IifRAd
— Sachin Tendulkar (@sachin_rt) October 4, 2018
শুধু সচিনই নন, পৃথ্বী-বন্দনায় আজ মুগ্ধ অনেকেই। আজ পৃথ্বীর খেলায় মুগ্ধ সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায় এক সমবাদমাধ্যমকে জানান, ‘‘টিপিক্যাল মুম্বই ঘরানার এই ট্যালেন্ট আসলে ক্রিকেট বিস্ময়। রঞ্জি, দলীপ, টেস্ট— ক্রিকেটের তিনটি স্তরেই এমন ধারাবাহিক সাফল্য ও সেঞ্চুরির রেকর্ড আর কারও নেই বলেই, আমার মনে হচ্ছে। আজ খেলতে নেমে এক বারও থামেনি ছেলেটা। নিজের নর্মাল খেলাটা খেলেছে। দ্বিতীয় যে বলটায় তিন রান নিল, সেই বলটা অন্য কেউ হলে হয় ছেড়ে দিত, নয়তো রক্ষণাত্মক স্ট্রোক খেলত।’’
হ্যাঁ, মানছি, ওয়েস্ট ইন্ডিজ তাদের সেরা বোলারকে এই টেস্টে পায়নি। তবু পৃথ্বীর এই সাফল্য সেই অজুহাতকে খাটো করে দেয়। যে ভাবে ইনিংসের দ্বিতীয় বলে স্থির মস্তিষ্কে তিন রানের সিদ্ধান্ত নিলেন, তাতেই চিনিয়ে দিলেন জাত।
ক্রিকেট দেবতা তখন ভর করেছেন পৃথ্বীর ব্যাটে। ছবি: এএফপি।
তবে জাত চেনানোর সূত্র এটাই প্রথম নয়। এর আগেই মুম্বই ঘরানার এই খেলোয়াড় স্বল্প সময়ের পরিসরেই নিক্তিতে নিক্তিতে মেপে দিয়েছে নিজের প্রতিভা। মাত্র ১৪ বছর বয়সে রিজভি স্প্রিংফিল্ড স্কুলের হয়ে এক ইনিংসে ৫৪৬ রান। ১৪ বছরের এক কিশোরের ব্যাটে সে দিন চোখ ধাঁধানো স্ট্রোকের ফুলঝুরি দেখেছিল আজাদ ময়দান। দু’দিন ধরে ব্যাট করে প্রায় ৯০টা বাউন্ডারি ও পাঁচটা ওভার বাউন্ডারি মারেন তিনি। ১৭ ছুঁতেই প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক। সে বছরই রঞ্জি ও দলীপ ট্রফির অভিষেক ম্যাচে সেঞ্চুরি। ১৮ বছর হতে না হতেই এল বিশ্বমঞ্চে ভারতীয় দলকে নেতৃত্বের সুযোগ। অনুর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপে এই ছেলেটির নেতৃত্বেই চ্যাম্পিয়ন ভারত। তত দিনে পৃথ্বীর রেকর্ড বুকে ঢুকে পড়েছে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে পাঁচটি সেঞ্চুরি।
আরও পড়ুন
পৃথ্বী শ-কে কেন বিস্ময় প্রতিভা বলা হয়, জানেন কি?
WHAT A DEBUT 👏
— ICC (@ICC) October 4, 2018
Prithvi Shaw brings up his maiden Test 💯. At 18 years 329 days, he has now become the youngest Indian to score a century on debut! 🔥
➡️ https://t.co/SreOH45VXi pic.twitter.com/7r8UFsPD5A
আইপিএল খেলার প্রসঙ্গ আপনি তুলতেই পারেন, কিন্তু ভুললে চলবে না আইপিএল আর টেস্ট ক্রিকেট কিন্তু আশমান-জমিন ফারাকের মঞ্চ। ধর তক্তা মার পেরেকের তত্ত্ব ভুলে এখানে স্লো বাট স্টেডি-তে অভ্যস্ত হতে হয়। খেলোয়াড়ের পাল্স, স্নায়ু ও মস্তিষ্কের অঙ্ককে আমূল বদলে ফেলতে হয় টেস্ট মাঠে সফলতা তুলে আনতে গেলে। সেই কাজটাই দক্ষতার সঙ্গে সামলে দিলেন আজ পৃথ্বী। যা দেখে অনেকেই তাঁকে ভবিষ্যতের ‘সচিন’ বলে ভেবে পেলছেন এখনই। যদিও চরম অনিশ্চয়ের খেলা এই ক্রিকেটে একটা ম্যাচ কিছুরই উত্তর দেয় না। এত সহজে কোনও তুলনাই সেখানে বিচার্য নয়। তবু আজ পৃথ্বীর ব্যাটিং সে সব যুক্তি-বুদ্ধির সীমানা পেরিয়ে না হয় একটু আগলহীন ভিত্তিহীন রূপকথার তুলনা বোনারই সাহস দেখাল আমাদের— ক্ষতি কী!
কেল্লা ফতে! মাঠে নিজের সাফল্যে আনন্দিত পৃথ্বী। ছবি: এপি।
তবে শুধু ব্যাট-বলের খেলাতেই নয়। ঝড়ঝঞ্ঝা সামলানোর অভ্যাস তাঁর সেই কোন ছেলেবেলা থেকেই! মা মারা যাওয়ার দুঃখ ভুলতে ক্রিকেট ব্যাটটাকেই আপন করে নিয়েছিলেন বালক বয়সেই। বাবাও ছেলের আগ্রহে বাধ সাধেননি। সেরা প্র্যাকটিসে রাখবেন বলে উত্তর মুম্বইয়ের ভিরার থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরের বান্দ্রায় ভর্তি করলেন ছেলেকে। কিন্তু তাতেও রোজ ঝুলতে ঝুলতে আসতে হত শিশু পৃথ্বীকে। প্রায় দু’ঘণ্টা লাগত বান্দ্রায় আসতে। তবু সেই যাত্রার ধকল কাবু করতে পারেনি তাকে। নির্বাচকদের নেকনজরকে ‘পাখির চোখ’ করেছিল সে তখন থেকেই। তাই সামনে বড় ম্যাচ না থাকলেও কামাই ছিল না রুটিন প্র্যাকটিসের ক্ষেত্রেও। জ্বর গায়েও নেমে পড়েছে মাঠে। ছোট্ট কাঁধে তুলে নিয়েছে প্রেস্টিজ ম্যাচ জেতানোর সব দায়িত্ব।
আরও পড়ুন
গত কাল দল ঘোষণার পর মিডিয়ার উৎসাহের কেন্দ্রে থাকা প্রিয় ছাত্রের এ সব অবদানের কথা বলতে গিয়ে বারবারই চোখ ভিজে যাচ্ছিল কোচ রাজু পাঠকের। আজ মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে পৃথ্বীর শতরান কিন্তু এমন আনন্দাশ্রুই এনে দিল কোটি কোটি ভারতবাসীর চোখেই।
ক্রিকেটাররা বিশ্বাস করেন: ক্রিকেটকে যতটা ভালবাসবে, ক্রিকেট তোমাকে ততটা প্রেমই ফিরিয়ে দেবে। সে বিশ্বাস যে নেহাত ফাঁকা বুলি নয়, তার প্রমাণ আজ মাঠে পৃথ্বী ও ক্রিকেটের গোপন আশিকি। ব্যাট-বলের সঙ্গে কিশোর খেলোয়াড়ের তুমুল মোলাকাত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy