বঙ্গ ব্রিগেড। (বাঁ দিক থেকে) ‘ভীষ্ম’ সন্দীপ। একচল্লিশেও আশি শতাংশ ম্যাচে তেকাঠির নীচে। মেহতাব, দেবজিৎ, সৌভিক তিন জনই এ বার আইএসএলে কোনও ম্যাচে বসেননি।
মেহতাব হোসেন বারোটা ম্যাচই খেলেছেন কেরল ব্লাস্টার্সের হয়ে। পজিশন দখলের যুদ্ধে তাঁর জায়গা কোনও বিদেশি কেড়ে নিতে পারেননি আইএসএলে এখনও।
মেহতাবের টিমের গোলের নীচে দাঁড়াচ্ছেন যিনি, সেই সন্দীপ নন্দী আশি শতাংশ ম্যাচ খেলেছেন এ বার।
রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়ামে মঙ্গলবারই মেহতাব-সন্দীপদের বিপক্ষ দলের গোলে যিনি দাঁড়াবেন সেই দেবজিৎ মজুমদার তো এ বার টুর্নামেন্টেরই অন্যতম সেরা ফুটবলার। টিমের স্প্যানিশ গোলকিপারকে বসিয়ে খেলছেন তিনি। আটলেটিকো দে কলকাতাকে এত বার ‘সেভ’ করেছেন যে, ‘সেভজিৎ’ নাম হয়ে গিয়েছে এই বঙ্গসন্তান গোলকিপারের। যাঁর সম্পর্কে বলতে গিয়ে এটিকে কোচ জোসে মলিনা মন্তব্য করেছেন, ‘‘একজন ভাল কিপার একটা টিমকেই বদলে দিতে পারে। সেটা আমরা পাচ্ছি।’’
দেল পিয়েরো, রবের্তো কার্লোসের মতো বিশ্বের অন্যতম সেরা প্রাক্তন ফুটবলারের পর এ বার দিল্লির কোচ হয়ে এসেছেন ইতালির বিশ্বকাপজয়ী জামব্রোতা। সৌভিক চক্রবর্তী তিন বিশ্বখ্যাত প্রাক্তনের কাছেই অপরিহার্য থেকে গিয়েছেন এই তিন বছর। চোট আর কার্ড সমস্যা ছাড়া বসেননি একটা ম্যাচও। এত ভাল পারফরম্যান্স বরানগরের ছেলের। ডাক্তারের ছেলে সৌভিক বিশ্ব তারকাদের হাতে পড়ে বদলে ফেলেছেন নিজের পজিশনও। মিডিও থেকে এখন নিয়মিত সাইড ব্যাক। সৌভিকের ক্লাব টিমে মোহনবাগান কোচ সঞ্জয় সেন তাঁকে খেলাতেন মাঝমাঠে স্ন্যাচার হিসেবে। আর কার্লোসের পরে এ বার জামব্রোতাও দিল্লি ডায়নামোসে তাঁকে খেলাচ্ছেন উইং ব্যাক। কোনও বিদেশি কোচ ডান দিকে। কোনও বিদেশি আবার বাঁ দিকে। মজা করে সৌভিক বললেন, ‘‘স্বদেশি কোচের কাছে আমি মিডিও। বিদেশিদের হাতে পড়ে সাইড ব্যাক। নতুন জায়গায় সেট করে নিতে কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। দু’-তিনটে পজিসনে খেলব কখনও ভাবিনি।’’
নর্থ-ইস্টের শেষ চারের আশা যিনি বাঁচিয়ে রাখলেন গত শনিবার গোল করে, সেই সৌভিক ঘোষের বাড়ি বালিতে। গত বারের চ্যাম্পিয়ন মাতেরাজ্জির চেন্নাইয়ান এফসি-কে এ বার গ্রুপ লিগ থেকেই বিদায় করে দিলেন তিনি-ই। পাহাড়ি দলের গোলে যিনি রয়েছেন সৌভিকের মতো তিনিও বঙ্গসন্তান—সুব্রত পাল। চোট সারিয়ে ফিরে দারুণ খেলছেন। জাতীয় দলে টানা খেলা এগারো বছর খেলা সোদপুরের মিষ্টু এ বার জন আব্রাহামের টিমের হয়ে কত যে নিশ্চিত গোল বাঁচিয়েছেন!
সোজা কথা, এ বার ইন্ডিয়ান সুপার লিগে বঙ্গসন্তানদের রমরমা। বিশ্বকাপ, ইউরো কাপ খেলা প্রাক্তন বিদেশিদের পাশে বাঙালি ফুটবলারদের যে ঔজ্জ্বল্য চমকে দিচ্ছে। গত দু’টো আইএসএলে যে মধুর চমক ছিল অনুপস্থিত। মঙ্গলবারের কলকাতা বনাম কেরল যুদ্ধকে বলা হচ্ছে আইএসএলের অন্যতম হাইভোল্টেজ ম্যাচ। কী আশ্চর্য, প্রথম চারে ঢোকার সেই লড়াইয়েও বঙ্গসন্তানদের ছ়ড়াছড়ি। এটিকের হয়ে রিষড়ার দেবজিতের সঙ্গী বেহালার অর্ণব মণ্ডল, উত্তরপাড়ার প্রীতম কোটাল, সোদপুরের প্রবীর দাস, বজবজের অবিনাশ রুইদাসরা। উল্টো দিকে কেরলের হয়ে নামবেন বারুইপুরের মেহতাব, বর্ধমানের সন্দীপ, সোদপুরের মহম্মদ রফিক। কলকাতা ডার্বিতেই যা দেখতে ফুটবলপ্রেমীরা অভ্যস্ত।
ব্যারাকপুরের প্রণয় হালদারের চোট। মাসখানেক হল মাঠের বাইরে। কিন্তু যে ক’টা ম্যাচ মুম্বই সিটি এফসি-র হয়ে খেলেছেন তাতেই চমকে দিয়েছেন প্রণয়। আন্তোনিও হাবাসের পুণে সিটির নারায়ণ দাস বা জিকোর এফসি গোয়া শুভাশিস রায়চৌধুরী, দেবব্রত রায় যখনই সুযোগ পেয়েছেন দলে, ভাল খেলেছেন।
পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে, বিভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজি টিমে থাকা বাঙালি ফুটবলারদের মধ্যে একশো শতাংশ ম্যাচ খেলেছেন তিন জন। কলকাতার দেবজিৎ, কেরলের মেহতাব, দিল্লির সৌভিক চক্রবর্তী। ষাট-সত্তর শতাংশ খেলেছেন অর্ণব, সন্দীপ, সুব্রত, প্রীতম, প্রবীর, রফিক, অবিনাশরা। তিরিশ-চল্লিশ শতাংশ ম্যাচে জার্সি পেয়েছেন বাকি বঙ্গসন্তানরা। অন্য কোনও রাজ্যের ফুটবলাররা যা পাননি। গোয়া, কেরল, মহারাষ্ট্র, পঞ্জাব, মেঘালয়ের মতো দেশের ফুটবল-জনপ্রিয় অন্য রাজ্যগুলোর এত ফুটবলার নানা টিমে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দাপট দেখাচ্ছেন, এ রকম ঘটনাও গত দু’টো আইএসএলে দেখা যায়নি। আরও যেটা দেখার, আইএসএলেরর প্রতিটা টিমের কোচই বিদেশি। যাঁদের প্রত্যেকের বিশ্বের কোনও না কোনও বড় টুর্নামেন্টে খেলার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা আছে। অনেকের আছে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কৃতিত্বও। তাঁরাই আইএসএলে নির্ভর করছেন সোদপুর, বারুইপুর, রিষড়ার বাঙালিতে।
হঠাৎ করে কেন বঙ্গসন্তানরা আলো ছড়াতে শুরু করেছেন দেশের সবথেকে আড়ম্বরের ফুটবল টুর্নামেন্টে? আইএসএলের ‘ভীষ্ম’ বলা হচ্ছে যাঁকে সেই সন্দীপ নন্দীর ব্যাখ্যা, ‘‘বিদেশিদের সঙ্গে খেলার সুযোগটা নিতে পারছে বাংলার ছেলেরা। পরিকাঠামো, সম্প্রচারের আড়ম্বরের জন্য প্রত্যেকের মধ্যে একটা বাড়তি ভাল খেলার উদ্যোগ দেখছি।’’ একচল্লিশ বছরের সন্দীপ যা বলছেন তার সঙ্গে একমত ষোলো বছর বড় ক্লাবে খেলা মেহতাব হোসেন। ‘‘আই লিগের সঙ্গে আইএসএলের অনেক ফারাক। এখানে বিদেশি কোচেদের চোখে পড়লে তবেই টিমে ঢোকা যায়। তাই ভাল খেলার তাগিদটা বেশি।’’ বড় ক্লাবে চোদ্দো বছর খেলছেন সুব্রত পাল। দেশ-বিদেশে দেশের জার্সিতে খেলার অভিজ্ঞতা প্রচুর। তিনি একটু অন্য পথে হাঁটলেন। ‘‘বাংলা থেকে একঝাঁক ভাল ফুটবলার উঠে এসেছে একসঙ্গে। ভারতীয় দলেও দেখছি বাংলার ছেলে বাড়ছে। যেটা অনেক দিন দেখা যায়নি।’’ এর পিছনে দু’টো কারণ দেখাচ্ছেন ভারতীয় ফুটবলারের ‘স্পাইডারম্যান’।
এক) টুর্নামেন্টের আবহ একটা বড় ফ্যাক্টর। তাই পরিশ্রম করে দলে ঢোকার তাগিদ বেড়েছে।
দুই) গ্রামে-গঞ্জে এখনও কিছু কোচিং ক্যাম্প আছে যারা ফুটবলার সাপ্লাই দিতে পারে। সেখান থেকে ভাল ফুটবলার আসছে।
যে রসায়নই হোক, আইএসএলে মেহতাব-দেবজিত-সৌভিকদের একসঙ্গে আলো ছড়ানোটা কিন্তু বাংলার ফুটবলের পক্ষে ভাল বিজ্ঞাপন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy