Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

শত কোটির প্রত্যাশাটা চাপ নয়, ছিল আশীর্বাদ

দেশ জুড়ে তাঁকে নিয়ে উন্মাদনার স্রোত। ছোট পরদা ছেড়ে এ বার যে তিনি বড় পরদায়। বুধবারেই ছিল ডকু-ড্রামার প্রিমিয়ার। তার আগে বিশেষ স্ক্রিনিং ভারতীয় দলের ক্রিকেটারদের জন্য।

চিরন্তন: সাফল্যে সংযত উৎসব। সচিনের সেই পরিচিত ছবি। ফাইল চিত্র

চিরন্তন: সাফল্যে সংযত উৎসব। সচিনের সেই পরিচিত ছবি। ফাইল চিত্র

সুমিত ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০১৭ ০৪:৫৩
Share: Save:

দেশ জুড়ে তাঁকে নিয়ে উন্মাদনার স্রোত। ছোট পরদা ছেড়ে এ বার যে তিনি বড় পরদায়। বুধবারেই ছিল ডকু-ড্রামার প্রিমিয়ার। তার আগে বিশেষ স্ক্রিনিং ভারতীয় দলের ক্রিকেটারদের জন্য। বিরাট-অনুষ্কা থেকে শুরু করে ভারতীয় দলের সবাই উপস্থিত। ‘সচিন, আ বিলিয়ন ড্রিমস’ মুক্তি পাচ্ছে শুক্রবার। যা নিয়ে আলোড়ন ক্রিকেটমহল থেকে বলিউড-সর্বত্র। আর ফিল্মের নায়ক শেষ মুহূর্তের প্রস্ততি মেটাতে ছুটে চলেছেন এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। চরম ব্যস্ততার মধ্যেই আনন্দবাজার-এর জন্য বুধবার দুপুরে আলাদা করে সময় বের করলেন তিনি। প্রিমিয়ারে যাওয়ার পথে গাড়ির মধ্যে থেকে সচিন তেন্ডুলকর একান্ত সাক্ষাৎকারে বলতে শুরু করলেন...

প্রশ্ন: আজ তো প্রিমিয়ার। বিরাট, যুবরাজ-সহ পুরো ভারতীয় দলও আসছে ফিল্ম দেখতে। খুব ব্যস্ত নিশ্চয়ই আপনি?

সচিন তেন্ডুলকর: সকাল থেকে দম ফেলার সময় নেই। ভীষণই ব্যস্ততা। প্রিমিয়ারের জন্য ছুটে বেড়াচ্ছি।

প্র: সচিন, অসংখ্য ধন্যবাদ আপনার সময়ের জন্য। জীবনে এত বড় ম্যাচ খেলেছেন। এত বড় বড় ম্যাচ জিতিয়েছেন। কখনও রাতে ঘুমোননি, কখনও সারা রাত জেগে হোটেল রুমে ব্যাট হাতে শ্যাডো করেছেন। এই নতুন ইনিংসটা খেলতে নামার আগে মনের মধ্যে কী চলছে?

সচিন: (হাসি) একেবারে অন্য রকম অনুভূতি। ক্রিকেট খেলার সময় শুধুই খেলাটার ওপর ফোকাস করতাম। আশেপাশে কী ঘটছে সে সবের দিকে কোনও খেয়াল করতাম না। আসলে খেয়াল করার সময়ও ছিল না। কিন্তু জীবনের অনেক নাটকীয় আর স্মরণীয় মুহূর্ত নিয়ে ফিরে দেখার সুযোগ করে দিয়েছে ফিল্মটা। ক্রিকেট খেলার সময় একটা স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে আর সেখানে পড়ে থাকার সুযোগ ছিল না। পরের লক্ষ্য বা পরের ম্যাচ নিয়ে ভাবনা শুরু হয়ে যেত। ফিল্মটা করতে গিয়ে পুরো জীবনটাই রিওয়াইন্ড করে দেখার মতো অভিজ্ঞতা হল।

প্র: ক্রিকেট খেলার দিনের সঙ্গে কি কোনও মিলই নেই?

সচিন: আছে। ক্রিকেটজীবনের মতোই আমি উত্তেজিত এই ‘ম্যাচ’টা নিয়ে। ক্রিকেট খেলার দিনগুলোতে যেমন প্রস্তুতির ওপর জোর দিয়েছি, ফিল্মের ক্ষেত্রেও তাই। চেষ্টা করেছি একশো শতাংশ দেওয়ার। চেষ্টা করা হয়েছে যতটা সম্ভব সত্যি ঘটনাকেই তুলে ধরার। সেই কারণেই বায়োপিক না করে ডকুমেন্টারি ঘরানার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

প্র: শুক্রবার রিলিজ। কী ভাবে বর্ণনা করবেন প্রাক-মুক্তি অনুভূতিকে?

সচিন: চব্বিশ বছর ধরে দেশের হয়ে ক্রিকেট খেলার সময় দর্শকরা আমাকে ছোট পরদাতেই দেখেছেন। আমি খেলতাম মাঠের মধ্যে। মাঠের জায়ান্ট স্ক্রিনেই শুধু নিজেকে দেখেছি এতদিন। কখনও ভাবিনি যে, সিনেমার মেগা স্ক্রিনেও আমাকে দেখা যাবে। তাই এই অনুভূতিটা একেবারে অন্য রকম।

প্র: এটাকে ‘ডকু-ড্রামা’ বলা হচ্ছে?

সচিন: হ্যাঁ। আমার জীবনের স্মরণীয় মুহূর্তগুলোর ফুটেজ থাকছে। আমার ক্রিকেটজীবনের সতীর্থ থেকে শুরু করে পরিবারের সদস্য— অনেকে আমাকে নিয়ে কথা বলেছে। এ সব ফুটেজ কখনও কেউ দেখেনি।

প্র: ‘সচিন— আ বিলিয়ন ড্রিমস’ ফিল্মের নাম। আপনি এই ‘বিলিয়ন ড্রিমস’-এর সীমাহীন প্রত্যাশার চাপ কী ভাবে সামলেছেন?

সচিন: একটা কথা বলছি আজ। কোটি কোটি মানুষের এই প্রত্যাশাটা আমার কাছে চাপ ছিল না, ছিল আশীর্বাদ। ভাবুন তো, এর উল্টো দিকটা। আমি মাঠে নামছি ব্যাট করতে আর দেশের মানুষের কোনও প্রত্যাশাই থাকল না আমাকে নিয়ে। মানে এ ব্যাট করলেই বা কী আউট হলেই বা কী, সফল হলেই বা কী, ব্যর্থ হলেই বা কী! সেই জায়গায় আমাকে নিয়ে গোটা দেশের আবেগ জড়িয়ে যাচ্ছে। এটা চাপ কোথায়? আমি নিজেকে খুবই ভাগ্যবান মনে করি যে, আমি দেশের অসংখ্য মানুষের এই ভালবাসা পেয়েছি। ওই যে বললাম, এটা আশীর্বাদ। চাপ নয়।

প্র: তবু খেলার সময়ে সেই দিনগুলোতে কখনও কি মনে হতো না যে, অতিরিক্ত চাপ তৈরি হচ্ছে?

সচিন: শুনুন, যে কোনও পেশাদার ক্রিকেটারের স্বপ্ন থাকে সে দলকে জেতাবে, দেশকে আনন্দ দেবে, দেশের জন্য গৌরব আনবে। সেই সুযোগ পাওয়াটাও ভাগ্যের ব্যাপার। আমি ভাগ্যবান কারণ আমি সেই সুযোগটা পেয়েছি। দেশের হয়ে চব্বিশ বছর ধরে খেলার সময় কখনও মনে হয়নি, রিল্যাক্স করি। আর রিল্যাক্স করিনি কারণ মানুষের প্রত্যাশার চাপটা বুঝতে পারতাম। কখনও এমন ক্রিকেটার হতে চাইনি, যার কাছ থেকে মানুষের কোনও প্রত্যাশাই নেই। এই প্রত্যাশাটাই তো আমাকে দিয়ে আরও কঠিন পরিশ্রম করিয়েছে। আমাকে আরও সাফল্য পেতে সাহায্য করেছে। এটাকে চাপ বলে তাই অবমাননা করতে চাই না। বরং আমাকে ঘিরে দেশের মানুষের যে আবেগ বা প্রত্যাশা— সেটার প্রতি শ্রদ্ধাবনত থেকে বলতে চাই, আপনাদের এই প্রত্যাশাই আমাকে ক্রিকেটীয় হার্ডলগুলো পেরোতে উৎসাহিত করেছে। ক্রিকেট মাঠের প্রাপ্তিগুলো পেতে উদ্বুদ্ধ করেছে।

আরও খবর: চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ধোনি-যুবরাজের অভিজ্ঞতাই বাজি বিরাটের

প্র: সেই কারণেই কি ‘বিলিয়ন ড্রিমস’ টাইটেল দেওয়া হয়েছে?

সচিন: এটা তো প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ঠিক করা। টাইটেল কী হবে, সেটা নিয়ে ওপেন কনটেস্ট হয়েছিল। সাত লক্ষের কাছাকাছি এন্ট্রির মধ্যে থেকে এটাকে বেছে নেওয়া হয়।

তারামণ্ডল: বুধবার মুম্বইয়ে ‘সচিন আ বিলিয়ন ড্রিমস’ ফিল্মের প্রিমিয়ার উপলক্ষে মিশে গেল ক্রিকেট ও বলিউড।

(বাঁ-দিক থেকে) অঞ্জলি, সচিন, অমিতাভ, অভিষেক ও ঐশ্বর্যা। ছবি: পিটিআই।

প্র: জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ফিরে যেতে হয়েছিল এই ডকু-ড্রামা করার জন্য। সেই অভিজ্ঞতাটা কেমন ছিল?

সচিন: খুবই আবেগপূর্ণ একটা অভিজ্ঞতা। আমি কয়েকটা ক্ষেত্রে খুব আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছিলাম। সাহিত্য সহবাসের যে বাড়িতে আমার ছোটবেলা কেটেছে, সেখানে শ্যুটিং হয়েছে। সেখানে ফিরে যাওয়ার অভিজ্ঞতাটা বলে বোঝাতে পারব না। ছোটবেলাটা যখন কেটেছে, তখন তো দুরন্ত গতিতে ছুটছিলাম। উপলব্ধি করার ফুরসত পাইনি যে, দিনগুলো কেমন কেটেছে। এখন সেখানে ফিরে যাওয়াটা ভীষণ, ভীষণ নস্ট্যালজিক ছিল। কত সব পুরনো স্মৃতি ভিড় করে আসছিল! তার পর শিবাজি পার্কে ফিরে যাওয়া। যে পিচে আমি প্রথম ব্যাট করেছিলাম, সেখানে গিয়ে আমি দাঁড়িয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল জীবন পিছিয়ে গিয়েছে পঁয়ত্রিশ বছর!

প্র: শিবাজি পার্কের পিচে দাঁড়িয়ে কি মনে পড়ছিল সারদাশ্রম স্কুলের সেই দিনগুলো?

সচিন: সব কিছু, সব কিছু। সব মনে পড়ে যাচ্ছিল। দাদা (অজিত তেন্ডুলকর) নিয়ে গিয়েছিল আমাকে। যে পিচটায় প্রথম ব্যাট করেছিলাম, সেখানে গিয়ে আবার দাঁড়ালাম। বুঝতেই পারছেন, কী রকম বিরল একটা মুহূর্ত হতে পারে সেটা। যত দিন ক্রিকেট খেলেছি, আমার কাছে টোয়েন্টু টু ইয়ার্ডস ছিল মন্দিরের মতো। বাইশ গজকে আমি পুজো করে এসেছি। শিবাজি পার্কের ওই পিচ আমার কাছে ভীষণ স্পেশ্যাল।

প্র: ওয়াংখেড়ের ১৬ নভেম্বর, ২০১৩ দিনটা মনে পড়ে গেল। আপনার ফেয়ারওয়েল টেস্ট। পিচটাকে এসে প্রণাম করে গেলেন।

সচিন: হ্যাঁ। কৃতজ্ঞতা জানাতে ফিরে গিয়েছিলাম ওয়াংখেড়ের পিচের কাছে। ওই বাইশ গজটায় খেলেই তো বড় হয়েছি। তাই শেষ ম্যাচে নমস্কার করে আমার মন্দিরের কাছে বলে আসতে গিয়েছিলাম, সুখেদুঃখে আমাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। বলে এসেছিলাম, আমি ভাগ্যবান যে, ক্রিকেট জীবনে অনেক সাফল্য দিয়েছ আমাকে।

প্র: আপনার মতো আবেগপ্রবণ এক জন মানুষ। এই সব দৃশ্যে ফিরে যাওয়া নিশ্চয়ই কঠিন ছিল?

সচিন: মাঝেমধ্যে আবেগের স্রোত বয়ে যাচ্ছিল ঠিকই। আমাকে কষ্ট করে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়েছে।

প্র: যদি জিজ্ঞেস করি, পুরো ফিল্মে সবচেয়ে কঠিন আর আবেগতাড়িত মুহূর্ত কী ছিল, কোনটা বাছবেন?

সচিন: ১৯৯৯ বিশ্বকাপ। যখন বাবা আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন। বাড়ি ফিরে এসে আবার গেলাম বিশ্বকাপে খেলতে। আমার জীবনে খুব কঠিন একটা অধ্যায় ছিল সেটা। খুবই ব্যক্তিগত একটা মুহূর্ত। বাবাকে হারানোর পর থেকে আমি খুব বেশি এটা নিয়ে কথা বলতে চাইনি। ফিল্মের জন্য ওই দিনটায় ফিরে যাওয়াটা সবচেয়ে কঠিন ছিল।

প্র: ফিল্মে বেশ কিছু প্রাইভেট মুহূর্তও আছে। কী ধরনের মুহূর্ত?

সচিন: সবাই আমাকে এর আগে টিভি-তে দেখেছে। সেটা বেশির ভাগটাই ক্রিকেট মাঠ কেন্দ্রিক। ব্যক্তিগত জীবনে আমি কী রকম ছিলাম, খেলা চলার সময় আমার পরিবারের সদস্যরা কী করতেন, সে সব কেউ জানে না। উত্থান-পতনের মধ্যে মাঠের বাইরে আমার জীবনে কী ঘটত, কেউ জানে না। সে সবই ফিল্মে থাকছে। আমি সব বলে দিতে পারব না। তবে এটুকু জানাতে পারি, কখনও কেউ হদিশ পায়নি এমন কিছু ফুটেজ ফিল্মে দেখা যাবে।

প্র: ফিল্মে কি আপনি কোনও বার্তা দিয়েছেন তরুণ প্রজন্মের জন্য বা উঠতি ক্রিকেটারদের জন্য?

সচিন: দিয়েছি। পুরোটা বলব না। ফিল্মের জন্যও তো কিছু থ্রিলার রাখতে হবে। সংক্ষেপে বলছি। আমার বাবা খুব ছোটবেলায় স্বাধীনতা দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘এই জীবনটা তোমার। তাই তোমাকেই এর পরিচর্যা করতে হবে। সুযোগ পেলে সুযোগ কাজে লাগাতে হয়। অপব্যবহার করতে নেই। সাফল্য অর্জন করো এবং সাফল্য পেয়ে মাটিতে পা রেখে চলো। ভাল মানুষ হও।’’ বাবার সেই উপদেশ আমি বরাবর মেনে চলার চেষ্টা করেছি। মোটামুটি ভাবে ফিল্মে আমি যে মেসেজটা দিয়েছি, সেটাও এই সুরেই। তার সঙ্গে নিজে ক্রিকেট খেলতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, সেটাও বলার চেষ্টা করেছি।

প্র: সেই অভিজ্ঞতাটা কেমন?

সচিন: তরুণ, উঠতিদের বলতে চেয়েছি তারকার গ্ল্যামার দেখে প্রভাবিত হওয়াটা খুব সহজ। তারকা হওয়ার পিছনে যে কঠিন পরিশ্রম লুকিয়ে থাকে সেটা প্রকাশ্যে ঘটে না। তাই দেখাও যায় না। চেষ্টা করো কঠিন সেই জীবনের খোঁজ পেতে। গ্ল্যামারের পিছনে না ছুটে খেলাটার সম্পর্কে আবেগ তৈরি করো। এটাই সংক্ষেপে আমার বার্তা। যা শুধু ক্রিকেট বলে নয়, জীবনের যে কোনও শাখাতেই প্রযোজ্য বলে মনে করি।

প্র: সচিন, আনন্দবাজারের পক্ষ থেকে আপনাকে অনেক শুভেচ্ছা।

সচিন: অসংখ্য ধন্যবাদ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE