Advertisement
E-Paper

কলকাতাকে জয়ের ট্র্যাকে ফেরাল দেবজিতের হাত

পকেটে হাত। মাঠের দিকে স্থির চোখ। দূর থেকে দেখলে মনে হবে নিশ্চল মর্মর মূর্তি! উচ্ছ্বাসহীন। আবেগহীন। টিমের ভুলে প্রতিক্রিয়া নেই। গোল হলেও তিনি শান্ত। আন্তোনিও লোপেজ হাবাসের অভিব্যক্তির সঙ্গে জোসে মলিনার কোনও মিল নেই।

প্রীতম সাহা

শেষ আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০১৬ ০৩:৩০
পেনাল্টি থেকে গোল করে হিউম। শনিবার রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়ামে। ছবি :উৎপল সরকার।

পেনাল্টি থেকে গোল করে হিউম। শনিবার রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়ামে। ছবি :উৎপল সরকার।

আটলেটিকো- ১ : দিল্লি- ০(হিউম-পেনাল্টি)

পকেটে হাত। মাঠের দিকে স্থির চোখ। দূর থেকে দেখলে মনে হবে নিশ্চল মর্মর মূর্তি! উচ্ছ্বাসহীন। আবেগহীন। টিমের ভুলে প্রতিক্রিয়া নেই। গোল হলেও তিনি শান্ত।

আন্তোনিও লোপেজ হাবাসের অভিব্যক্তির সঙ্গে জোসে মলিনার কোনও মিল নেই। কলকাতার বিখ্যাত ‘সাদা শার্ট’ উত্তর হলে, তিনি দক্ষিণ। তবে শনিবার রাতের পরে আর হয়তো কোনও ছায়াযুদ্ধ করতে হবে না মলিনাকে! দিল্লি ডায়নামোসকে হারিয়ে কলকাতার নতুন স্লোগান এখন ‘গো মলিনা গো’। যেখানে নীতি একটাই— ধীরে চলো, জিতে ফেরো। এই নীতি টিম এটিকে-কে দু’ম্যাচ পরে আবার জয়ের ট্র্যাকে ফেরাল। পয়েন্ট টেবলে তুলল দুইয়ে।

এটিকে-র জন্য আরও স্বস্তির, কোচের এই নীতির সঙ্গে সুন্দর ভাবে মানিয়ে নিয়েছেন ফুটবলাররাও। তা হাবাসের যোদ্ধা বোরহা-দ্যুতি হোক কিংবা তাঁর আমদানি দেবজিৎ-বেলেনকোসো। কোথাও যেন ম্যাচ জিতেও বাড়তি উচ্ছ্বাস নেই। সমারসল্ট কিংবা নতুন কোনও গোল সেলিব্রেশন নেই। সিক্রেট এজেন্টের মতো সবাই চুপি চুপি টিমের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। মলিনা নিজেও বলছিলেন, ‘‘আমরা খুব সাধারণ টিম। সবাই আমাদের সাধারণ ভাবুক সেটাই আমরা চাই।’’

কোচের কথা শুনে মনে হল, আসল কথাটা তিনি বলতে চান না। বলতে চান না যে, এটাই তাঁর স্ট্র্যাটেজি। প্রতিপক্ষকে ভ্রান্ত ধারণায় বশীভূত করে ম্যাচ নিয়ে চলে যাওয়া!

পস্টিগা-উপাখ্যানকেই ধরা যাক। চব্বিশ ঘণ্টা আগে পস্টিগার বিকল্প নিয়ে টিমের অন্দরে হইচই পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু শনিবার রাতে সেই মার্কির জোড়া বিকল্প ঠিক খুঁজে নিলেন কোচ! হাবাসের আমলের রক্ষাকর্তা হিউম আবার স্বমহিমায়। এ বার তাঁর দোসর বেলেনকোসো। দিল্লি ম্যাচ থেকেই এটিকে-র এই জুটি চ্যাম্পিয়নশিপের স্বপ্ন দেখাতে শুরু করে দিল কলকাতাকে। আর পস্টিগা? তিনি এখন স্রেফ গ্যালারির ‘চিয়ারলিডার’! বেলেনকোসো অল্পের জন্য গোল নষ্ট করলে মাথায় হাত দিয়ে আফসোসে আছড়ে পড়ছেন। হিউম গোল করলে নাচছেন। এটিকে-র কোটি টাকার স্ট্রাইকার এখন নতুন ‘স্টার-ফ্যান’ কলকাতার। শোনা গেল, তিনি এখন রিহ্যাব শুরু করেছেন। কবে ফিরবেন? থাক।

পস্টিগা-বিহীন এটিকে হিউম-বেলেনকোসো জুটি এ দিন পেয়ে গেল। কিন্তু সেখানেই শেষ নয়। দীপাবলির আগে এটিকে পৃথিবী আরও একজনকে পেল। তিনি দেবজিৎ মজুমদার। মোহনবাগানের গোলকিপার এখন এটিকে-র হৃদয়। মলিনার অমূল্য সম্পদ। এ দিনের জয়ে মলিনার ‘ধীরে চলো নীতি’ ম্যাজিকের মতো যদি কাজ করে থাকে, তা হলে দেবজিতের হাত শাসন করল গোলের আশেপাশে ঘুরঘুর করা দিল্লি স্ট্রাইকারদের। দিল্লির অন্তত বারোটা নিশ্চিত গোল একা বাঁচালেন দেবজিৎ। যার মধ্যে এক বার তো মালুদা-রুপার্ট-মার্সেলো-গাটজের চারটে পর পর শট থামিয়ে রেকর্ডও গড়ে ফেললেন। এটিকে কোচ ও প্রাক্তন গোলকিপার মলিনা বলছিলেন, ‘‘একটা ভাল গোলকিপারের মধ্যে দু’টো গুণ থাকা খুব জরুরি। অ্যান্টিসিপেশন ও আউটিং। ওর মধ্যে যে দু’টোই আছে সেটা বুঝেছিলাম।’’

দেবজিৎ না থাকলে এ দিন হয়তো তিন পয়েন্ট নিয়ে ফিরতে পারতেন না মলিনা। বিশেষ করে যে ভাবে মালুদা আর মার্সেলোকে ব্যবহার করলেন দিল্লি কোচ জামব্রোতা, তা দেখলে সেটা আরও মনে হবে। এক দশক আগে বিশ্বকাপ ফাইনালে ফ্রান্স যে স্ট্র্যাটেজি নিয়েছিল ইতালিকে টপকাতে, এ দিন রবীন্দ্র সরোবরে সেই ছকেই কলকাতা-বধের ঘুঁটি সাজিয়েছিলেন ইতালিয়ান কোচ। মালুদাকে লেফট উইং দিয়ে ব্যবহার করে মাঝমাঠে শক্তি বাড়িয়ে সেটপিসে ঝড় তোলা। ৪-৪-১-১ ছকে। কিন্তু জামব্রোতা হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন যে, সে দিন বার্লিনে যখন মালুদা-রিবেরি-অঁরিদের ত্রিভুজ পারেননি, তখন কলকাতাতে একা মালুদা কী ভাবে পারবেন তাঁর নতুন টিমকে জেতাতে!

সে দিন সমগ্র ইতালীয় ডিফেন্স দাঁড়িয়ে পড়েছিল ফ্রান্সের সামনে। আর এ দিন দিল্লির সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন শুধু এটিকের ‘লাস্ট ম্যান অব ডিফেন্স’, একা। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, মালুদা তো ভুক্তভোগী। সে দিন বুফনদের হারাতে পারেননি। কিন্তু জামব্রোতা? তিনি তো জানতেন, ভাল আক্রমণ থাকলেই ম্যাচ জেতা যায় না। প্রতিপক্ষের রক্ষণকেও দুমড়ে দিতে হয়। নইলে তো ফ্রান্সই দশ বছর আগে বিশ্বকাপ জেতে। ইতালি নয়। তা হলে সেই ভুল কেন করলেন জামব্রোতা? অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসই কি তাঁর পতন ঘটাল? এ দিন শেষ পনেরো মিনিট দশ জনে খেলে কলকাতা। সেরেনো লাল কার্ড দেখায়। কিন্তু এই সময়টাও কাজে লাগাতে পারেননি জামব্রোতা। উল্টে দিল্লির হয়ে পেনাল্টি নষ্ট করেন মার্সেলো।

যা-ই হোক, একটা বিষয় নিশ্চিত। জামব্রোতার ভুলভ্রান্তির চেয়েও বেশি কৃতিত্ব মলিনার মগজের প্রাপ্য। প্রাপ্য, তাঁর মানসিক দৃঢ়তার। গোটা ম্যাচে এক বারের জন্যও তাঁকে অতি-উৎসাহী মনে হয়নি। দিল্লির পেনাল্টি নষ্টের পরেও তিনি চুপ। চোখের পাতা পড়ার আগে কাউন্টার অ্যাটাকে হিউমের পেনাল্টি গোলের পরও সেই চুপ। অথচ ইতালিয়ান কোচের টিমকে টপকাতে সম্ভবত টুর্নামেন্টের সবচেয়ে বড় ঝুঁকিটা এই ম্যাচেই নিয়েছিলেন তিনি। অর্ণব মণ্ডল এবং জাভি লারাকে বেঞ্চে রেখে। কোচি থেকে গোয়া— এখনও পর্যন্ত এই দু’জনই এটিকে-র সম্মান বাঁচিয়েছেন। কিন্তু দিল্লির বিরুদ্ধে অগ্নিপরীক্ষার ম্যাচে মলিনা দু’জনকেই বেঞ্চে বসিয়ে যে সাহস দেখালেন, তাতে একটা ব্যাপার স্পষ্ট। বহিরঙ্গে তিনি যতটা নরম স্বভাবের ততটাই শক্ত অন্দরমহলে। শুধু একটাই ব্যাপার। ডিফেন্সটা আরও ভাল করা দরকার। প্রতিপক্ষকে এত হুড়মুড়িয়ে উঠে আসতে দিলে বিপদ।

মলিনাকে বুঝতে হবে, রোজ-রোজ কোনও এক দেবজিৎ মজুমদার টিমকে বাঁচাবেন না।

ATK ISL Debjit
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy