Advertisement
E-Paper

ফুটবল জীবন হয়ে ওঠার মাঠে বৃদ্ধের নাচ থেকে প্রেম-চুম্বন

স্বপ্ন যেখানে ঘাসের বুকে লেখা থাকে। ঈশ্বর যেখানে যন্ত্রণা পান, কাঁদেন। আবার হাসেন। আমি সেই বার্সেলোনা। স্বপ্নের শরীরী রূপ দেখা যায় এখানে। ওই যে— ছেলেটা ঘাসের উপর বসে দু’হাত উঁচু করে হুঙ্কার দিচ্ছে। ওই যে— ক্রপ করা চুলের রোগাপাতলা তরুণ দৌড়ে আসছে।

কৌশিক দাশ

শেষ আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০১৬ ০৪:২১
বার্সেলোনা ট্রফি ক্যাবিনেটের এক টুকরো।

বার্সেলোনা ট্রফি ক্যাবিনেটের এক টুকরো।

স্বপ্ন যেখানে ঘাসের বুকে লেখা থাকে। ঈশ্বর যেখানে যন্ত্রণা পান, কাঁদেন। আবার হাসেন।

আমি সেই বার্সেলোনা।

স্বপ্নের শরীরী রূপ দেখা যায় এখানে। ওই যে— ছেলেটা ঘাসের উপর বসে দু’হাত উঁচু করে হুঙ্কার দিচ্ছে। ওই যে— ক্রপ করা চুলের রোগাপাতলা তরুণ দৌড়ে আসছে। ওই যে— দশ নম্বর জার্সি পরা আর্জেন্তাইন ছুটে এসে আদর করে দিচ্ছে এক ব্রাজিলিয়ানকে। এদের কারও নাম রাফিনহা, কারও নেইমার দ্য সিলভা। আর কারও নাম আবার লিওনেল মেসি। এরা তো স্বপ্নেরই জীবন্ত রূপ। যে স্বপ্ন তিলতিল করে গড়ে উঠেছে এখানে।

আমি সেই বার্সেলোনা।

এখানে মাঠে নামার আগে থেকেই ম্যাচ শুরু হয়ে যায়। এখানে রেফারির হুইসল বাজার আগেই স্কোরলাইন হয়ে যায় বার্সা-১ : বিপক্ষ-০। যখন একটা দল ঢোকে ভিজিটার্স লকার-রুমে, আর একটা হোম লকার-রুমে।

ভিজিটার্স লকার-রুম থেকে বেরিয়ে কোনও ফুটবলার যদি এক বার বার্সা ড্রেসিংরুমের দিকে যায়, ধাক্কাটা তখনই খাবে। এ কোথায় এসে পড়লাম আমি? এ কি লকার-রুম, না মিনি স্টেডিয়াম? বি-শা-ল যে জায়গাটায় ম্যাচ শুরুর আগে মেসি-মেইমার-সুয়ারেজ-ইনিয়েস্তারা নিজেদের তৈরি করেন, সেটাকে লকার-রুম বলে কোন মূর্খ! এখানে সুইমিং পুল আছে, ছোট একটা মাঠ আছে, জিম আছে। কোচেদের স্ট্র্যাটেজি বোঝানোর জন্য তিনটে আলাদা ঘরই আছে। আছে সম্পূর্ণ লাল রঙের গনগনে তেজ। যা বিপক্ষকে ঝলসে দেবে।

প্রতিপক্ষ সেই ফুটবলার যখন নিজের লকার-রুমে ঢুকবে, দেখবে একটা সাদা রঙের ম্যাড়ম্যাড়ে ঘর। যেখানে দ্রষ্টব্য বলতে একটা জাকুজি। এ দিক ও দিক ছড়িয়ে আছে গোটা দুই হোয়াইটবোর্ড। ওই যদি কোচ মাঠে নামার আগে কিছু বোঝানোর চেষ্টা-টেষ্টা করেন আর কী! এখানে পা রাখা মাত্র বিপক্ষ বুঝে যাবে, কী বার্তা দেওয়া হচ্ছে তাদের উদ্দেশে— তোমরা আমাদের অতিথি হতে পারো, কিন্তু মনে রাখবে আমরাই ঈশ্বর। তোমরা আসবে, দেখবে আর মাথা নিচু করে চলে যাবে। আমরা এখানে জিততে এসেছি। যে কোনও মূল্যে। অতিথি সৎকার করতে নয়।

আমি সেই বার্সেলোনা।

এখানে টানেল দিয়ে ফুটবলাররা মাঠে নামার সময় বাজতে থাকে রক্ত গরম করা বার্সা অ্যান্থেম। এখানে দু’পা হাঁটলেই দেখা যায় সারি সারি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ট্রফি। দেখা যায় মেসির পাঁচটা ব্যালন ডি’অর আর সোনার বুট। এখানে ড্রেসিংরুম থেকে নীচে নামার সময় ডান দিকে তাকালে চোখে পড়ে একটা মূর্তি। পেট্রন সেন্ট অব কাতালুনিয়া। যার সামনে কোনও কোনও ফুটবলার থমকে যান। অস্ফুটে সেরে নেন প্রার্থনা। তার পরে ঝাঁপিয়ে পড়েন স্বপ্নটা সত্যি করার যুদ্ধে।

যেখানে জীবন্ত গ্যালারি সারাক্ষণ গেয়ে যায় যুদ্ধের গান। যেখানে ম্যাচ ঠিক ১৭ মিনিট ১৪ সেকেন্ড গড়়ালে গ্যালারির একটা অংশ দাঁড়িয়ে উঠে গর্জন করে, ‘‘স্বাধীনতা চাই স্বাধীনতা।’’ ১৭১৪ সালেই যে কাতালান চলে গিয়েছিল স্প্যানিশ সাম্রাজ্যের গ্রাসে। যে যন্ত্রণা আজও ভুলতে পারে না এখানকার মানুষ। যে যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ ঘটে কাম্প ন্যু-তে। ফুটবল আর এখানে ফুটবল থাকে না। জীবন হয়ে দাঁড়ায়।

আমি সেই বার্সেলোনা।

যেখানে কোনও এক লিওনেল মেসি বল ধরে এগোতে থাকলে গ্যালারি ছাড়ুন, প্রেসবক্সও দাঁড়িয়ে পড়ে। যেখানে কোনও এক লুইস সুয়ারেজ ছ’গজের মধ্যে থেকে গোলকিপারের হাতে বলটা তুলে দিলে স্টেডিয়াম জুড়ে ছেয়ে যায় সন্তানবিয়োগের ব্যথা। যেখানে নেইমার নামে এক ব্রাজিলীয় তরুণ বিপক্ষের সঙ্গে তর্কাতর্কিতে জড়িয়ে পড়ে হলুদ কার্ড দেখলে রেফারিকে চ্যালেঞ্জ করে বসে গ্যালারি। যেখানে লা লিগা প্রেসিডেন্টকে লাল কার্ড দেখায় জনতা। দোষের মধ্যে সেই প্রেসিডেন্ট ক্লাব সম্পর্কে কড়া কড়া কয়েকটা মন্তব্য করেছিলেন দিন কয়েক আগে লিগের পুরস্কার অনুষ্ঠানে বার্সা ফুটবলারদের না থাকা নিয়ে।

আর কেউ গোল করে দিলে?

গ্রানাডা ম্যাচের প্রথম হাফটা গোলশূন্য ছিল। সেকেন্ড হাফের মিনিট তিনেক গড়াতে না গড়াতে বলটা ধরে ডান দিক থেকে উঠতে শুরু করলেন মেসি। একটা ছোট্ট পাস চলে এল সুয়ারেজের সামনে। সুয়ারেজ ধরতে পারলেন না বা ছেড়ে দিলেন। বক্সের মধ্যে থেকে রাফিনহা বলটা নিয়ে ঠেলে দিলেন বাঁ দিকে থাকা নেইমারকে। ব্রাজিলিয়ানের শট গোলকিপারকে হার মানাল ঠিকই, কিন্তু পোস্টকে নয়। আর্তনাদটা যখন উঠছে গ্যালারিতে, গোলের দিকে পিছন ফিরে রাফিনহা। ওই অবস্থায় শরীরটা শূন্যে উঠল। বাঁ পায়ের ব্যাকভলিটা কানেক্ট হল নিখুঁত ভাবে।

দু’বছর আগে বিশ্বকাপে ব্রাজিলকে নাজেহাল করে দিয়েছিলেন শনিবার রাতের গ্রানাডা গোলকিপার। গোটা ছয়েক সেভ করে কেড়ে নিয়েছিলেন ব্রাজিলের একটা পয়েন্ট। কিন্তু এ দিন বছর তেইশের ব্রাজিলিয়ান যে ভলিটা নিয়েছিলেন, সেটা আটকানোর ক্ষমতা মেক্সিকোর ফ্রান্সিসকো ওচোয়ার ছিল না।

তার পরেই সেই উৎসব। যেখানে অথর্ব বৃদ্ধ হুইলচেয়ার থেকে উঠে পড়ার চেষ্টা করছেন। যেখানে নিষ্পাপ শিশু কিছু না বুঝেই হাসতে শুরু করে দিয়েছে। যেখানে প্রেমিক জড়িয়ে ধরেছে প্রেমিকাকে, চলছে চুম্বন পর্ব।

আমি যে স্বপ্নেরই আর এক নাম। আমি যে বার্সেলোনা!

ছবি কৌশিক দাশ ও রয়টার্স

দেখুন এফ সি বার্সেলোনার অন্দরমহল...

FC Barcelona La Masia academy
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy