Advertisement
E-Paper

যন্ত্রণা জিতেই সোনার মেয়ে স্বপ্না

ব্যাঙ্কক এশিয়াডে জ্যোতির্ময়ী শিকদার জোড়া সোনা জিতেছিলেন। ২০০২ সালে বুসানে সোনা পান সরস্বতী দে। ১৬ বছর পরে ফের বাংলায় সোনার আলো। তা-ও আবার হেপ্টাথলনের মতো কঠিনতম ইভেন্টে। ভারতীয় অ্যাথলেটিক্সের ইতিহাসে কোনও অ্যাথলিট যে গৌরব ছুঁতে পারেননি, তা-ই ছুঁয়ে ফেললেন স্বপ্না।

রতন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০১৮ ০৪:৫৪
নজির: মহিলাদের হেপ্টাথলনে সোনা জেতার পরে জলপাইগুড়ির স্বপ্না বর্মণ। জাকার্তা এশিয়ান গেমসে। ছবি: রয়টার্স।

নজির: মহিলাদের হেপ্টাথলনে সোনা জেতার পরে জলপাইগুড়ির স্বপ্না বর্মণ। জাকার্তা এশিয়ান গেমসে। ছবি: রয়টার্স।

বাংলার সোনার মেয়েকে বাধ্যতামূলক ডোপ টেস্টে নিয়ে যাওয়ার জন্য যখন ডাকাডাকি হচ্ছে, তখনও জার্কাতায় ফোনের ও-প্রান্তে থাকা স্বপ্না বর্মণ হাঁফাতে হাঁফাতে বলে চলেছেন, ‘‘এশিয়াডের এই পদকটার জন্য আমি অ্যাথলেটিক্স জীবনকে বাজি রেখেছিলাম। শরীরের এত জায়গায় এত চোট-আঘাত ছিল যে ধরেই নিয়েছিলাম, এটাই জীবনের শেষ টুর্নামেন্ট হবে। যা করার এখানেই করতে হবে। আমার স্বপ্ন সার্থক।’’

ব্যাঙ্কক এশিয়াডে জ্যোতির্ময়ী শিকদার জোড়া সোনা জিতেছিলেন। ২০০২ সালে বুসানে সোনা পান সরস্বতী দে। ১৬ বছর পরে ফের বাংলায় সোনার আলো। তা-ও আবার হেপ্টাথলনের মতো কঠিনতম ইভেন্টে। ভারতীয় অ্যাথলেটিক্সের ইতিহাসে কোনও অ্যাথলিট যে গৌরব ছুঁতে পারেননি, তা-ই ছুঁয়ে ফেললেন স্বপ্না। চমকে দেওয়া ফল করেছেন তিনি। টপকে গিয়েছেন জীবনে প্রথম বার ৬০০০ পয়েন্টের মাইলস্টোন। জার্কাতায় সাতটি ইভেন্টে ৬০২৬ পয়েন্ট তাঁর। ‘‘আমার কাছেও এটা অবিশ্বাস্য ফল। গত রাতেও ভাবিনি এত পয়েন্ট পাব। বলতে পারেন ছ’হাজার পয়েন্ট সোনার চেয়েও দামী। শরীরের চারটে জায়গায় চোট ছিল। প্রতি মুহূর্তে যন্ত্রণা হচ্ছিল গোড়ালি, হাঁটু, কোমরে। রাতে দাঁতের ব্যথায় ঘুমোতে পারিনি। কী ভাবে এটা করে ফেললাম জানি না। তবে আজ গেমস ভিলেজ থেকে বেরোনোর সময়ে মাথায় রেখেছিলাম আমাকে সেরাটা দিতেই হবে,’’ বুধবার ভারতীয় সময় সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় কথাগুলো বলার সময় বছর বাইশের স্বপ্নার গলা থেকে চুঁইয়ে পড়ছিল তৃপ্তি। যা শারীরিক প্রতিবন্ধকতা আর জীবনযুদ্ধ পেরোনো মেয়েকে চিনিয়ে দেয় অনায়াসেই।

জাকার্তা এশিয়াডে বুধবারের বিকেলটা তো জলপাইগুড়ির ঘোষ পাড়ার রাজবংশী পরিবারের সোনার মেয়ে স্বপ্নারই। যাঁর জীবনের পরতে পরতে জড়িয়ে নাটকীয় ঘাত-প্রতিঘাত আর আলো-আঁধারি। দারিদ্রকে ছাপিয়ে এক জেদি মেয়ের গলি থেকে রাজপথে ওঠার কাহিনি।

আরও পড়ুন: মায়ের মোটা চালেই চ্যাম্পিয়ন জলপাইগুড়ির স্বপ্না

দু’পায়ে ছ’টা করে বারোটা আঙুল। যা সাধারণত দেখা যায় না। শারীরিক এই প্রতিবন্ধকতা জয় করতে বিশেষ স্পোর্টস শু পরতে হয় তাঁকে। বরাবরই খামখেয়ালি স্বভাবের মেয়ে স্বপ্না। ২০১৫ সালে হঠাৎই সল্টলেক সাইয়ের হস্টেল ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন দেশের বাড়িতে। আর কোনও দিন অ্যাথলেটিক্স ট্র্যাকে ফিরবেন না জানিয়ে দিয়েছিলেন কোচ সুভাষ সরকারকে। প্রায় তিন মাস পরে অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে তাঁকে সাইতে ফিরিয়ে আনেন সুভাষবাবু। মনোবিদের কাছে দিনের পর দিন নিয়ে গিয়ে তিনিই ছাত্রীকে ফিরিয়ে আনেন ট্র্যাকে।

২০১৬ সালে কোমরের চোটের জন্য কোনও প্রতিযোগিতায় নামতে পারেননি স্বপ্না। অনুশীলনে নামলেই কোমরে ব্যথা হত তাঁর। ডাক্তাররা বলেছিলেন, অস্ত্রোপচার না করিয়ে ট্র্যাকে নামলে সফল হওয়া কঠিন। কিন্তু স্বপ্নার কোচ সিদ্ধান্ত নেন, এশিয়াড পর্যন্ত অস্ত্রোপচার করাবেন না। জার্কাতা থেকে সুভাষবাবু এ দিন বলছিলেন, ‘‘আশঙ্কা ছিল যদি অস্ত্রোপচার করানোর পর স্বপ্না এশিয়াডে আর নামতে না পারে। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, ইঞ্জেকশন নিয়ে ওঁকে নামাব। ঝুঁকিটা নিয়েছিলাম মরিয়া হয়ে। মুম্বইতে গিয়ে গত এক বছরে তিনটে ইঞ্জেকশন নিয়েছে ও। এশিয়াড সোনাটা পেয়ে গেল। কোমরে বেল্ট পরে মেয়েটা যে এ রকম করে ফেলবে, সেটা আমিও ভাবিনি। ওর জেদটা ওকে জিতিয়ে দিল।’’

এখানেই শেষ নয় স্বপ্নার লড়াই। এশিয়াডের ‘ফোকাস’ নড়ে যেতে পারে এই ভেবে রেলের চাকরি ছেড়েছেন। জলপাইগুড়িতে দরমা আর টিনের চালের বাড়িতে তাঁর বাবা এখন পঙ্গু। কাজ করতে পারেন না। মা-বাবাকে আর্থিক সাহায্যের জন্য একটি তেল কোম্পানির স্টাইপেন্ড অ্যাথলিট হিসেবে নাম লিখিয়েছেন। জীবন-যুদ্ধের পাশাপাশি পড়াশোনাও বজায় রেখেছেন তিনি। দিল্লির এশিয়াড শিবির থেকে এক দিনের ছুটি নিয়ে এসে স্নাতক হওয়ার একটি ফেল করা বিষয়ের পরীক্ষা দিয়ে গিয়েছেন চারুচন্দ্র কলেজের কলা বিভাগের ছাত্রী। বলছিলেন, ‘‘আমার এই সোনাটা আমার কোচকে উৎসর্গ করছি। উনি না থাকলে আমার স্বপ্ন সার্থক হত না।’’

স্বপ্নার যখন তেরো বছর বয়স, তখন জলপাইগুড়ি জেলা মিট থেকে তাঁকে খুঁজে এনেছিলেন সাই কোচ সুভাষবাবু। প্রথমে শুধু হাইজাম্প ইভেন্ট করতেন স্বপ্না। তাঁকে হেপ্টাথলনে নিয়ে আসেন কোচই। এশীয় স্কুল মিটে নেমে পদক জেতার পরেই জীবনের মোড় ঘুরে যায়। ২০১৭-র জুলাইয়ে ভুবনেশ্বরে এশীয় চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জেতার পরে মনে হচ্ছিল জাকার্তায় পদক পাবেন। স্বপ্না অবশ্য বলছিলেন, ‘‘গতকাল (মঙ্গলবার) আমি ছিলাম দ্বিতীয় স্থানে। ভেবেছিলাম একটা পদক পাবই। কিন্তু এক বারও ভাবিনি সোনাটা হয়ে যাবে। তবে আজ জ্যাভলিন থ্রো-পর যখন ৬৩ পয়েন্টে এগিয়ে গিয়েছিলাম তখন বুঝে গিয়েছিলাম ৮০০ দৌড়টা ঠিক ঠাক করতে পারলে স্বপ্ন ছুঁতে পারব। ইনচিওনে গত এশিয়াডে নেমে পঞ্চম হয়েছিলাম। তখন ছোট ছিলাম। জুনিয়র হয়ে সিনিয়রে নেমেছিলাম। অভিজ্ঞতার অভাবে মার খেয়েছিলাম। এ বার তা হয়নি।’’ এর পরের লক্ষ্য কী দু’বছর পরের টোকিয়ো অলিম্পিক্স? স্বপ্না নতুন স্বপ্নের কথা বলেন না। ‘‘কোমরে বেল্ট বেঁধে আর পারব না। এ বার অস্ত্রোপচার করতে হবে। দেখি কোচ-স্যর বা ডাক্তাররা কী বলেন। তারপর অলিম্পিক্সের কথা ভাবব।’’

Asian Games 2018 Gold Heptathlon India Swapna Burman
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy