ভারতীয় ফুটবলের মানচিত্রে বাংলার অবস্থান নিয়ে আনন্দবাজারে প্রকাশিত চাঞ্চল্যকর সব তথ্য দেখে আতঙ্কিত ভারতের কিংবদন্তি ফুটবলার এবং কোচ প্রদীপ (পিকে) বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলছেন, ‘‘এর চেয়ে দুঃখের ঘটনা আর কী হতে পারে! এই দিন দেখতে হবে ভাবতে পারিনি। বাংলার ফুটবল ঐতিহ্য তো প্রায় ধ্বংসের মুখে। কঙ্কালসার চেহারাটা এখন বেরিয়ে পড়েছে।’’
শুধু পিকে নন, বাংলার ফুটবলের এই অন্ধকার দশা দেখে ফুঁসছেন পিকেরই দুই প্রিয় ছাত্র, সুব্রত ভট্টাচার্য এবং মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য। যাঁরা বড় দলের কোচিংয়ের দায়িত্বও সামলেছেন। সুব্রত বলছেন, ‘‘আমাদের সময় জাতীয় শিবিরে ডাক পাওয়া বাংলার খেলোয়াড়ের সংখ্যাটা থাকত অন্তত ১০-১২ জন। আর সেখানে এখন কি না সংখ্যাটা মোটে চার! বাংলার ফুটবলারদের জাতীয় স্তরে দাপট বলে তো কিছুই আর বাকি নেই দেখছি! হারিয়েই গিয়েছে!’’
বাংলার আর এক কিংবদন্তি স্টপার মনোরঞ্জন বলে দেন, ‘‘যে সময়ে বাংলার মাটি ফুটবলার তৈরির কারখানা ছিল তখন পরিকাঠামো সে ভাবে না থাকলেও ফুটবলের একটা পরিবেশ ছিল। খুদে ফুটবলারদের হাতের সামনে থাকত আদর্শ সিনিয়র ফুটবলাররা। সেই জায়গাটাই হাল্কা হওয়াতে এই বিপত্তি।’’ বাংলার ফুটবলে এই বিপর্যস্ত অবস্থার জন্য সব চেয়ে বেশি করে আঙুল উঠছে কর্তাদের। অনেক জায়গাতেই বহু দিন ধরে এক জন কর্তাই চেয়ার আগলে বসে আছেন। লোঢা কমিটির সংস্কার ক্রিকেটের মতো ফুটবলে ধাক্কা মারেনি। তাই তাঁদের সরাবে কে!
বাংলার ফুটবলের বর্তমান পরিস্থিতির কথা শুনে গোয়ার বাড়িতে বসে অবাক পাঁচ বারের আই লিগজয়ী কোচ আর্মান্দো কোলাসো। বছর কয়েক আগে ইস্টবেঙ্গলে কোচিং করিয়ে যাওয়া কোচের প্রশ্ন, ‘‘চুনী, মান্না, পিকে, বলরাম, সুব্রত, প্রসূনদের বাংলার হলটা কী?’’
বাংলা ফুটবল সমুদ্রে যে পলি জমেছে, গতিতে যে যতি পড়েছে তা মানছেন আইএফএ প্রেসিডেন্ট অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়ও। বাংলার অলিম্পিক্স সংস্থার প্রেসিডেন্ট আছেন বহু দিন ধরে। অলিম্পিক্সের খেলায় বাংলা কতটা এগিয়েছে, সেই প্রশ্ন তো থাকছেই। এখন ফুটবলে এসে কী অবদান রাখেন, সেটাই দেখার। বাংলার বিভিন্ন খেলায় এবং অবশ্যই ফুটবলে এই অন্ধকার অবস্থার জন্য সব চেয়ে বেশি করে প্রশ্ন উঠছে সংস্থার ক্ষমতায় থাকা বিভিন্ন কর্তাদের ভূমিকা নিয়েই।
নতুন প্রেসিডেন্ট অবশ্য স্বীকার করছেন, ‘‘অত্যন্ত উদ্বেগের তথ্য এটা। ত্রুটি তো নিশ্চয়ই আছে। আমরা নবীন প্রতিভাদের হারিয়ে ফেলছি। বা তাঁদের তুলে আনতে ব্যর্থ হচ্ছি।’’ কিন্তু তাঁরাই বা কী চেষ্টা করছেন, নতুন প্রতিভা তুলে আনার জন্য, সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। বিভিন্ন জেলায় অনুদানের টাকা কোথায় যাচ্ছে? তা কি ফুটবলের উন্নয়নে ব্যবহার করা হচ্ছে? প্রতিভা তুলে আনার জন্য প্রেসিডেন্ট বা সচিব কী উদ্যোগ নিয়েছেন? অন্তত তালিকায় তাঁদের ভূমিকার কোনও ছাপ পড়েনি।
শুধু সাফাই গেয়েই মনে হচ্ছে আইএফএ প্রেসিডেন্ট বা সচিব হাত ধুয়ে ফেলতে চাইছেন। সচিব উৎপল গঙ্গোপাধ্যায় গত কাল বলেছিলেন, বাংলা থেকে বেশি ফুটবলার জাতীয় শিবিরে নেই কারণ সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের স্পটাররাই আসেননি সন্তোষ ট্রফির খেলা দেখতে। এ দিন একই দাবি করলেন প্রেসিডেন্ট অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু তাঁদের সেই দাবি পাল্টা তোপ দেগে উড়িয়ে দিয়েছেন ভারতীয় ফুটবলের ডিরেক্টর অভিষেক যাদব। সারা দেশে ফুটবলার স্কাউট করার কাজ চলে তাঁরই নেতৃত্বে। অভিষেক ফোনে বললেন, ‘‘সন্তোষ ট্রফি-সহ সব ক’টি প্রতিযোগিতায় আমাদের স্কাউটরা হাজির থাকেন। হয়তো ওঁদের কাছে সঠিক তথ্য নেই। বাংলায় আমাদের তিন-চারজন স্কাউট সব প্রতিযোগিতায় নজর রাখেন। নিঃশব্দেই অনেক প্রতিযোগিতা দেখে আসেন ওঁরা। সন্তোষ ট্রফিতে স্কাউট ছিল না, কথাটা ঠিক নয়।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘মহমেডানে খেলা মনবীর সিংহকে তো সন্তোষ ট্রফি থেকেই পছন্দ করে অনূর্ধ্ব-২৩ দলে ডাকা হয়। তার পরে সিনিয়র জাতীয় দলে ডাক পেয়েছে মনবীর। অনূর্ধ্ব-১৫ দলের জন্যও কয়েক জনকে বেছেছি আমরা। যারা শিবিরে যোগ দেবে ১০ নভেম্বর। স্কাউট না থাকলে কী করে তাদের বাছা হল?’’ সুব্রত ভট্টাচার্য তোপ দাগছেন প্রশাকদের দিকেই। তাঁর কথায়, ‘‘গোড়ায় গলদ আইএফএ-র। আমাদের সময় জেলা লিগ ছিল। মোহনবাগানে আসার পরে সেই জেলা লিগেও আমরা খেলেছি। এখন সেই লিগটা হয়? কারা খেলেন? কারা নজরে রাখেন উঠতি ফুটবলারদের?’’ সঙ্গে যোগ করেন, ‘‘রাজনৈতিক নেতাদের প্রসাদ লাভ করে কেউ কেউ কোচিং করাচ্ছেন। কেউ বা স্কাউট হয়েছেন। তাঁরা ফুটবলের জন্য কাজ করার চেয়ে নেতাদের ফুল-বেলপাতা দিয়ে নিজের জায়গা পোক্ত করতে ব্যস্ত।’’ সুব্রত খুব খারাপ বলছেন কি? কয়েক দিন আগেই রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত আইএফএ-র এক কর্তা মাঠে নেমে প্রতিপক্ষ ফুটবলারদের উপরে চড়াও হন। তাঁর বিরুদ্ধে কী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিল আইএফএ? এখনও কেউ জানতে পারেনি।
মনোরঞ্জন আবার প্রশ্ন তুলছেন, ‘‘মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলে ক’জন বাংলার ফুটবলার রয়েছে? লাজং বা উত্তর-পূর্ব ভারতের দলগুলো ভূমিপুত্রদের বেশি করে দলে রেখে আই লিগ খেলার যে সাহস দেখিয়েছে, সেই সাহস কলকাতার বড় দল দেখাতে পারেনি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy