Advertisement
E-Paper

‘কপিল দেব কিংবদন্তি, আমি থাকি হার্দিকই’

বডোদরার এক দরিদ্র পরিবার থেকে ভারতীয় ক্রিকেটের নতুন পোস্টার বয় হয়ে ওঠা। শুধু ক্রিকেট কেন, তাঁর জীবনকাহিনি প্রেরণা হয়ে উঠতে পারে যে কোনও জগতের কর্মী বা পেশাদারের জন্য। অমরনাথ বা পাঠান ভাইদের মতো এখন আলোচনায় তাঁরা— পাণ্ড্য ভাইরা। শিরোনামে বেশি করে ছোট ভাই। এর মধ্যেই আবার জল্পনা শুরু হয়েছে, শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজে না-ও খেলতে পারেন তিনি। বিশ্রাম নিলে দেখা যাবে না কলকাতার প্রথম টেস্টে। দু’একদিনের মধ্যে হয়তো পাকাপাকি ভাবে জানা যাবে। নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়ের পরের দিন আনন্দবাজার-কে মোবাইল ফোনে দীর্ঘ, একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন হার্দিক পাণ্ড্য। আজ প্রথম কিস্তি।অমরনাথ বা পাঠান ভাইদের মতো এখন আলোচনায় তাঁরা— পাণ্ড্য ভাইরা। শিরোনামে বেশি করে ছোট ভাই। এর মধ্যেই আবার জল্পনা শুরু হয়েছে, শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজে না-ও খেলতে পারেন তিনি।

সুমিত ঘোষ

শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০১৭ ০৪:২২
আগ্রাসী: ভারতীয় দলের অন্যতম প্রধান ভরসা হয়ে উঠেছেন হার্দিক পাণ্ড্য। ফাইল চিত্র

আগ্রাসী: ভারতীয় দলের অন্যতম প্রধান ভরসা হয়ে উঠেছেন হার্দিক পাণ্ড্য। ফাইল চিত্র

প্রশ্ন: বাবার হাত ধরে কিরণ মোরের অ্যাকাডেমিতে ভর্তির দিন আর আজ ভারতীয় ক্রিকেটের নতুন তারা। এই ক্রিকেট যাত্রাটার দিকে ফিরে তাকালে কী মনে হয়?

হার্দিক পাণ্ড্য: আমার জন্য জীবনটা পাল্টেছে খুব তাড়াতাড়ি। শুরুর সেই দিন আর এখনকার জীবনে অনেক তফাত। শুরুর দিকে অনেক কষ্ট সহ্য করে এগোতে হয়েছে। নিশ্চয়ই জানেন, সবচেয়ে বেশি সংগ্রাম করতে হয়েছে আর্থিক অবস্থার সঙ্গে। একটা সময় ছিল যখন ঠিক মতো ক্রিকেটের সরঞ্জাম কেনার পয়সাও ছিল না। সেখান থেকে আজকের এই সচ্ছলতার জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকাটা সত্যিই স্বপ্নের মতো মনে হয় মাঝেমধ্যে। তবে একটা কথা আমার মাথায় সব সময় থাকে যে, ক্রিকেটার হিসেবে ভাল করতে পেরেছি বলেই এই স্বাচ্ছন্দ্যের পৃথিবীতে জায়গা করতে পেরেছি।

প্র: ফিরে তাকালে নিশ্চয়ই একটা আত্মতৃপ্তি তৈরি হয় যে, আহা! প্রতিকূলতাকে হারিয়ে জিতেছি!

হার্দিক: একেবারেই আত্মতৃপ্তি ঢুকতে দিই না। আমি কখনও তৃপ্ত হই না, জানেন তো? আমি একটা ছেলে যে কি না সহজে সন্তুষ্ট হতেই জানে না। আমার একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে, ভাল করে যাওয়া এবং আরও ভাল করার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। কিন্তু হ্যাঁ, ভাল লাগে এটা ভেবে যে, লড়াইটা করতে পেরেছি এবং কঠিন পথ পেরিয়ে এই জায়গায় আসতে পেরেছি। কিন্তু শেষে গিয়ে সব সময়ই বলব, আরও অনেক দূর যাওয়া বাকি।

প্র: হার্দিক, আপনার প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করার নানা কাহিনি শুনেছি। একটু যাচাই করে নিতে চাই। ছোটবেলায় ক্রিকেটার হিসেবে খাদ্য বলতে আপনার জুটত নুড্লস। আর এখন যে ছেলে ছক্কা মারতে ওস্তাদ, তার নিজের কোনও ব্যাট ছিল না। ধার করা ব্যাটে খেলতে হতো। ঠিক?

হার্দিক: দু’টোই একদম ঠিক শুনেছেন। আমি আর আমার দাদা ক্রুনাল পাণ্ড্য নুড্‌লস খেতাম খুব। ওটাই আমাদের প্রধান খাদ্য হয়ে গিয়েছিল। অনেক দিন পর্যন্ত নিজের ব্যাটও ছিল না আমার। ব্যাট ধার দিয়ে আমাকে খুব সাহায্য করেছে ইরফান পাঠান। আমার সঙ্গে খুব ভাল সম্পর্ক ছিল। আমি ইরফান ভাইকে একবার বলি যে, আমার ব্যাট নেই। একটা ব্যাট দেবে আমাকে? ইরফান ভাই দিয়েছিল আমাকে ব্যাট। সেটা দিয়ে অনেক দিন খেলেছি।

প্র: এখন সেই ছেলের ব্যাগেই প্রচুর ব্যাট থাকে?

হার্দিক: ইয়েস। অনেক ব্যাট থাকে আমার ব্যাগে। এখন আমি যত না ধার নিই, তার চেয়ে বেশি ব্যাট অন্যদের ধার দিই (হাসি)।

প্র: কিন্তু এই যে ব্যাট বদলের মতোই জীবন পাল্টে যাওয়া— এটা আপনাকে কী শিখিয়েছে?

হার্দিক: সবচেয়ে মূল্যবান শিক্ষা হচ্ছে, কঠিন পরিস্থিতির সামনে পড়ে অভিযোগ বা অনুযোগ না করে বুক চিতিয়ে লড়াইটা লড়তে থাকো। অভিযোগ করাটা নেতিবাচক, কাপুরুষের ভঙ্গি। আমি কখনও প্রশ্ন করতাম না যে, আমরা কেন গরিব! সেই সময়কার জীবনটাকে বাস্তব ধরে নিয়ে হার্ডলগুলো পেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতাম। আমি খুশি যে, সেই হার্ডলগুলো টপকে যেতে পেরেছি। আর সেটা সম্ভব হয়েছে পরিশ্রম আর পরিবারের সমর্থনের জন্য।

আরও পড়ুন: ঘরবন্দি না থেকে মাঠে নামুন: বিরাট

প্র: এই সংগ্রামগুলোই কি হার্দিক পাণ্ড্যকে তৈরি করেছে? মাঠে যে হার না মানা অলরাউন্ডারকে আমরা দেখি, সে কি এই লড়াইয়ের ফসল?

হার্দিক: একেবারেই তাই। আমি বিশ্বাস করি, এখন যে ক্রিকেট মঞ্চে সর্বোচ্চ পর্যায়ের চ্যালেঞ্জগুলো নিতে পারছি, সেটার জন্য আমাকে তৈরি করে দিয়েছে জীবনের রাস্তায় মোকাবিলা করা ঝড়-ঝাপ্টাগুলো। জীবনযুদ্ধের সেই দিনগুলো থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি।

প্র: আপনার অধিনায়ক বিরাট কোহালি শ্রীলঙ্কায় বললেন, বেন স্টোকসের সমকক্ষ হয়ে ওঠার মতো দক্ষতা আপনার আছে। কপিল দেবের মতো কিংবদন্তির সঙ্গেও তুলনা শুরু হয়ে গিয়েছে। এমনকী, ইয়ান চ্যাপেলের মতো ব্যক্তিত্বও বলেছেন। এ সব শুনলে কী প্রতিক্রিয়া হয়?

হার্দিক: শুনে একদম মুগ্ধ হয়ে যাই। দারুণ লাগে যখন দেখি, বড় বড় সব নামের পাশে আমাকে বসানো হচ্ছে। এটা তো দারুণ গর্বের একটা মুহূর্ত। কিন্তু সত্যি কথা বলছি আপনাকে— মনের গভীরে আমি চাই হার্দিক পাণ্ড্য থাকুক হার্দিক পাণ্ড্য-ই। কারও মতো হোক চাই না।

প্র: এমন ভাবনার কারণ কী?

হার্দিক: ক্রিকেটের বিরাট সব ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তুলনা হলে, সেটা নিশ্চয়ই বড় একটা প্রাপ্তি। সেটা শুনতে কার না ভাল লাগে! ক্যাপ্টেন পর্যন্ত বলছে! ভাল তো লাগবেই। কিন্তু তুলনা করাটা বোধ হয় কঠিন। কপিল দেব একেবারে অন্য সময়ে ক্রিকেট খেলেছেন। তাঁর দক্ষতা বা পারফরম্যান্সকে আজকের বিচারে মাপবেন কী করে? সেই সময় খেলাটাই তো সম্পূর্ণ অন্য রকম ছিল। কপিল দেব তাঁর সময়ে যে কীর্তিগুলো অর্জন করেছেন, সেগুলো সেই সময়ের বিচারে কেমন ছিল, সেটা দেখতে হবে তো। আজকের যুগের এক জনের সঙ্গে তুলনা করলে তাঁর কৃতিত্বকে ছিনিয়ে নেওয়াই হবে। সেটা হোক আমি চাই না। আমি তাই বলছি, আমি হার্দিক পাণ্ড্য-ই থাকি। আর কপিল দেব থাকুন কিংবদন্তি। আর বিরাট কোহালি কিন্তু আমার সঙ্গে বেন স্টোকসের তুলনা করেনি। ক্যাপ্টেন শুধু বলেছিল, স্টোকসের মতো হওয়ার ক্ষমতা আছে আমার। এটা কিন্তু তুলনা নয়।

প্র: আপনার প্রিয় ক্রিকেটার কে? যাঁর মতো হওয়ার স্বপ্ন দেখেছেন?

হার্দিক: সেভাবে কোনও একজনকে নায়ক হিসেবে বেছে নিইনি কখনও। আমি খেলাটা উপভোগ করতে চেয়েছি। নির্দিষ্ট কারও পথ অনুসরণ করার চেয়ে খেলাটার প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়েছি। ক্রিকেট খেলাটার টেনশন, মোচড়, বাঁক, নাটকীয়তা— এগুলো বেশি টেনেছে আমাকে।

প্র: ক্রিকেটার হিসেবে এই যে উল্কার গতিতে উত্থান, সেটাকে কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন? ঘরোয়া ক্রিকেটও সেভাবে খেলেননি। আইপিএলে নজর কেড়ে খুব তাড়াতাড়িই হয়ে উঠলেন ভারতীয় দলের নতুন তারকা।

হার্দিক: আমি মোটেও কল্পনাপ্রবণ নই। তবু নিজের কেরিয়ারের কথা ভাবলে মাঝেমধ্যে কেমন কল্পকথাই মনে হয়। মাত্র দেড় বছরের মধ্যে সব কিছু কেমন দ্রতগতিতে ঘটে গেল! আমি আসলে খুব ভাগ্যবান যে, আশেপাশে সব সময় দারুণ সব লোককে পেয়েছি। আমার বাবার উৎসাহ, ছোটবেলার কোচ জিতু ভাই (বডোদরায় পাণ্ড্য ভাইদের ছোটবেলায় ক্রিকেট শেখাতেন জিতেন্দ্র সিংহ), কিরণ মোরে, আমার দাদা ক্রুনাল পাণ্ড্য (মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের অন্যতম তারকা ক্রিকেটার ক্রুনাল)। প্রত্যেকে সব সময় আমার পাশে থেকেছে। আমার জীবনে ওঁদের প্রভাবই সবচেয়ে বেশি। ওঁরা জানেন, আমি ক্রিকেট মাঠে কী করতে পারি। তার পর আন্তর্জাতিক মঞ্চে এসে পেলাম বিরাট আর ধোনি ভাইয়ের মতো ক্রিকেটারকে। অথবা রোহিত শর্মা। ওরা সব সময় আমাকে বলে দিতে প্রস্তুত, কোনটা ঠিক করছি, কোথায় ভুল হচ্ছে। নিজের চারপাশে অসাধারণ সব মানুষকে পাওয়াটা ভাগ্যের ব্যাপার।

প্র: ভারতীয় ক্রিকেটের নতুন পোস্টার বয় বলা হচ্ছে আপনাকে। তারকার জীবনের সঙ্গে কীভাবে মানিয়ে নিচ্ছেন?

হার্দিক: আমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারি যে, জীবনে পরিবর্তন এসেছে। খ্যাতি আসছে। অর্থ আসছে। প্রথম দিকে একটু অস্বস্তিতে থাকতাম। এখন অনেকটা সয়ে গিয়েছে। পাল্টে যাওয়া পৃথিবী সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা তৈরি হয়ে গিয়েছে। একটা কথা বলি, আমি কিন্তু নিজেকে সুপারস্টার মনে করি না। বরং আগের মতোই মানুষের সঙ্গে মিশতে ভালবাসি। রাস্তায় গিয়ে যদি দেখি, অনেক মানুষ আমার পাশে রয়েছেন, মনে হয় না ভিড়ে আটকে গেলাম। বরং খুব আনন্দ পাই দেখে যে, কত লোক আমাকে ভালবাসেন! সব ক্রিকেট খেলা দেশে এই উৎসাহটা দেখা যাবে না। এত মানুষের ভালবাসা ক’টা দেশের খেলোয়াড়দের ভাগ্যে জোটে! আমার তাই নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়, আশীর্বাদধন্য মনে হয়। আর একটা কথা আমি খুব মাথায় রাখি। মানুষের এই আগ্রহটা আমাকে নিয়ে তৈরি হয়েছে মাঠে আমার ক্রিকেট খেলা দেখে। আমার কাজ হচ্ছে, মাঠের সেই পারফরম্যান্সকে একই রকম উজ্জ্বল রেখে যাওয়া। একমাত্র তাহলেই ওঁরা আনন্দ পাবেন আমাকে দেখে। আর আমার জীবনেও আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হবে। (চলবে)

Hardik Pandya Interview Celebrity Interview Cricket Indian Cricket team হার্দিক পাণ্ড্য
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy