Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
Roger Federer

টেনিসের হ্যারি পটার

কয়েক মাস আগে এক সাক্ষাৎকারে আপনি নিজেই আশঙ্কার কথা শুনিয়েছিলেন। হাঁটুর চোটে আর বোধ হয় ফেরা হল না! কিন্তু কে ভাবতে পেরেছিল, নিষ্ঠুর অপারেশন থিয়েটার চিরতরে কেড়ে নেবে র‌্যাকেট!

বিশ্বকে বিষণ্ণ করে অবসর ঘোষণা ফেডেরারের।

বিশ্বকে বিষণ্ণ করে অবসর ঘোষণা ফেডেরারের।

সুমিত ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৬:৪২
Share: Save:

রজার ফেডেরার, আর তা হলে টেনিস র‌্যাকেট হাতে দেখা যাবে না আপনাকে? লেভার কাপে নামবেন ঠিকই, কিন্তু তা নিয়ে কার কী আগ্রহ! আর কখনও উইম্বলডনের সবুজ ঘাসে তো দেখা যাবে না আপনার ব্যালে!

আর কখনও দেখব না কোনও ভক্তের তুলে ধরা পোস্টার, ‘‘কোয়ায়েট প্লিজ়, জিনিয়াস অ্যাট ওয়ার্ক!’’

আপনাকে কোর্টে শেষ কবে দেখেছিলাম, রজার? আবছা মনে করতে পারছি। কে-ই বা মনে রাখতে চেয়েছিল ওই দৃশ্য? ৩-৬, ৬-৭, ০-৬ হারের ধাক্কায় ক্ষতবিক্ষত আপনি কোর্ট ছাড়ছেন। তা-ও কি না উইম্বলডনে! যেখানে পিট সাম্প্রাসের মতো কিংবদন্তির বিজয়রথ থামিয়ে ১৯ বছরের পনিটেল কিশোরের উত্থান। তার পর টেনিস দুনিয়া দেখবে দুর্ধর্ষ এক যাত্রা। রাজকীয় রজারের যাত্রা।

আপনার অবসর ঘোষণায় উইম্বলডন চোখের জল ফেলছে, দেখতে পাচ্ছেন রজার? টুইটারে উইম্বলডন কর্তৃপক্ষ লিখেছে, ‘ওহ্ রজার! কোথা থেকে শুরু করব! তোমার এই রাজকীয় যাত্রা দেখতে পেয়ে আমরা গর্বিত। কিশোর থেকে চ্যাম্পিয়ন হয়ে ওঠার প্রত্যক্ষদর্শী হতে পেরে আমরা সম্মানিত।’’ কে বলল, টেনিস কোর্টের প্রাণ হয় না! আজ সে-ও তো ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

কয়েক মাস আগে এক সাক্ষাৎকারে আপনি নিজেই আশঙ্কার কথা শুনিয়েছিলেন। হাঁটুর চোটে আর বোধ হয় ফেরা হল না! কিন্তু কে ভাবতে পেরেছিল, নিষ্ঠুর অপারেশন থিয়েটার চিরতরে কেড়ে নেবে র‌্যাকেট! চিরকালের জন্য থামিয়ে দেবে নেটের কাছে সেই হরিণের মতো ছুটে আসা। স্তব্ধ করে দেবে সেই রাজকীয় ফোরহ্যান্ড। সত্যিই আর ফিরবেন না, রজার ফেডেরার? সত্যিই?

ওই সাক্ষাৎকারের একটি মন্তব্য চোখে জল এনে দেওয়ার মতো। যেখানে আপনি বলেছিলেন, শুধু টেনিস কোর্টে প্রত্যাবর্তনের জন্যই নয়, স্বাভাবিক জীবন চালানোর জন্যও আপনাকে হাঁটুর সঙ্গে এই লড়াই জিততে হবে। যদি কখনও ছেলেমেয়েরা বায়না ধরে, বাবা চলো টেনিস খেলব! যদি স্ত্রী মিরকার সঙ্গে সান্ধ্য জগিংয়ে যেতে হয়। যদি আচমকা বাড়িতে কোনও বিপদ ছুটে আসে আর গৃহকর্তাকে দৌড়ে গিয়ে পরিবারকে উদ্ধার করতে হয়! অকেজো হাঁটু নিয়ে বসে থাকার উপায় কোথায়! টেনিস ছিল আপনার জীবন, আজ টেনিস হারল, জীবন জিতল!

টেনিস দুনিয়ায় অনেক মহাতারকাই আছেন। যোদ্ধা নাদাল। গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয়ের তালিকায় এখন শীর্ষে। কে ভুলতে পারবে উইম্বলডনে রজার বনাম রাফার সেই মহাকাব্যিক ম্যাচ? তার পরে মেশিন নোভাক জোকোভিচ। ২০১৯-এর উইম্বলডনে যাঁর সঙ্গে ফাইনাল আর একটা স্মরণীয় লড়াই। ম্যারাথন টাইব্রেকারের পরে আপনি হারলেন। কে বলবে, তখন আপনার বয়স ৩৮! গ্র্যান্ড স্ল্যামের সংখ্যায় মহাত্রয়ীর মধ্যে আপনি তৃতীয়। কিন্তু জনতার ভোটে এক নম্বর কে, বলার জন্য কোনও কোনও পুরস্কার নেই। যদি কারও সংশয় থাকে, স্মরণ করিয়ে দেওয়া যাক জিমি কোনর্সের মন্তব্য— ‘‘আধুনিক যুগে হয় তুমি গ্রাস কোর্ট খেলোয়াড়, নয় তুমি হার্ড কোর্ট খেলোয়াড়, নয়তো ক্লে কোর্ট খেলোয়াড়, আর নয়তো তুমি রজার ফেডেরার!’’

রজার ফেডেরার, আপনি টেনিসের হ্যারি-পটার। যাঁর ফোরহ্যান্ড শট দেখে মনে হত, র‌্যাকেটটা যেন ডায়াগন অ্যালির অলিভ্যান্ডার্স থেকে তৈরি করা। যে দোকান থেকে হ্যারি জাদুদণ্ড কিনেছিলেন। যাঁর টেনিস দেখতে দেখতে মনে হত, পূর্বজন্মে নিশ্চয়ই লিয়োনার্দো দা ভিঞ্চি ছিলেন। টেনিস কোথায়, এ তো শিল্পীর অমর সৃষ্টি!

রগচটা যুবক থেকে যে ভাবে নিজেকে সর্বসেরা চ্যাম্পিয়নে উন্নীত করেছেন, তা সব খেলার সকলের জন্যই উদাহরণ। পরবর্তীকালে কোর্টের মধ্যে আপনার শান্ত, স্থিতধী চলাফেরা দেখে কে বলবে, এক সময়ে বারবার মেজাজ হারিয়ে কোর্টের মধ্যে র‌্যাকেট ভাঙতেন। শোনা যায়, গাড়ি দুর্ঘটনায় কোচ এবং প্রিয় বন্ধু পিটার কার্টারের মর্মান্তিক মৃত্যু পাল্টে দেয় আপনাকে। প্রিয়জনকে হারিয়ে বল্গাহীন থেকে বন্দিত হয়ে ওঠার সংকল্প নেন আপনি।

যে সংকল্প বারবার খাদের কিনার থেকে ফিরিয়ে এনেছে আপনাকে। মাটিতে আছড়ে পড়ার পরেও টেনে তুলেছে। আর একটা ব্যাপার। ট্রফি জয় থেমে গেলেও কখনও রণক্ষেত্র ছেড়ে না যাওয়া। দুনিয়াজুড়ে প্রশ্ন উঠেছে লোকটা কেন যে এখনও কোর্টে পড়ে রয়েছে! তবু পড়ে থেকেছেন। চিরবন্দিত চ্যাম্পিয়ন হয়েও অন্যদের হাতে ট্রফি ওঠার যন্ত্রণা সহ্য করেছেন। তবু রণক্ষেত্র ছেড়ে যাননি।

বিয়র্ন বর্গ মাত্র ২৬ বছর বয়সে টেনিস সন্ন্যাস নিয়ে ফেলেছিলেন। ১৯৮৩-তে সেই সময় টেনিসজীবনের মাঝআকাশে উজ্জ্বল সূর্য বর্গ। কিন্তু প্রত্যাশার চাপে হাসফাঁস করে ওঠা জীবন, সারাক্ষণ জন ম্যাকেনরোর সঙ্গে দ্বৈরথ নিয়ে জনতার অনুবীক্ষণ যন্ত্রের নীচে পড়ে থাকা সাফল্যের কয়েদি করে তুলেছিল তাঁকে। বর্গ তাই ঠিক করেন, অনেক হয়েছে, তারকার বন্দিজীবন। মুক্ত বিহঙ্গ হয়ে ঘুরব আর জীবনকে উপভোগ করব। আপনি চাইলে বর্গের রাস্তায় হাঁটতেই পারতেন। হাঁটেননি।

সাল ২০১২। অ্যান্ডি মারে এবং ব্রিটেনের স্বপ্ন চুরমার করে উইম্বলডনে আপনি সপ্তম খেতাব জিতলেন। কে ভুলতে পারবে মারের কান্না আর আপনার ভুবনভোলানো হাসি। সে দিন ঘরের কোর্টে দাঁড়িয়ে মারে নিশ্চয়ই মার্ক টোয়েনের মতো বলে উঠেছিলেন, ‘‘শীতলতম দিন আমি দেখেছি লন্ডনের এক গ্রীষ্মে!’’ ওই উইম্বলডন স্মরণীয় হয়ে থাকবে টেনিস ইতিহাসে অন্য কারণে।

ফ্রেড পেরির পরে ৭৫ বছর ধরে অপেক্ষায় থাকা ব্রিটেন ফের নিজেদের চ্যাম্পিয়ন পাচ্ছিল। মারের হারে স্বপ্নভঙ্গ। তবু উইম্বলডন সে দিন উঠে দাঁড়িয়ে হাততালিতে ভরিয়ে দিচ্ছিল চ্যাম্পিয়নকে! রজার ফেডেরার, আপনি যে বিশ্ব-নায়ক। আপনার মতো তারকার কোনও লাইন অব কন্ট্রোল হয় না! উইম্বলডনে সেই ১৭তম গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতার পরে সব নিস্তব্ধ। ট্রফিহীন থাকলেন প্রায় পাঁচ বছর। দুনিয়া বলল, ফেডেরার শেষ। আর কখনও জিতবে না। কেন পড়ে আছে?

ওঁরা ভুলে গিয়েছিলেন, ফর্ম সাময়িক, উৎকর্ষ চিরন্তন। আপনি ফিরলেন। সেই চলমান পদ্য হয়েই ফিরলেন। ৩৫ বছর বয়সে অস্ট্রেলীয় ওপেন জিতলেন। তার পরে উইম্বলডন। তার পরে আবার অস্ট্রেলীয় ওপেন। পৃথিবীজুড়ে আবার সেই জয়ধ্বনি। রজার, রজার, রজার! প্রমাণ করে দিলেন, রজার ফেডেরারদের শোকগাথা অন্যরা লেখে না। তাঁরা নিজেরা লিখবেন। প্রমাণ করে দিয়েছেন, বয়স একটা সংখ্যা মাত্র। আপনি যে প্রিয় উইম্বলডনের রঙের মতোই ছিলেন চিরসবুজ। আর আপনার টেনিস দেখতে দেখতে আমরাও যে বারবার বয়সকে হারিয়ে সবুজ হয়ে যেতাম। তরুণ হয়ে যেতাম!

ফিরে আসুন না রজার ফেডেরার! আমাদের আবার সবুজ করে দিয়ে যান! সম্মোহিত করে দিয়ে যান!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Roger Federer Tennis Wimbledon
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE