বাউন্স-আতঙ্কের ইডেনে ভুবনেশ্বরের দিন।-শঙ্কর নাগ দাস
ইডেন গার্ডেন্স, না ইডেন পার্ক? বোধহয় গুলিয়েই ফেলেছিলেন রস টেলররা।
পরাধীন ভারতের গভর্নর জেনারেল জর্জ ইডেনের নামে দুই মাঠই। তিনি আবার ছিলেন প্রথম আর্ল অব অকল্যান্ড। তাই কলকাতার মতো সেই শহরেও তাঁর কীর্তির ফলক রয়েছে।
শনিবার গঙ্গার ধারের মাঠে রস টেলরদের সেই ইডেন পার্কের কথা মনে করিয়ে দিলেন ভারতের পেসাররা।
আড়াই বছর আগে অকল্যান্ডের ইডেনে ট্রেন্ট বোল্ট, টিম সাউদি, নিল ওয়াগনাররা শুইয়ে দিয়েছিলেন এমএস ধোনির দলের ব্যাটসম্যানদের।
ইশান্ত শর্মা পাল্টা দিয়েছিলেন প্রথম ইনিংসে হাফ ডজন ও দ্বিতীয় ইনিংসে তিনটে শিকার তুলে। দ্বিতীয় ইনিংসে মহম্মদ শামি, জাহির খানরা তিনটে করে উইকেট নিয়ে কিউয়িদের শিরদাঁড়া দিয়ে বরফের স্রোত নামিয়ে দেন। নিজেদের মাঠে ১০৫-এ শেষ হয়ে চরম অপদস্থ হয়েছিলেন ব্রেন্ডন ম্যাকালামরা।
শনিবার যেন সেই দিনগুলোই ফিরে এল। তবে ইডেন পার্কে নয়, ইডেন গার্ডেন্সে।
ভুবনেশ্বর কুমারের ভয়ঙ্কর সুইংয়ে অসহায় দেখাচ্ছে এই নিউজিল্যান্ডকে। তাদের দেশের মতোই কন্ডিশন যেখানে, সেখানে ভারতীয় পেসারদের মোকাবিলা করতে নেমে রীতিমতো কাঁপছেন কিউয়ি ব্যাটসম্যানরা। ভারতের মাঠে প্রায় আড়াই ঘন্টা ব্যাট করে দিনের শেষে তারা ১২৮-৭। যার পাঁচটাই ভুবনেশ্বরের নেওয়া। এমন দৃশ্য বিরল।
আর এ রকম উইকেটেই কি না ৫৪ রানের ইনিংস খেলে ভারতকে হার থেকে অনেকটা দূরে সরিয়ে নিয়ে গেলেন এক বাঙালি। ঋদ্ধিমান সাহা।
পরিচিত ফর্মুলা হল, দেশের মাঠে বিরাট কোহালিদের ত্রাতা রবিচন্দ্রন অশ্বিন-ই। সেপ্টেম্বরের ইডেনের অচেনা পিচ কিন্তু অন্য ছবি দেখাচ্ছে। টেস্টের বয়স দু’দিন গড়িয়ে গেল, অশ্বিন কিন্তু খাতা খুলতে পারলেন না। বরং বল করতে এসে প্রথম ওভারেই তিন তিনটে বাউন্ডারি দিয়ে দিলেন। তাঁকে দিয়ে পাঁচ ওভারের বেশি বোলিং করানোর প্রয়োজনও হল না কোহালির। ঠিকঠাক উইকেট পেলে যে ঘরের মাঠে পেসাররাও টেস্ট জয় এনে দিতে পারেন, ইডেনের এই উইকেট থেকেই হয়তো সেই ধারণাটা উঠে আসবে এ বার।
ইডেনের এই পিচ অবাক করেছে অনেককেই। সেপ্টেম্বরের উইকেটে এ রকম ক্যারি এবং বাউন্স কস্মিনকালেও দেখা গিয়েছে কি না সন্দেহ। স্থানীয় ক্রিকেট মহল তো মনে করতে পারছে না। এই উইকেট দেখে অবাক স্বয়ং ঘরের ছেলে ঋদ্ধিও। আগের দিন রাহানে যা বলেছিলেন, এ দিন ঋদ্ধিও প্রায় একই কথা শোনালেন, ‘‘ইডেনে যেমন উইকেট হয়ে থাকে, এটা তার চেয়ে অন্য রকম। এখানে এমন উইকেট কখনও দেখিনি।’’
টিভি কমেন্ট্রি টিমে রয়েছেন বলে সকালে মাঠে গিয়ে উইকেট দেখার সুযোগ হয় দীপ দাশগুপ্তর। বৃষ্টিতে ঘন্টা দুয়েক খেলা বন্ধ থাকার সময় বললেন, ‘‘বেশ ভাল উইকেট। কী সুন্দর ক্যারি আছে দেখছেন? বাউন্সও যথেষ্ট।’’ মহম্মদ শামি শেষ বিকেলে একটা বল টেলরের মাথার উপর দিয়ে এমন উঁচুতে তুললেন যে, তার নাগাল পেলেন না ঋদ্ধিও।
কিউরেটর সুজন মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘আমি তো অনেক আগে থেকেই বলেছি ভাল উইকেট হবে। সবাই সাহায্য পাবে। টার্ন প্রথম দিন থেকেই অল্পবিস্তর হচ্ছে। কাল (রবিবার) থেকে হয়তো বেশি হবে। দেখা যাক।’’ দীপও বলছেন, ‘‘উপরের সারফেসটাতে যে হেতু এঁটেল মাটির ভাগটাই বেশি, তাই সহজে ফাটছে না।’’
সিএবি প্রেসিডেন্ট সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় নিজে দাঁড়িয়ে থেকে উইকেট তৈরি করিয়েছিলেন। সুজন বলছিলেন, ‘‘মহারাজের কথা মতোই উইকেটের কাজ হয়েছে। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের চেয়ে ভাল এখানে আর কে উইকেট বুঝবে? গত কয়েক দিন উইকেটটাই আমাদের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছিল। প্রচুর খাটতে হয়েছে এই উইকেটের পিছনে।’’
হোম টেস্টে এই প্রথম এক ইনিংসে পাঁচ উইকেট নেওয়ার পর ভুবনেশ্বরও বলছেন, ‘‘এ রকম উইকেট এ দেশে বড় একটা দেখা যায় না। তাই একে পুরোপুরি কাজে লাগাতে চাইছিলাম আমি। যখন দেখলাম উইকেটটা আমাকে সাহায্য করছে, তখনই নিজেকে বললাম পাঁচ উইকেট নিতেই হবে। দেশের মাঠে পাঁচ উইকেট নেওয়াটা আমার একটা স্বপ্ন ছিল।’’ সেই স্বপ্ন তাঁর পূরণ হল ইডেনেই।
বাংলার পেসারকে স্টাম্পের পিছনে দাঁড়িয়ে সামলাচ্ছেন বঙ্গ উইকেটকিপার। তাঁদের দিকে তাকিয়ে গোটা দেশ। ইডেনের বুকে এমন ঘটনা বিরল। পুরনো দস্তাবেজ ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, স্বাধীনতার দু’বছর পর জানুয়ারিতে এই ইডেনেই উইকেটকিপার খোকন সেন ও মন্টু বন্দ্যোপাধ্যায় টেস্টে একসঙ্গে নেমেছিলেন। পঙ্কজ রায়ের সঙ্গে সেই খোকন সেনকেই ইডেন টেস্টে দেখা গিয়েছিল তার তিন বছর পর। ৬৪ বছর পর ফের টেস্টে বাংলার দুই ক্রিকেটারকে একসঙ্গে দেখতে অবশ্য উপচে পড়ল না ইডেন গ্যালারি। বেশিরভাগটাই খালি।
ঋদ্ধিমানের মারা গোটা সাতেক চার ও একজোড়া ছয়ের পর বারবার বেজে ওঠা সমবেত ঢাকের আওয়াজ যেন বলে দিচ্ছিল এটা শহরকে দেওয়া তাঁর পুজোর উপহার।
আড়াইশোতম টেস্টে আড়াইশোয় অল আউট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে যে ভাবে ক্রমশ দলকে বার করে আনলেন ঋদ্ধি, এর পর আর তাঁর ব্যাটিং দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে কে?
তাঁর জন্য কড়া ফিল্ডিং সাজিয়েছিলেন টেলর। ম্যাট হেনরির বল সোজা গিয়ে লাগে তাঁর বাঁ হাতে। তা সত্ত্বেও দমানো যায়নি সিংহহৃদয় বঙ্গসন্তানকে। স্যান্টনারকে লং-অফের উপর দিয়ে সোজা গ্যালারিতে পাঠিয়ে নিজের হাফ সেঞ্চুরি আর ভারতের তিনশো পূর্ণ করেন তিনি। ক্লাব হাউসে বসে তাঁর এই কীর্তি দেখার পর নতুন নির্বাচক প্রধান এমএসকে প্রসাদ তো বলেই দিলেন, ‘‘আমার তো মনে হয় সাহাই এখন টেস্টে বিশ্বের এক নম্বর কিপার। ব্যাটিংয়েও যে ও দ্রুত উন্নতি করেছে, তা গ্রস আইলেটের সেঞ্চুরিতেই প্রমাণ করেছিল। এখানেও আর একবার করল। তবে টেস্ট দলে আমরা সেরা কিপারকেই চাই। সে যেমনই ব্যাটিং করুক। কিপিং টেকনিকে ও এখন বিশ্বে সেরা।’’
শনিবাসরীয় দুপুরের বৃষ্টিতে স্যাঁতসেঁতে হয়ে ওঠা আবহাওয়াকে কাজে লাগিয়ে ভুবনেশ্বর কুমার যে ভাবে আক্রমণ করলেন বিপক্ষ শিবিরে, তার জবাব নেই। যেমন নিখুঁত লাইন ও লেংথ, তেমনই সুইং। যে বলটাতে আউট হলেন টেলর, তাতে কোনও ফুটওয়ার্কের সুযোগই পাননি তিনি। ওটাই যে পাঁচের সেরা, তা নিজেই এ দিন জানিয়ে দিলেন ২৬-এর পেসার।
টসের পরই বিরাট জানিয়েছিলেন, ‘‘বেশ হার্ড উইকেট, ঘাসের কভার আছে। শুরুর দিকের ওভারগুলো গুরুত্বপূর্ণ হবে। তাই ভুবি।’’ তাঁর সেই সিদ্ধান্তটার জন্য এখন যেমন নিজের পিঠ চাপড়াতে পারেন, তেমনই কিন্তু ইডেন-পিচ ন্যাড়া করে দিতে বলার ভুলও স্বীকার করে নিতে পারেন।
এর পরের টেস্টগুলোতেও কি ঘূর্ণির বায়নাই দেবেন ক্যাপ্টেন?
ভারত: (প্রথম দিন ২৩৯-৭), ঋদ্ধিমান ন.আ. ৫৪, জাডেজা ক হেনরি বো ওয়্যাগনার ১৪, ভুবনেশ্বর এলবিডব্লিউ স্যান্টনার ৫, শামি ক হেনরি বো বোল্ট ১৪,অতিরিক্ত ১৮, মোট ৩১৬, পতন ১-২৮-৪৬-১৮৭-১৯৩-২০০-২৩১-২৭২-২৮১-৩১৬। বোলিং: বোল্ট ২০.৫-৯-৪৬-২, হেনরি ২০-৬-৪৬-৩, ওয়্যাগনার ২০-৫-৫৭-২, স্যান্টনার ২৩-৫-৮৩-১, পটেল ২১-৩-৬৬-২।
নিউজিল্যান্ড: গাপ্টিল বো ভুবনেশ্বর ১৩, ল্যাথাম এলবিডব্লিউ শামি ১, নিকোলস বো ভুবনেশ্বর ১, টেলর ক বিজয় বো ভুবনেশ্বর ৩৬, রঙ্কি এলবিডব্লিউ জাডেজা ৩৫, স্যান্টনার এলবিডব্লিউ ভুবনেশ্বর ১১, ওয়াটলিং ন.আ. ১২, হেনরি বো ভুবনেশ্বর ০, পটেল ন.আ. ৫, অতিরিক্ত ১৪, মোট ১২৮-৭, পতন ১০-১৮-২৩-৮৫-১০৪-১২২-১২২। বোলিং: ভুবনেশ্বর ১০-০-৩৩-৫, শামি ১১-০-৪৬-১, জাডেজা ৮-৩-১৭-১, অশ্বিন ৫-২-২৩-০।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy