Advertisement
E-Paper

নির্বাসিত হার্দিকরা, প্রশ্ন সিদ্ধান্ত নিয়ে

দেশ জুড়ে উঠে পড়া প্রবল বিতর্কের ঝড়ের মধ্যে হার্দিক পাণ্ড্য এবং কে এল রাহুলকে অনির্দিষ্টকালের জন্য নির্বাসিত করে দিল ভারতীয় বোর্ড। শুধু তা-ই নয়, দুই ক্রিকেটারকে অস্ট্রেলিয়া থেকে দেশেও ফিরিয়ে আনা হচ্ছে।

নিজস্ব সংবাদদাতা 

শেষ আপডেট: ১২ জানুয়ারি ২০১৯ ০৩:৫৬
বিতর্কের মধ্যেই সিডনিতে অনুশীলন করলেন হার্দিক।গেটি ইমেজেস

বিতর্কের মধ্যেই সিডনিতে অনুশীলন করলেন হার্দিক।গেটি ইমেজেস

দেশ জুড়ে উঠে পড়া প্রবল বিতর্কের ঝড়ের মধ্যে হার্দিক পাণ্ড্য এবং কে এল রাহুলকে অনির্দিষ্টকালের জন্য নির্বাসিত করে দিল ভারতীয় বোর্ড। শুধু তা-ই নয়, দুই ক্রিকেটারকে অস্ট্রেলিয়া থেকে দেশেও ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। মনে করা হচ্ছে, অস্ট্রেলিয়ার পরে নিউজিল্যান্ডে ওয়ান ডে এবং টি-টোয়েন্টি সিরিজেও দলের বাইরে থাকতে পারেন দুই ক্রিকেটার।

কিন্তু পাল্টা তর্ক উঠছে বোর্ডের সিদ্ধান্ত নিয়ে। প্রশ্ন উঠছে, দুই ক্রিকেটারকে মাঠের বাইরের ঘটনার জন্য শাস্তি দেওয়ার এক্তিয়ার কি তাঁদের ক্রিকেট বোর্ডের আছে? কর্ণ জোহরের জনপ্রিয় টিভি শো ‘কফি উইথ কর্ণ’-এ গিয়ে মহিলাদের নিয়ে তীব্র আপত্তিজনক মন্তব্য করেন ভারতীয় দলের তরুণ অলরাউন্ডার হার্দিক এবং ওপেনিং ব্যাটসম্যান রাহুল। বিশেষ করে মহিলাদের প্রতি হার্দিকের মন্তব্য এবং আচরণ নিয়ে ঝড় বয়ে যায়।

দুই ক্রিকেটারের মন্তব্যকে কেউ সমর্থন না করলেও ওয়াকিবহাল মহলে অনেকের মনে প্রশ্ন উঠছে, বোর্ড কী করে টিভি শো-তে মন্তব্য করার জন্য শাস্তি দিতে পারে? এ ভাবে ক্রিকেটের বাইরের ঘটনার জন্য কি ক্রিকেটীয় শাস্তি দেওয়া যায়!

শাস্তি ঘোষণার আগে আইনি উপদেশ নেয় ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড। দু’পক্ষের মধ্যে ই-মেল চালাচালির নথিপত্র হাতে এসেছে আনন্দবাজারের। তাতে দেখা যাচ্ছে, আইনি উপদেষ্টারাও বোর্ডের কাছে এ নিয়ে প্রশ্ন রেখেছেন। আইনি উপদেষ্টারা জানিয়েছেন, দুই ক্রিকেটারকে প্রথম অবস্থায় যে শো-কজ করা হয়েছিল, তা অবৈধ। স্পষ্ট করে ক্রিকেটারদের বলাই হয়নি, বোর্ডের সংবিধান অনুযায়ী কোন আইন মোতাবেক তাঁদের কারণ দর্শাতে বলা হচ্ছে। তড়িঘড়ি এখন হার্দিক এবং রাহুলকে দ্বিতীয় শো-কজ পাঠানো হচ্ছে। তাতে আইনি উপদেষ্টাদের দেখিয়ে দেওয়া পথে নিয়মের উল্লেখ করা হচ্ছে।

ওয়াকিবহাল মহল আবার ধরিয়ে দিচ্ছে যে, বোর্ডের সংবিধানেও এমন কোনও নির্দিষ্ট আইন বা ধারা নেই, যার ভিত্তিতে দুই ক্রিকেটারকে টিভি শো-তে করা মন্তব্য নিয়ে কারণ দর্শাতে বলা যেতে পারে। একাধিক সূত্র থেকে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে, ক্রিকেটারদের জন্য বোর্ডের যে আচরণবিধি রয়েছে, তার বেশিটাই মাঠের মধ্যেকার আচরণে সীমাবদ্ধ। মাঠের বাইরের যে জিনিসগুলি আচরণবিধির আওতায় পড়ে, সেগুলিও কার্যত ক্রিকেট সম্পর্কিত। বোর্ড বা জাতীয় দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হতে পারে এমন কোনও মন্তব্য করলে সাধারণত সেগুলো বলবৎ করা হয়। হার্দিক যখন কর্ণ জোহরের শো-তে যান, তখন তিনি ভারতীয় দলের হয়ে খেলছিলেন না। চোটের জন্য দলের বাইরে ছিলেন এবং রিহ্যাব করছিলেন। তাই ক্রিকেটারদের সঙ্গে বোর্ডের চুক্তিও তিনি লঙ্ঘন করেছেনই, জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না।

আরও পড়ুন: সেরা দল তৈরির প্রস্তুতি আজ সিডনি থেকেই​

বোর্ডের কৌঁসুলি হিসেবে এক দশকের উপরে কাজ করা এবং বিভিন্ন খেলার সঙ্গে আইনি উপদেষ্টা হিসেবে তিন দশকের উপরে জড়িয়ে রয়েছেন কলকাতার ঊষানাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি এ দিন বলে দিলেন, ‘‘আমি জীবনে দেখিনি বা শুনিনি, বোর্ড এ ভাবে ক্রিকেটের বাইরের মন্তব্যের জন্য ক্রিকেটারদের শাস্তি দিচ্ছে। আগে কখনও ঘটেছে বলে মনে করতে পারছি না।’’ হার্দিক এবং রাহুলের মন্তব্য নিয়ে অনেকের মতো ঊষানাথবাবুও খুবই ক্ষুব্ধ। তবু বোর্ডের প্রাক্তন আইনজীবী যোগ করছেন, ‘‘ওদের মন্তব্যগুলো শুনে ঘেন্না লাগছে। তবু বোর্ডের কোনও এক্তিয়ারই নেই এ ভাবে শাস্তি দেওয়ার। সম্পূর্ণ স্বৈরাচারী ভঙ্গিতে কাজ করেছে বোর্ড।’’ তিনি আরও প্রশ্ন তুলছেন, ‘‘নৈতিকতার প্রশ্নই যদি ওঠে, তা হলে সিইও রাহুল জোহরির বিরুদ্ধে মহিলাদের হেনস্থার অভিযোগ ওঠার পরেও তাঁকে সাসপেন্ড করেনি কেন বোর্ড?’’

এই মুহূর্তে বোর্ড চালাচ্ছেন সুপ্রিম কোর্ট-নিযুক্ত কমিটি অফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর্স। তাদের দুই সদস্য সিওএ প্রধান বিনোদ রাই এবং প্রাক্তন মহিলা ক্রিকেটার ডায়না এডুলজির মধ্যে সব বিষয় নিয়েই মতভেদ রয়েছে। হার্দিকদের নিয়েও বিনোদ রাই বলেন, দুই ম্যাচ সাসপেন্ড করা হোক। আবার ডায়না এডুলজি বলেন, আইনি উপদেশ নেওয়ার কথা। ডায়না আরও আর্জি জানান, তদন্ত কমিটি গঠন করে পদক্ষেপ করা হোক। যতক্ষণ না তদন্ত শেষ হচ্ছে, সাসপেন্ড রাখা হোক দুই ক্রিকেটারকে।

শেষ পর্যন্ত বোর্ড ডায়নার প্রস্তাব মেনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সিওএ প্রধান বিনোদ রাই বলে দেন, ‘‘তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত দুই ক্রিকেটারকে সাসপেন্ড করা হচ্ছে।’’ এর কিছুক্ষণ পরেই জানা যায়, রাহুল এবং হার্দিককে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। হার্দিক সকালে ভারতীয় দলের সঙ্গে প্র্যাক্টিস করেন। তবে সাংবাদিক সম্মেলনে এসে কোহালি বলে দেন, তাঁদের দল দুই ক্রিকেটারের করা আপত্তিজনক মন্তব্যকে সমর্থন করছে না। এটা দুই ক্রিকেটারের ব্যক্তিগত মন্তব্য হিসেবেই ধরা হবে।

শোনা যাচ্ছে, বিতর্কের ঝড়ে খুবই মুষড়ে পড়েছেন হার্দিক। রাতে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমোতে হয়েছে, এমন তথ্যও পাওয়া গেল। যদিও শনিবার সকালে উঠেই ফেরার তোড়জোর করতে হবে। বিশ্বকাপের প্রস্তুতি হিসেবে দেখা হচ্ছিল অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের ওয়ান ডে এবং কুড়ি ওভারের সিরিজকে। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে হার্দিক ভারতীয় দলের অন্যতম তুরুপের তাস। তাঁর এই বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সাসপেন্ড হওয়া ভারতীয় দলের বিশ্বকাপ প্রস্তুতিতে ব্যাঘাত ঘটাবে সন্দেহ নেই।

যদিও ক্রিকেটীয় প্রভাব নয়, বোর্ডের প্রক্রিয়া নিয়েই বেশি প্রশ্ন রয়েছে এখন। সাধারণত, এই ধরনের শৃঙ্খলাজনিত সিদ্ধান্ত যদি নিতেই হয়, সেটা নেওয়ার কথা বোর্ডের এথিক্স অফিসার বা ওম্বাডসম্যানের। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট-নিযুক্ত পর্যবেক্ষকরা থাকা সত্ত্বেও এখনও ওম্বাডসম্যান নিয়োগ করে ওঠা যায়নি। অথচ, হার্দিকদের এই ঘটনায় আইনি উপদেষ্টারা বলেছেন, ওম্বাডসম্যান নিয়োগ করে সিদ্ধান্ত নিতে। তড়িঘড়ি এখন অস্থায়ী কোনও ব্যবস্থা করা হবে।

টক শো-তে করা মন্তব্য নিয়ে তদন্ত কী হবে, সেটাও অনেকে বুঝতে পারছেন না। এক বোর্ড কর্তা বললেন, ‘‘এটা তো ম্যাচ গড়াপেটা বা বল-বিকৃতির ঘটনা নয় যে, তদন্ত কমিটি গড়ে শাস্তি দেওয়া হবে। এখানে তো সকলেই জানে, ওরা দু’জনে কী বলেছে। গোয়েন্দা লাগিয়ে তদন্ত করার কী আছে!’’

বিতর্কের জেরে কর্ণ জোহরের ওই এপিসোডকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, যাতে আর সেটা দেখা না যায়। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন, এমন আপত্তিজনক মন্তব্য রয়েছে দেখেও টিআরপি বাড়ানোর জন্য বাজারে না ছেড়ে আগেই কেন এই শো সেন্সর করা হল না? মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া দেখেই সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমা প্রার্থনা করে টুইট করেছিলেন হার্দিক। তখনও বোর্ড শো-কজ করেনি তাঁকে।

স্কুলের গণ্ডি না পেরনো হার্দিক টিভি শো-তে গিয়ে বেফাঁস মন্তব্য করে ফেললেও নিজেই উপলব্ধি করেন, মারাত্মক ভুল হয়েছে এবং ক্ষমা চান। মজার ঘটনা হচ্ছে, হার্দিক ক্ষমা প্রার্থনার পরে বোর্ড তাঁকে শো-কজ করে। জবাব দিতে গিয়ে ফের ক্ষমা প্রার্থনা করেন বঢোদরার অলরাউন্ডার। তার উত্তরে নেমে আসে বোর্ডের নির্বাসনের চাবুক।

ক্রিকেটের বাইরের গুগলিতে বোল্ড হয়ে যান ক্রিকেটের পাণ্ড্য! কে মনে রাখে ফিয়েদর দস্তয়েভস্কির সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘‘যে মানুষের বিবেক আছে, তাঁর পাপের দংশনও আছে। সেটাই তাঁর শাস্তি!’’

Cricket India Hardik Pandya KL Rahul BCCI
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy